অমিত প্রতিভার অতৃপ্ত ক্যারিয়ার

২০০৩-০৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ আর এএস মোনাকো। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে মোনাকোকে ৪-২ গোলে হারিয়ে দেয় স্প্যানিশ জায়ান্টরা। ওই ম্যাচের ৮১ মিনিটেই ৪-১ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল রিয়াল। কিন্তু দুই মিনিট পরেই ব্যবধান কমিয়ে স্কোরলাইন ৪-২ করে মোনাকো। গোলটি করেছিলেন রিয়ালেরই একজন প্রাক্তন খেলোয়াড়!

গল্পটি এখানেই শেষ হয়নি। প্রথম লেগে ৪-২ গোলে এগিয়ে থেকে মোনাকোর মাঠে ফিরতি লেগের ম্যাচ খেলতে যায় রিয়াল। আর ঘরের মাঠে স্প্যানিশ জায়ান্টদের ৩-১ গোলে হারিয়ে দেয় মোনাকো। দুই লেগ মিলিয়ে স্কোর লাইন দাঁড়ায় ৫-৫। কিন্তু অ্যাওয়ে গোলে এগিয়ে থেকে সেমিফাইনালে ওঠে মোনাকো।

রিয়াল মাদ্রিদের এমন পরাজয়ে দায়টা নিজেদের খেলোয়াড়েরই। প্রথম লেগে শেষ মুহূর্তের ওই গোলের পর, দ্বিতীয় লেগেও রিয়ালের জালে একবার বল জড়িয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক্তন। তবে তার নামটি একটু অপরিচিত বটে – ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস সানচেজ।

ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস ১৯৭৬ সালের ৫ জানুয়ারী স্পেনের ক্যাসেরেস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। মাত্র পাঁচ বছর তিনি টলেডো স্পোর্টস স্কুলে ফুটবল খেলা শুরু করেন। অবশ্য পেশাদার ফুটবলে তার আগমন ঘটে ১৭ বছর বয়সে। স্পেনের ক্লাব আলবেসেতে যোগ দেন মরিয়েন্তেস। যেখানে তিনি দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের মাধ্যমে গোল করে নিজেকে একজন উজ্জ্বল গোলস্কোরার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

এর পরেই প্রতিভাবান স্ট্রাইকারের নজরে পড়ে বড় ক্লাবগুলোর। দুই বছর দলটির হয়ে খেলার পরে ১৯৯৫ সালে রিয়াল জারাগোজা ক্লাবে সুযোগ পান মরিয়েন্তেস। লম্বা সময় ধরে স্প্যানিশ ক্লাবটির হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। দলটির হয়ে ৭৭টি ম্যাচ খেলে ৩১টি গোল করেছেন, অবশ্য অ্যাসিস্ট করতে পারেননি একটিও।

আবারো দুই বছর জারাগোজাতে কাটানোর পর মরিয়েন্তেসের ঠাঁই হয় স্পেনের অন্যতম বড় দল রিয়াল মাদ্রিদে। শুরুর দুই মৌসুম দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি, পারফর্ম করেছিলেন প্রত্যাশা অনুযায়ী। কিন্তু ২০০২ সালে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের মূল স্ট্রাইকার হিসেবে আগমন ঘটে কিংবদন্তি রোনালদো দ্য ফেনমেনোনের। আর তাই তরুণ মরিয়েন্তেসের জন্য একাদশে সুযোগ পাওয়া ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। তারপরও নিজের যোগ্যতায় একটানা প্রায় ছয় বছর অল হোয়াইটদের হয়ে খেলেছেন তিনি।

২০০৩ সালে এক বছরের লোনে ফ্রান্সের মোনাকো ক্লাবে পাঠানো হয় মরিয়েন্তেসকে। আর সেখানেই নিজের সবচেয়ে ভয়ংকরতম রূপ প্রদর্শন করেন এই স্প্যানিশ স্ট্রাইকার। ২০০৩-০৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তার পায়ে ভর করেই রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসির মত বড় দলগুলোকে হারাতে সক্ষম হয় মোনাকো।

অবশ্য ফাইনালে হোসে মরিনহো’র পোর্তোর বিপক্ষে হেরে যাওয়ায় শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে পারেনি দলটি। এখন পর্যন্ত ক্লাবটির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। সেই মৌসুমে নয় গোল করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টপ স্কোরার হয়েছিলেন মরিয়েন্তেস। সব মিলিয়ে মোনাকোর হয়ে ৪১ ম্যাচে ২০ গোল করেন তিনি আর সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন আরো পাঁচটি গোল।

লোনের মেয়াদ শেষে মাদ্রিদে ফিরে হয়তো মরিয়েন্তেস ভেবেছিলেন এবার সুযোগ পাবেন ভালভাবে। কিন্তু সে বছরই মাইকেল ওয়েনকে কিনে আনায় সেই আশা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় তার। মাস ছয়েকের মধ্যে শীতকালীন দলবদলের সময় প্রায় দশ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে লিভারপুলে চুক্তি স্বাক্ষর করেন এই প্রতিভাবান খেলোয়াড়।

দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর রিয়াল মাদ্রিদে থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২৭২টি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন, যেখানে অধিকাংশ সময়ই বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নামতে হয়েছে তাঁকে। ৩২টি অ্যাসিস্টের পাশাপাশি স্প্যানিশ জায়ান্টদের হয়ে গোলের সেঞ্চুরি পূর্ন করেছিলেন এই স্ট্রাইকার।

অলরেড হয়ে বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছিলেন ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস। অভিষেক ম্যাচে গোল না পেলেও চার্লটন অ্যাথলেটিকের বিপক্ষে ২০ গজ দূর থেকে করা গোলে নিজের জাত চেনান। কিন্তু এরপরই ধীরে ধীরে অফ ফর্ম গ্রাস করে নেয় মরিয়েন্তেসের প্রিমিয়ার লিগ অধ্যায়। লিভারপুলের হয়ে ৬১ ম্যাচে মাত্র ১২ গোল করতে পারেন তিনি।

এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাই পুনরায় তাকে ফিরতে হয় স্পেনে। এবার ভ্যালেন্সিয়া’র হয়ে শুরু করেন ফর্মে ফেরার মিশন। ২০০৬-০৭ মৌসুমে দলটির হয়ে লিগে ২৪ ম্যাচে বারো গোল করেন তিনি, এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সাত গোল করে ক্লাবের টপ স্কোরার হন। কিন্তু এরপরই শরীরে হানা দেয় ইনজুরি, ফলে একের পর এক মিস করতে থাকেন ক্লাবের ম্যাচগুলো। ভ্যালেন্সিয়ার জার্সি গায়ে ১০২ টি ম্যাচে মাঠে নেমে মরিয়েন্তেসের পা থেকে এসেছিল ৩৪ গোল আর তিনটি অ্যাসিস্ট।

২০০৯ সালে মার্শেইতে চলে আসেন তিনি। ক্লাবটির হয়ে ৪১টি ম্যাচ খেলার পর মরিয়েন্তেস মাঠে নেমেছিলেন সান্তা অ্যানা’র হয়ে। আর এরপরই নিজের বুটজোড়া তুলে রাখেন তিনি। অবসরের পর ধারাভাষ্যকার হওয়ার বেশকিছু প্রস্তাব পেলেও বর্তমানে কোচিং ক্যারিয়ারে আছেন সাবেক এই তারকা।

ক্লাব ক্যারিয়ারের মত জাতীয় দলে অবশ্য খুব একটা সংগ্রাম করতে হয়নি ফার্নান্দো মরিয়েন্তেসকে। বয়সভিত্তিক দল থেকেই নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এই স্ট্রাইকার। আন্তজার্তিক ক্যারিয়ারে ৪৭টি ম্যাচে মরিয়েন্তেস করেছেন ২৭টি গোল।

নিজের দীর্ঘ এক ক্যারিয়ারে রিয়াল মাদ্রিদের হয়েই সবচেয়ে বেশি শিরোপা উদযাপন করেছেন ফার্নান্দো। রিয়ালে থাকাকালীন তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দুইটি লা লিগা, দুইটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ, উয়েফা সুপার কাপসহ অর্জন করেছেন অনেক কিছুই। এছাড়া লিভারপুলের হয়ে জিতেছেন একটি এফএ কাপ এবং একটি উয়েফা সুপার কাপ। এসব ছাড়াও ফ্রেঞ্চ লিগ শিরোপা, ফ্রেঞ্চ লিগ কাপ এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ রয়েছে তার ট্রফি ক্যাবিনেটে।

প্রকৃতি আসলেই বড্ড নির্মম – প্রথমকেই শুধু লালন করে যায় সে। আর তাই হয়তো ২০০৩-০৪ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা পোর্তোর কাব্য যেভাবে বলা হয়, সেভাবে কখনোই বলা হয়নি একই আসরের রানার আপ এএস মোনাকোকে নিয়ে।

আলোচনায় উঠে আসে না খর্বশক্তির মোনাকোকে ফাইনালে তোলার নেপথ্যের নায়ক ফার্নান্দো মরিয়েন্তেস সানচেজের কথা। ফাইনাল জিততে পারলে হয়তো এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সটাও লোকের চোখে পড়তো। এই অতৃপ্তি নিয়েই তাই ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়েছে অমিত প্রতিভাধর এক স্ট্রাইকারকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link