প্রোটিয়া ফিল্ডিং ঐতিহ্য, দ্য গোল্ডেন ঈগল

ব্লান্ড ফিল্ডিং করতেন মূলত কাভার অঞ্চলে। মিড উইকেট আর স্কয়ার লেগেও দেখা যেত প্রায়ই। সেযুগের অনেকের মতে, উপস্থিত বুদ্ধি আর অ্যান্টিসিপেশন ক্ষমতার জোরে ব্লান্ড নাকি আগেভাগেই বলের গতিপথ নির্ণয় করতে পারতেন। নিজের ফিল্ডিং এরিয়ার অনেকখানি কৌণিক দুরত্ব একাই কাভার করতে পারতেন। যে অঞ্চলে ব্লান্ড থাকতেন, সে অঞ্চলে নাকি কেউ সিঙ্গেল নিতে চাইত না। কেননা ব্লান্ডকে ফাঁকি দিয়ে সিঙ্গেল বের করাটা ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি। ষাটের দশকে একটা প্রবাদ ছিল, ‘তুমি যতই তেড়েফুঁড়ে কাভারে বল পাঠাও না কেন, রান পাবে না, কারণ ওখানে থাকেন কলিন ব্লান্ড।’

১.

স্কয়ার লেগে ঠেলে দিয়েই এক রানের জন্য দৌড় লাগালেন ব্যাটসম্যান। হঠাৎ মনে হল মিড উইকেট থেকে কেউ একজন ঝড়ের বেগে ছুটছেন স্কয়ার লেগের দিকে। মুহূর্তের ব্যবধানে যিনি পৌঁছে গেলেন বলের কাছে, ঈগলের মত ছোঁ মেরে বল কুড়োলেন এক হাতে, ছিপছিপে লম্বা মতন শরীরটা শূন্যে ভাসিয়ে থ্রো করলেন নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে! জোরালো নিশানাভেদী থ্রো’খানি স্টাম্পে আঘাত হানতেই তর্জনী উঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন আম্পায়ার, ইউ আর আউট! নার্ভাস নাইন্টিজে ‘রান আউটের’ শিকার হতভাগা ব্যাটসম্যান যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের চোখকে!

ধারাভাষ্যকারের জবানীতে, ‘It travelled like an arrow, along an absolute horizontal trajectory, and hit the stumps at the non-striker’s end in a flash.’ ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার লর্ডস টেস্টের ঘটনা এটি। ব্যাটসম্যান ছিলেন কেন ব্যারিংটন, আর ফিল্ডারের নাম ছিল কলিন ব্লান্ড!

কেন ব্যারিংটন পরে বলেছিলেন, ‘ব্লান্ডের ফিল্ডিং প্রতিভার ব্যাপারে আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু ও যে এতটা অসাধারণ ফিল্ডার, সেটা নিজের চোখে না দেখলে হয়ত বিশ্বাস করতাম না।’ ব্যারিংটনের রান আউটটা ছিল প্রথম ইনিংসে। ঘটনার দুদিন পরই লর্ডসের দর্শক আরও একবার সাক্ষী হল ব্লান্ড ম্যাজিকের! কারও কারও মতে ‘ইট ওয়াজ ইভেন বেটার’!

স্ট্রাইকে ছিলেন ফ্রেড টিটমাস, স্কয়ার লেগে পুশ করে সিঙ্গেল নেবার কথা যেই-না ভেবেছেন, অমনি তাঁর মনে পড়ে গেল ব্লান্ডের কথা। এদিকে নন স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা জিম পার্কস ইতিমধ্যেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন রানের জন্য। তড়িঘড়ি করে তাঁকে ফেরত পাঠালেন টিটমাস। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে, ব্লান্ডের সরাসরি থ্রো’তে রান আউট বেচারা জিম পার্কস!

এরপর যা ঘটেছিল- লর্ডস টেস্টের ফলাফল ছিল ড্র। ট্রেন্টব্রিজে দ্বিতীয় টেস্টে জয়লাভ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ওভালে সিরিজের শেষ ম্যাচটাও হয়েছিল ড্র; কলিন ব্লান্ডের ব্যাট থেকে এসেছিল ১২৭ রানের এক অনবদ্য ‘ম্যাচ সেভিং’ নক। যার সৌজন্যে ৩৫ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় প্রোটিয়ারা।

২.

১৯৩৮ সালের ৫ এপ্রিল, তৎকালীন রোডেশিয়ার (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) বুলাওয়েতে জন্মগ্রহণ করেন কেনেথ কলিন ব্লান্ড। তাঁকে মনে করা হয় রোডেশিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা। ক্রিকেটে ফিল্ডিং অলরাউন্ডারের ধারণাটা সর্বপ্রথম তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ফিল্ডিং লিগ্যাসির সূচনাটা হয়েছিল ব্লান্ডের হাত ধরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, যে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। ব্লান্ডের একসময়ের সতীর্থ ও সাবেক ফাস্ট বোলার পিটার পোলকের ভাষায়, ‘দলের বাকি সবার জন্য কলিন ছিল এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ওর দেখাদেখি আমরাও চাইতাম কীভাবে ফিল্ডিংটা আরও ভাল করা যায়। সত্যি বলতে কলিনই আমাদের শিখিয়েছিল যে ফিল্ডিংয়ে রান বাঁচিয়েও খেলায় ব্যবধান গড়ে দেয়া সম্ভব।’

ব্লান্ড ফিল্ডিং করতেন মূলত কাভার অঞ্চলে। মিড উইকেট আর স্কয়ার লেগেও দেখা যেত প্রায়ই। সেযুগের অনেকের মতে, উপস্থিত বুদ্ধি আর অ্যান্টিসিপেশন ক্ষমতার জোরে ব্লান্ড নাকি আগেভাগেই বলের গতিপথ নির্ণয় করতে পারতেন। নিজের ফিল্ডিং এরিয়ার অনেকখানি কৌণিক দুরত্ব একাই কাভার করতে পারতেন। যে অঞ্চলে ব্লান্ড থাকতেন, সে অঞ্চলে নাকি কেউ সিঙ্গেল নিতে চাইত না। কেননা ব্লান্ডকে ফাঁকি দিয়ে সিঙ্গেল বের করাটা ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি।

ষাটের দশকে একটা প্রবাদ ছিল, ‘তুমি যতই তেড়েফুঁড়ে কাভারে বল পাঠাও না কেন, রান পাবে না, কারণ ওখানে থাকেন কলিন ব্লান্ড।’

৩.

ছয় ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার ব্লান্ড ছিলেন ন্যাচারাল অ্যাথলেট। ছেলেবেলায় ক্রিকেটের পাশাপাশি খুব ভাল হকিও খেলতেন। স্পিড, ব্যালেন্স, অ্যাকুরেসি আর রিফ্লেক্সের এক দুর্দান্ত কম্বিনেশন বলা যায় তাঁকে।

ব্লান্ডের ছিল শক্তিশালী থ্রোয়িং আর্ম। বুলেটগতির ‘ডেড আই’ থ্রোয়ের জন্য তাঁর ছিল দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। মাত্র এক স্টাম্প দেখা যায় এমন দুরূহ অ্যাঙ্গেল থেকেও অনায়াসে স্টাম্পে হিট করতে পারতেন। আবার ৫০-৬০ মিটার দূরত্ব থেকেও নিখুঁত এবং জোরালো থ্রো করতে পারতেন।

ব্ল্যান্ড সবসময় বিশ্বাস করতেন ‘প্র‍্যাকটিস মেকস আ ম্যান পারফেক্ট’। প্র্যাকটিস সেশনে তিন স্টাম্প নয়; বরং এক স্টাম্প লক্ষ্য করে থ্রোয়িং অনুশীলন করতেন। তাঁর প্র্যাকটিস সেশন দেখার জন্যও ভীড় জমে যেত। ক্রিকেটের সর্বকালের জনপ্রিয়তম এন্টারটেইনারদের একজন ছিলেন কলিন ব্লান্ড।

৪.

কেবল ধ্রুপদী ফিল্ডার হিসেবেই নয়; ব্যাটিং সামর্থ্যের দিক দিয়েও খুব একটা পিছিয়ে ছিলেন না এই রোডেশিয়ান লিজেন্ড। ২১ টেস্টে ৪৯.০৮ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ১৬৬৯ রান। তিন সেঞ্চুরির পাশে হাফ সেঞ্চুরি আছে ৯টি।

আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য দর্শকদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় কলিন ব্লান্ড ‘ক্লিন হিটার’ হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। ডাউন দ্য গ্রাউন্ড লফটেড শট খেলায় তাঁর ছিল বিশেষ পারদর্শিতা। ছয় মেরে রানের খাতা খোলাটা ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক।

১৯৬১-৬২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজ দিয়ে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক। সিরিজ শুরুর আগে রোডেশিয়ার হয়ে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে দুটিতেই হাঁকিয়েছিলেন সেঞ্চুরি! অভিষেক সিরিজটা ব্যাট হাতে তেমন স্মরণীয় করে রাখতে না পারলেও (৭ ইনিংসে ২০৫ রান) আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন ফিল্ডিং দিয়ে।

চতুর্থ ও শেষ টেস্টের ভেন্যু ছিল জোহানেসবার্গ। প্রথম ইনিংসের শুরু থেকেই দারুণ খেলতে থাকা কিউই অধিনায়ক জন রিডের সংগ্রহ তখন ৬০ রান, ৮৪ বলে। তাঁকে ফেরাতে হলে এক্সট্রা-অর্ডিনারি কিছু করতেই হত। নিশ্চিত বাউন্ডারি হতে যাওয়া একটি বলকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় ছোঁ মেরে ‘ক্যাচে’ পরিণত করে ঠিক সেটাই করে দেখালেন কলিন ব্লান্ড। ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘গোল্ডেন ঈগল’।

দুর্ধর্ষ সেই ক্যাচের বর্ণনায় উইজডেন লিখেছে, ‘Reid struck it hard and low, a boundary written all over it. Bland flew and swooped, the very motion which earned him the tag ‘Golden Eagle’, and came up with the ball as the players and spectators pinched themselves.’

৫.

১৯৬৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের চার ম্যাচ সিরিজে এক সেঞ্চুরি আর তিন হাফ সেঞ্চুরিতে কলিন ব্লান্ডের ব্যাট থেকে আসে ৩৬৭ রান। গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, নিল হক, রিচি বেনোর মত ওয়ার্ল্ড ক্লাস বোলারের বিপক্ষে এভাবে রান করা মোটেও সহজ ছিল না।

১৯৬৪-৬৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের হোম সিরিজে ৭১.৫০ গড়ে ৫৭২ রান করে আগের সাফল্যকে ছাপিয়ে যান ব্লান্ড। জোহানেসবার্গ টেস্টে ফলোঅন করতে নেমে তুলে নেন ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ১৪৪ রানের ‘ম্যাচ সেভিং’ নক।

১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ঐতিহাসিক সিরিজের প্রসঙ্গে শুরুতেই বলেছি একবার। ৫৭.২ গড়ে ২৮৬ রান নিয়ে সিরিজের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন কলিন ব্লান্ড।

গোটা সিরিজজুড়েই তিনি ধারাবাহিক ছিলেন ব্যাট হাতে। কিন্তু ফিল্ডার হিসেবে ছিলেন অসাধারণের চাইতেও বেশি কিছু। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৬ সালে উইজডেন বর্ষসেরার পুরষ্কারটা উঠেছিল কলিন ব্লান্ডের হাতে। জানিয়ে রাখা ভাল, উইজডেনের ইতিহাসে কলিন ব্ল্যান্ডই প্রথম, যিনি ফিল্ডিংয়ে বিশেষ অবদানের জন্য বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতেছেন।

অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করলেও ক্যারিয়ারটা বেশিদূর লম্বা করতে পারেন নি কলিন। ১৯৬৬-৬৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জোহানেসবার্গ টেস্টে এক ‘অপ্রত্যাশিত’ দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। বাউন্ডারিতে ফিল্ডিংয়ের সময় বিজ্ঞাপনী বোর্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে তাঁর হাঁটু খুব বাজেভাবে চোটগ্রস্ত হয়। ওই এক আঘাতেই শেষ হয়ে যায় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার, মাত্র ২৯ বছর বয়সে!

৬.

শুরু করেছিলাম ১৯৬৫ সালের ইংল্যান্ড সফর দিয়ে, শেষও করব ওই সফরেরই আরেকটি ঘটনা দিয়ে। কেন্টের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচের পিচ ও আউটফিল্ড ভেজা থাকায় ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এদিকে গ্যালারিভর্তি দর্শক খেলা দেখতে না পেয়ে যারপরনাই হতাশ। কেন্টের অধিনায়ক কলিন কাউড্রে ব্লান্ডকে অনুরোধ করলেন দর্শকদের বিনোদনের জন্য কিছু একটা করে দেখাতে। শেষমেশ ব্লান্ড সিদ্ধান্ত নিলেন একটা ছোটখাটো ফিল্ডিং শো করবেন।

ফিল্ডিং শো বলতে আসলে ‘রান, পিকআপ অ্যান্ড থ্রো’-এর প্রদর্শনী। অফিশিয়াল ব্রডকাস্টার বিবিসি সেটা লাইভ ধারণ করেছিল। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ১৫ বারের প্রচেষ্টায় ১২ বারই সফলভাবে স্টাম্পে হিট করতে পেরেছিলেন গোল্ডেন ঈগল!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...