নব্বইয়ের কাল্ট হিরো

নিউজিল্যান্ড দল সর্বকালের সেরা না হোক, নব্বইয়ের দশকে কার্যকর বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাঁদের অনেকেই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ পাল্টে দিয়েছেন। তেমনই একজন হলেন ক্রিস হ্যারিস৷

তিনি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের কাল্ট হিরো। ন্যাগিং স্লো মিডিয়াম পেস, আর লোয়ার-মিডল অর্ডারে কার্যকর সব ইনিংস, যেকোনো কন্ডিশনে – যেকোনো উইকেটে পারফরম করতে পারার দক্ষতা – সব মিলে ক্রিস হ্যারিস ছিলেন অনন্য।

নিউজিল্যান্ডের সর্বকালে সেরা অলরাউন্ডদের তালিকায় রিচার্ড হ্যাডলি ও ক্রিস কেয়ার্নসের পরেই তাঁকে গণ্য করা হয়। পেশাদারী খেলোয়াড় আর ক্রিকেট কোচ থেকে রাতারাতি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বনে যাওয়া – তার মতো এমন বর্ণিল ক্যারিয়ার খুব কম ক্রিকেটারেরই আছে।

ক্রিস হ্যারিসের জন্ম ১৯৬৯ সালের ২০ নভেম্বর।, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে৷ তাঁর বাবা, পার্ক জেরাল্ড হ্যারিস, দশ বছর খেলেছেন কিউই ক্রিকেট দলে। বড় ভাই বেন হ্যারিসও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত ছিলেন। এমন খেলোয়াড়ি পরিবার থেকে উঠে আসায় স্বভাবতই তাঁর ওপরও একটা প্রচ্ছন্ন চাপ ছিলো ক্রিকেটকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার।

সেই চাপকে জয় করতেই কিনা- মাত্র একুশ বছর বয়সে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন ক্রিস। ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডে দলের ‘ব্ল্যাক ক্যাপ’ অর্জন করেন। তারপর ২০০৪ পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দটি বছর, তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

প্রায় একযুগেরও বেশি সময়ের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ম্যাচ খেলেছেন আড়াইশো। কিউই ক্রিকেটের ইতিহাসে কেবল তিনিই এই গৌরব অর্জনকারী খেলোয়াড়। বাঁহাতে ব্যাট আর ডানহাতে বল ধরে রেকর্ড গড়তেও কার্পণ্য করেননি৷ স্লো মিডিয়াম বোলার হিসেবে তার নেয়া উইকেটের সংখ্যা ২০৩৷

নান্দনিক ব্যাটিংয়ের নিউজিল্যান্ড দলের ইতিহাসে তিনিসহ মাত্র চারজন বোলারই পেরেছেন দুইশোর বেশি উইকেট নিতে৷ শুধু তাই নয়, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ‘কট অ্যান্ড বোল্ড’ ডিসমিসাল করার রেকর্ড তিনি ভাগাভাগি করছেন শ্রীলঙ্কান বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরনের সাথে।

ব্যাটসম্যান হিসেবেও তিনি কম যান না। মিডল অর্ডারে ক্রিজে নেমে তুলে নিয়েছেন চারহাজারেরও বেশি রান, যার মধ্যে ১৬ টি ছিল হাফ সেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করা ক্রিকেটারদের মধ্যে তার স্থান নবম। তার ব্যাটিং স্ট্র‍্যাটেজিটা বেশ মজাদার ছিলো।

বেশিরভাগ সময়েই মাঠে নামতেন দলের চরম দুরবস্থায়। পাহাড়সম টার্গেট মাথায় নিয়ে, এক-দুই রানের সিঙ্গেল নিয়ে রানের ব্যবধান কমিয়ে আনতেন। এরপর শুরু করতেন বাউন্ডারি। চাপের মুখ থেকে দলকে একটু একটু করে টেনে তুলে জিতিয়ে দেবার জন্য ভক্তরা ভালোবেসে তার নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য ফিনিশার’!

বোলিং আর ব্যাটিংয়ে তো ভালো ছিলেনই। তবে ম্যাচ জেতার সবচেয়ে গোপন যে অস্ত্রটি, সেই ফিল্ডিংয়েও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত৷ ৯৬টি ক্যাচ ধরে তিনিই ছিলেন নিউজিল্যান্ড দলের সর্বোচ্চ ক্যাচটেকার। এক দিনের ক্রিকেটে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে ‘স্পেশালিস্ট’ আখ্যা পেলেও টেস্ট ম্যাচে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি। ২৩ টা ম্যাচ খেলেই শেষ হয়ে যায় তার টেস্ট ক্যারিয়ার। তবে, আধুনিক সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাঁর অবদান অনন্য।

২০০৪ সালে জাতীয় দলে খেলার পাট চুকিয়ে দেন ক্রিস৷ তারপর কিছুদিন ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এরপর বিতর্কিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) যোগ দেন। পরে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) নিলামেও ছিল তাঁর নাম। তবে, কেউ আগ্রহী হয়নি তাকে দলে ভেড়াতে।

তাই, খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টেনে পাড়ি জমান জিম্বাবুয়েতে৷ প্রায় এক বছর জিম্বাবুয়ের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নেপাল ক্রিকেট দলের কোচ হবার কথা পাকাপাকি হলেও ততদিনে ডাক পেয়ে যান কিউই দলেরই ব্যাটিং কোচ হিসেবে৷

অগত্যা বিদেশের মায়া ছেড়ে দেশেই থিতু হন তিনি। মাঝখানে কিছুদিন অর্থাভাবে মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করলেও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে বেশি দেরি হয়নি, তাই দ্রুতই ছেড়ে দেন সে কাজ। কোচের দায়িত্ব শেষ হবার পর স্কাই স্পোর্টসের বিশ্লেষক হিসেবেও তাঁকে দেখা গিয়েছিলো।

ক্রিস হ্যারিসকে মনে রাখার সবচেয়ে বড় উপলক্ষ্য হল ২০০০ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। সেবার ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে ২৬৫ রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ১৩২ রান ‍তুলতেই পাঁচ উইকেট হারিয়ে বসে নিউজিল্যান্ড।  সেখানে দাঁড়িয়ে হ্যারিস ১২২ রানের জুটি বাঁধেন ক্রিস কেয়ার্নসে সাথে।

হ্যারিস ৭২ বলে করেন ৪৬ রান। তাতে ছিল মাত্র চারটা বাউন্ডারি। খুব বড় ইনিংস না হলেও পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সেটা ছিল খুবই গুরুত্ববহ। এর সুবাদে প্রথমবারের মত ও এখন পর্যন্ত একমাত্র আইসিসি ইভেন্টের শিরোপার স্বাদ পায় নিউজিল্যান্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link