১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শোয়েব আখতারকে দারুণ বল করতে দেখে কোনো এক সাংবাদিক ফ্রেড ট্রুমানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘একে দেখে কি বুঝছেন? দারুণ বোলার না?’ ট্রুম্যান হালকা হেঁসে যা বলেন তার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘দারুণ কি না জানিনা। তবে মোটামুটি জোরে বলটা করে।’
সাংবাদিক তো শুনে অবাক। ইয়র্কশায়ারের বুড়োটা বলে কি? এটা মোটামুটি জোর? ব্যাটা নাক উঁচু বুড়ো। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, ইয়র্কশায়ারের সাবেকরা কোনোদিনই মুক্তকণ্ঠে কারুর প্রশংসা বা নিন্দা করতেন না, তার কারণ তাঁরা ক্রিকেটটা সত্যিই ভালো বুঝতেন।
ক্রিকেট এমন একটা খেলা, যেটা যে কোনো দিন যেকোনো কাউকে বোকা বানাতে পারে। কারুর বিশাল প্রশংসা বা নিন্দা করলে, আর সে যদি আশাতীত কিছু করে বসে, জনতার সামনে হাস্যস্পদ হয়ে যাবার একটা বিশাল সম্ভাবনা থাকে। এবং বর্তমানে সহজলভ্য আন্তর্জাল ও সমাজমাধ্যমের কল্যানে তো ব্যাপারটা আরোই ঝুঁকির। আর গত মাস দেড়েকে তো ক্রিকেট খেলাটা অনবরত সকলকে বোকা বানিয়ে চলেছে।
সেই ব্রিসবেনে ভারতের ওই অভাবনীয় জয় থেকে শুরু। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের বাংলাদেশকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়া। আজিঙ্কা রাহানের ফর্ম-যখনই সমালোচনার কাড়ানাকাড়া গুলো মাত্রা ছাড়ায়, দলের যখন অসম্ভব দরকার, সেই সময় একটা বোকা বানানো ইনিংস খেলা, তারপর আবার থোড়বড়িখাড়া ২০, ৩০, ৪০।
৪-০ এর কোলাহলের মাঝে, ইংল্যান্ডের ভারতকে প্রথম টেস্টে গোহারান হারানো। এদের মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন, পান্তের উইকেটকিপিং। ব্রিসবেন টেস্টের পর, পান্তের টেস্ট ব্যাটিং নিয়ে কারোরই কোনো সন্দেহ ছিলোনা, আর থাকার কথাও না। কিন্তু তাঁর উইকেট কিপিং নিয়ে একটা নাক সিঁটকানো মনোভাব এই কদিন আগে অবধিও বিরাজমান ছিল।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনের কোনায় একটা অবাস্তব চাহিদা দানা বাঁধতো, ঋষভ পান্ত যেন ব্যাটিংটা করে দেয়, আর ভারতীয় দল পরিচালন সমিতি যেন কোনো একটা ছুতোয় ভারতের বোলিংয়ের সময় পান্থকে সাজঘরে রেখে, উইকেটের পিছনে বেঁটেখাটো শিলিগুড়ির ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
মোটামুটি হলফ করেই বলতে পারি, আপামর ক্রিকেট প্রেমীর মনের ভাবটাও আমার থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না। কিন্তু ওই, ক্রিকেট এমন একটা খেলা, আর পান্থ এমন একজন লোক (থুড়ি ছেলে) যে আমাদের বোকা বানিয়ে গেলো।
গোটা চেন্নাই টেস্ট জুড়ে পান্ত যা উইকেটকিপিং করলেন, সাহা, বা শুধু সাহা কেন অ্যালেন নোট বা প্রবীর সেনরাও করতে পারলে গর্বিত হতেন। ইংল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ উইকেটরক্ষক, বেন ফোকস তো তবু কিছু সহজ ক্যাচ ও স্টাম্পিং মিস করেছেন, অনেক চেষ্টা করেও, পান্থের সেরকম বড়ো একটা ভুল চোখে পড়ছে না।
চেন্নাইয়ের এই পিচে, উইকেটরক্ষা করা ততটাই কঠিন, যতটা বিনা অক্সিজেন মাস্কে এভারেস্ট চূড়োয় ওঠা। অশ্বিনের বলে যে স্টাম্পিংটা করলেন পান্ত, এবং সেটার যদি কোনো স্টিল ছবি থেকে থাকে, তাহলে সেটা বছর কুড়ি পরে সংগ্রহে রাখার মতো দামি ছবি হবে। পান্ত কিপিংয়ে আরো উন্নতি করে ফেললেও, এতো ভালো স্টাম্পিং আর কখনো করতে পারবেন কিনা, বা তার চেয়েও বড়ো কথা করার সুযোগ পাবেন কিনা সেটা ভাবার বিষয়।
কিন্তু লোকটা, থুড়ি ছেলেটা তো সেই ঋষভ পান্তই। কে জানে, হয়তো আগামী ম্যাচেই আবার যাচ্ছেতাই কিপিং করে, হাটুরে মারের মতো ট্রলের বন্যাকে নিমন্ত্রণ করবেন নিজের দিকে। কিন্তু যতক্ষণ না সেটা হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি পান্তের ‘জিন্দেগি এক সাফর হ্যায় সুহানা।’