সেটা সাদাকালো যুগের রঙিন একটা সময়। আজকের মত রঙিন টিভি অবশ্য ছিল, তবে সেটা এলইডি নয়। স্মার্টফোন দূরের কথা মোবাইল ফোনই ছিল না। ভরসা কেবল ল্যান্ডফোন। ইন্টারনেটের দুনিয়াও সেটা নয়।
সেই সময় কলকাতার বেহালায় একটা ধুন্ধুমার প্রেমকাহিনীর উৎপত্তি হয়। সীমানার এপার আর ওপারের দু’টি বাড়ি। এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে সহজে যাতায়াত করা যায়। এ বাড়িতে কিছু বললে ও বাড়ি থেকে শোনা যায়। এপাশে রায়, ওপাশে গাঙ্গুলি।
গল্পের পাত্রপাত্রী দুই বাড়ির দু’জন। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম ডোনা। ছেলেটা সৌরভ। সৌরভ শুধু প্রেমের সৌরভই ছড়াননি, বাইশ গজে ক্রিকেটের সৌরভ, নেতৃত্বের সৌরভ, ভয়ডরহীনতার সৌরভ – সবই ছড়িয়েছেন।
জি, ঠিকই ধরেছেন – তিনি হলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ভারত তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা অধিনায়ক। লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে উদযাপনের সাহস দেখানো সেই সৌরভ। সেই সৌরভ বিশ্বের নামকরা সব বোলারদের নাকানিচুবানি খাওয়ালেও ক্লিন বোল্ড হয়েছিলেন ডোনার বলে।
শুরুটায় অবশ্য দু’জন ছিলেন কেবলই খেলার সঙ্গী। তখন কেবল কথা বলতে শিখেছেন। এরপর বড় হয়েছেন এক সাথে। একটা সময় এমন ছিল, বাড়ির সামনে ব্যাডমিন্টন খেলতেন সৌরভ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতেন ডোনা।
ডোনাকে বারান্দায় দেখে হাবভাব পাল্টে যেত সৌরভের। কলারটা একটু তুলতেন। অকারণেই হাসতেন। ডোনাও কম না, যতক্ষণ সৌরভ থাকতেন – ডোনা জায়গা থেকে সরতেন না। রীতিমত সিনেম্যাটিক ব্যাপার। সেখান থেকেই শুরু।
কৈশোর পেড়িয়ে তারুণ্যে ওঠার পরই হৃদয়ের আদান-প্রদান হয়ে যায় তাঁদের। কলকাতার মান্দারিন নামের একটা রেস্টুরেন্টে নাকি তাঁরা প্রথম ‘ডেট’-এ যান। সেই দিনটা তাঁরা কি করে ভোলেন! সেদিন নাকি সৌরভ একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলেন। এতটাই যে নড়তে পর্যন্ত পারছিলেন না। ডোনাও বুঝেছিলেন, এই মানুষের মনের রাস্তা আক্ষরিক অর্থেই পাকস্থলী হয়ে যায়!
সৌরভ তখনই বিরাট তারকা। লোকেরা ‘প্রিন্স অব ক্যালকাটা’। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে তুলকালাম করে ফেলেছেন। তারপরও ভয়। কারণ, ডোনার বাবার ঠিক গাঙ্গুলি বাড়ির লোকদের পছন্দ নয়। এই গল্পের ভিলেন ওই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব। সেটা অবশ্য ক্রিকেট মাঠের মত এখানেও উড়িয়ে দিয়েছেন গাঙ্গুলি।
ভেবেছিলেন, রেজিস্টার অফিসে চলে যাবেন ডোনার হাত ধরে। ওখানেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলবেন। কিন্তু, সৌরভ কাউকে নিয়ে রেজিস্টার অফিসে গেলে – সেটা কেবল বাড়ির লোক না, খবরওয়ালাদের সুবাদে গোটা ভারত জেনে যাবে। কেউ কেউ তো বলে, গোপনে নাকি বিয়ে করেই ফেলেছিলেন!
তখন সৌরভের দুনিয়া ওলট-পালট। ঠিক করলেন যে করেই হোক – বাবাকে বলতে হবে। সেদিন ঠিকই পা কাঁপছিল সৌরভের, ম্যাকগ্রাদের সামনে না কাঁপলেও বাবার সামনে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। গাঙ্গুলি বাড়িতে আগে কেউ তো আর ভালবেসে বিয়ে করেনি। কোনোক্রমে সাহস করে বলে ফেললেন।
বাবা চন্ডিদাশ গাঙ্গুলি শুনলেন। দৃষ্টি ভাবলেশহীন। শুধু বললেন, ‘তুমি শুধু মন লাগিয়ে ক্রিকেট খেল। আমি দেখছি কি করা যায়!’
এ কথার কি অর্থ হতে পারে! সৌরভ বুঝলেন কি না জানা নেই। তবে, এটুকু ঠিক যে জীবন পাল্টানো ইনিংসটা খেলা তখন হয়ে গিয়েছে সৌরভের।
বাকিটা এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর বাবা। ডোনার বাবার সাথে কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেলেছেন। ডোনার বাবারও মন গলে তাতে, হাজার হোক মেয়ে পছন্দ করেছে কলকাতার যুবরাজকে।
বাকিটা ইতিহাস। দুই বাড়ি মিলে অনেক ধুমধাম করে বিয়ে দেয় দু’জনের। দিনটা ছিল ১৯৯৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ডোনা রায় হন ডোনা গাঙ্গুলি।
সৌরভ সেই সময়ের পর ক্ষুদ্র থেকে আরও বড় হয়েছেন, হয়েছেন বাইশ গজের মহীরূহ। ব্যাটিং কিংবদন্তি হয়েছেন, অধিনায়ক হিসেবে কিংবদন্তি হয়েছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রশাসক হয়েছেন – প্রতিটা ধাপেই ছিল ডোনার অবদান। ডোনা নিজে কিন্তু কেবল সংসার সামলাননি, তিনি একজন পেশাদার নৃত্যশিল্পী। চলার পথের সঙ্গী মনমত হলে তো পথটা সামনে এগোবেই!