ফুটবল!
এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। আর সেই খেলার খেলোয়াড়দেরকে তো আমরা চিনিই। আর সেই ফুটবল খেলা যারা পরিচালনা করেন তাদেরকে কতটুকু চিনি আমরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেনা হয়ে হয়ে উঠেনি সেই সব রেফারিদের।
লাল কার্ড, হলুদ কার্ড দেখা যায় ফুটবলে। আর সেই লাল হলুদ কার্ড যারা দেয় তাঁরাই হলেন রেফারি। প্রিয় দল হারলে আমরা রেফারির উপর দোষ চাপাতে এক মিনিটও দেরি করি না। রেফারির উপর নির্ভর করে ফুটবল মাঠে খেলা কতটা স্বচ্ছ হবে। বাজে রেফারিং যেমন অভিযোগ আছে তেমন অনেক রেফারি আছে যারা খেলা পরিচালনা করলে ম্যাচের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠার কোনো সুযোগ থাকে না।
খেলার স্বচ্ছতার জন্য রেফারির ধারণা প্রথম নিয়ে আসেন রিচার্ড মোলকাস্টার; ১৫৮১ সালে। আর ফুটবলারদের জন্য লাল কার্ড, হলুদ কার্ডের প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে।
কিছু রেফারি আছে যারা তাঁদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শক্তি দিয়ে ফুটবলক করেছেন স্বচ্ছ। আর স্বচ্ছ ফুটবলের পূজারী আমরা সবাই।
- পিয়েরলুইজি কলিনা
ইতালিয়ান রেফারি পিয়েরলুইজি কলিনা। ফিফা রেফারী হিসেবে নিযুক্ত হন ১৯৯৫ সালে। টানা ছয় বছর ফিফার বর্ষসেরা রেফারি হিসেবে নির্বাচিত হন কলিনা। তাঁকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের অন্যতম সেরা রেফারি হিসেবে। বর্তমানে রেফারিং ক্যারিয়ার থেকে বিদায় নিলেও যুক্ত আছেন রেফারিংয়ের সাথে। উয়েফার রেফারি কমিটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এছাড়াও তিনি ২০১০ সালের জুলাই থেকে দায়িত্ব পালন করছেন ইউক্রেনের ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান হিসেবে।
কলিনাকে ডাকা হত কোজাক বলে। অ্যালোপেসিয়ার কারণে তাঁর মাথায় চুল না থাকায় তাঁকে এই নামে ডাকা হত। কালিনা তাঁর রেফারিং এর কোর্স শেষ করেন ১৯৭৭ সালে। এরপর ইতালিয়ান সিরি ‘এ’-এর ৪৩টি ম্যাচ পরিচালনা করে ১৯৯৫ সালে ফিফার রেফারি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। ফিফার রেফারি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ২০০৫ সাল পর্যন্ত।
এর মধ্যে তিনি কিছু বড় বড় ম্যাচ পরিচালনা করেন যার মধ্যে ছিলো ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনাল এবং ১৯৯৯ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল।
- মার্কাস মার্ক
জার্মানীর সাবেক রেফারি মার্কাস মার্ক। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা ফুটবল রেফারি। বুন্দেসলিগার সবচেয়ে বেশি ম্যাচ পরিচালনা করার রেকর্ডও তাঁর দখলে। এছাড়াও তিনি সবচেয়ে কম বয়সী রেফারি হিসেবে সুযোগ পান বুন্দেসলিগা ম্যাচ পরিচালনা করেন। ১৯৮৮ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে প্রথমবারের মত পরিচালনা করেন বুন্দেসলিগার ম্যাচ।
মার্কাস মার্ক ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা অলিম্পিকেও ম্যচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ফিফার রেফারি হিসেবে অন্তর্ভক্ত হন ১৯৯৩ সালে। এই সময়ের অনেকবার বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচের দায়িত্ব পালন করে মার্ক।বুন্দেসলিগার ২০০৮ সেশনে সর্বশেষ বারের মত রেফারি হিসেবে মাঠে নামেন মার্ক। বর্তমানে তিনি তুর্কিশ টিভি চ্যানেল লিগ টিভির প্রধান রেফারি ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন। রেফারিং ক্যারিয়ারের পাশাপাশি তিনি একজন দন্ত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।
- হাওয়ার্ড ওয়েব
সাবেক ইংলিশ রেফারি হাওয়ার্ড ওয়েব সম্প্রতি রেফারি হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন। তিনি ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফিফার অন্তর্ভুক্ত রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৩ সাল থেকে নিয়মিত ভাবেই পরিচালনা করেছেন ইংলিশ ফুটবলের সর্ব্বোচ্চ লিগের ম্যাচ। ২০১০ সালে প্রথম রেফারি হিসেবে একই বছর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করার রেকর্ড তৈরি করেন।
ওয়েব অনেক বার এফএ কাপ ফাইনাল, কমিউনিটি শিল্ড ফাইনাল এবং লিগ কাপের ফাইনাল পরিচালনা করেন।২০১০ সালে বর্ষসেরা রেফারি হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়াও ফুটবলে অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে সম্মাননায় ভূষিত হন হাওয়ার্ড ওয়েব। রেফারিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার আগে তিনি ইয়র্কশায়ার পুলিশের সার্জেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- কিম মিলটন নিয়েলসন
ডেনমার্কের সাবেক এই রেফারি মূলত পরিচিত ছিলেন তার উচ্চতার জন্য। ছয় ফুট ছয় ইঞ্চির এই রেফারি অন্য অনেক ফুটবলারের থেকেও অনেক লম্বা ছিলেন। রেফারিং ক্যারিয়ারে ১৫৪ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং ৫৪ টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। ১৯৮৮ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ফিফার রেফারির হসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
নিয়েলসন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রেফারি হিসেবে দায়ত্ব পালন করছেন। যার মধ্যে ছিলো ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনাল,১৯৯৪ উয়েফা কাপ ফাইনাল,২০০৪ সালের চ্যাপমিয়নস লিগ ফাইনাল এবং ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়াটার ফাইনাল। এছাড়াও ১৯৯৮ বিশ্বকাপের দুইটি ম্যাচ পরিচালনা করেন নিয়েলসন।
২০০৬ সালে রেফারিং ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান তিনি। রেফারিং এর পাশাপাশি একজন আইটি ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
- স্যান্ডোর ফল
হাঙ্গেরিয়ান এই রেফারিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা রেফারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তিনি ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের একটি সিদ্ধান্তের কারণে অনেক বেশি সমালোচিত হন। এমনকি ফিফাও এর ঘটনার জন্য তাঁর সমালোচনা করেছে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের কোয়াটার ফাইনালে স্পেন এবং ইতালির মধ্যকার ম্যাচে ইতালিয়ান ডিফেন্ডার মাউরো টাসট্টি ডি বক্সে কনুই দিয়ে আঘাত করেন স্প্যানিশ ফরওয়ার্ড লুইস এনরিখকে। ওই সময়ে পেনাল্টি কিংবা কোনো কার্ড দেখাননি স্যান্ডোর ফল। এই ঘটনার জন্য তাঁকে আট ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করে ফিফা।
স্যান্ডোর ফল ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করে বিখ্যাত হন। আইএফএফএইচএসের বিচারে পরপর তিনবার সেরা রেফারির মর্যাদা অর্জন করেন তিনি। রেফারিং এর পাশাপাশি তিনি হাঙ্গেরিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত।
- পিটার মিকেলসেন
এই ড্যানিশ রেফারিকে বিবেচনা করা হয় ডেনমার্কের আধুনিক রেফারিংয়ের জনক হিসেবে। মাত্র ৩০ বছর বয়সে ১৯৯০ বিশ্বকাপে দুইটি ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ পান। এছাড়াও ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও ৩ টি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। মিকেলসন ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত উয়েফার বিভিন্ন টুর্নামেন্টেও পরিচালনা করেন অসংখ্য ম্যাচ।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফুটবল হিস্টোরি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস মিকেলসনকে ১৯৯১ এবং ১৯৯৩ সালে বিশ্বের সেরা রেফারি হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার চলাকালীন সময়ে নিজের রেফারিং ক্যারিয়ারে ইতি টানেন নিকেলসন। রেফারিং এর পাশাপাশি ১০ বছর ডেনমার্কের কোম্পানি এফ গ্রুপে মানব সম্পদ বিভাগে চাকরি করেছেন। দীর্ঘ দিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ২০১৯ সালে।
- মিচেল ভাউট্রট
ফ্রান্সের সাবেক এই রেফারি এখন পর্যন্ত ফ্রান্সের সেরা রেফারি। তবে এর মধ্যেই একটি হাস্যরসাত্মক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইতালি এবং আর্জেন্টিনার মধ্যকার ম্যাচে আট মিনিট অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ঘড়ি চালু করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ভায়ট্রট ১৯৮২ বিশ্বকাপে দুই ম্যাচ এবং ১৯৯০ বিশ্বকাপে তিন ম্যাচ পরিচালনা করেন। পাশাপাশি ১৯৯৩ ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচও পরিচালনা করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ম্যাচের পাশাপাশি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচও পরিচালনা করেন। ১৯৮৬ সালে বার্সেলোনা এবং স্টুয়া বুখারেস্টের মধ্যকার ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল ম্যাচও পরিচালনা করেন তিনি। আই এফ এফ এইচ এফ পরপর দুই বছর তাঁকে বিশ্বের সেরা রেফারি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৬ সালে ইউরোপিয়ান কাপের সেমি ফাইনালে রোমার কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার কারণে ফিফা কতৃক নিষিদ্ধ হন মিচেল ভাউট্রট।
- পেদ্রো পোরেন্সা
পর্তুগিজ পেদ্রো পোরেন্সা আধুনিক সময়ের সেরা একজন রেফারি। পোরেন্সা এখনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করছেন। এই বছরে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং উয়েফা ইউরোর ফাইনাল পরিচালনা করার রেকর্ড গড়েন। পোরেন্সা ফিফার রেফারি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন ২০০৩ সালে। এছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে তিনি উয়েফা এলিট প্যানেলের একজন রেফারি। পর্তুগিজ ফুটবল ফেডারেশন থেকে ২০০৭ এবং ২০১১ সালে সেরা রেফারি হিসেবে স্বীকৃতি পান। আইএফএফএইচএস ২০১২ সালে তাঁকে সেরা রেফারি হিসেবে স্বীকৃতি পান। আন্তর্জাতিক ফুটবলের পাশাপাশি ঘরোয়া ফুটবলেও গুরুত্বপুর্ন ম্যাচে দায়িত্ব পালন করে তিনি।২০১৪ সালে বিশ্বকাপে বেশ কয়েকটি ম্যাচ পরিচালনা করেন।
- অস্কার রুইজ
সাবেক এই কলম্বিয়ান রেফারিকে বিবেচনা করা হয় কলম্বিয়ার ইতিহাসের সেরা রেফারি হিসেবে। ফিফার আন্তর্জাতিক রেফারি হিসেবে ১৯৯৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রেফারিং করেছেন তিনি। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন ১৯৯৫ সালে। ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০১০ বিশ্বকাপের ফ্রান্স এবং দক্ষিন আফ্রিকার ম্যাচ পরিচালনা করার সময় অনেক সমালোচনার শিকার হন। রেফারিং ছাড়ার পর কন্মবেল অঞ্চলের রেফারি এসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামে কাজ করছেন। রেফারিং এর পাশাপাশি একজন আইনজীবি হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।
- ফ্রাংক ডি ব্লেকের
বেলজিয়ান ফ্রাংক ডি ব্লেকের ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রেকর্ড সাতবার বেশ সেরা রেফারি নির্বাচিত হন।রেফারি হিসেবে অভিষেক হয় ১৯৮৮ সালে। আর ফিফার অন্তর্ভুক্ত রেফারি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন ১৯৯৮ সালে।আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথম ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পান ২০০২ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে,২০০১ সালে।
ফিফার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর পাশাপাশি ২০০৪ এবং ২০০৮ ইউরোতেও ম্যাচ পরিচালনা করেন। বেলজিয়াম প্রথম কোনো রেফারি হিসেবে বিশ্বকাপে ৭ টি ম্যাচ পরিচালনার রেকর্ড গড়েন তিনি। ২০০৬ এবং ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ পান ব্লেকের। ২০১২ সাল থেকে ফিফার রেফারি টেকনিক্যাল উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত আছেন।