সোনালী দিনের শেষ স্মৃতি

যারা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সোনালী যুগ দেখেছেন তার মধ্যে তিনি একজন। বিশ্বকাপে তিলকারত্নে দিলশানের সাথে আছে সর্বোচ্চ রানের জুটি, ওপেনিংয়ে সর্বোচ্চ রানের জুটিতেও আছে তাঁর নাম। লঙ্কান ক্রিকেটের সুন্দর সময় যেমন দেখেছেন, তেমনি শেষ বেলায় এসে দেখেছেন ভয়াবহ দুর্দিন। আর সেই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েই ইতি টানলেন ক্যারিয়ারের।

প্রতিভা কিংবা সামর্থ্য থাকলেও তার পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। টেস্ট কিংবা টি-টোয়েন্টিতে নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে না পারলেও ওয়ানডেতে লংকানদের জার্সি গায়ে সাক্ষী হয়েছে অনেক বড় বড় জয়ের। আপদকালীন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেলেও অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন যাচ্ছেতাই। ক্যারিয়ারে লংকান ক্রিকেটের জন্য তার সামর্থ্যের কতটুকু দিতে পেরেছেন সেটা এবার দেখা যাক।

পুরো নাম ওয়ারুশাবিথানা উপুল থারাঙ্গা। জন্ম ১৯৮৫ সালের দুই ফেব্রুয়ারি। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির বাঁ-হাতি ‘উপালা’র অভিষেক হয় ভয়াবহ সেই সুনামির পর, ২০০৫ সালের দুই ফেব্রুয়ারি, ওয়ানডে ম্যাচে লঙ্কানদের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একই বছর ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় তার। বছর না যেতেই ২০০৬ সালের ১৫ জুন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় টি-টোয়েন্টিতেও।

ওয়ানডেতে বিপুল সংখ্যক ম্যাচে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ালেও টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টিতে তিনি ছিলেন উপেক্ষিত! অবশ্য তার পারফর্মেন্সেই  বলে দেয় কেনো তিনি এই দুই ফর্মেটের দলে তেমন সুযোগ পাননি। ৩১ টেস্টে ৩২ এর কাছাকাছি গড়ে করেছেন মাত্র ১৭৫৪ রান! আছে তিনটি শতক ও আটটি অর্ধশতক। ২৬ টি-টোয়েন্টিতে ১৬ গড়ে মাত্র ৪০৭ রান করেন থারাঙ্গা! নেই কোনো শতক কিংবা অর্ধশতক। টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যানই বলে দেয় এই দুই ফরম্যাটের ক্রিকেটে তিনি কেনো ছিলেন উপেক্ষিত।

সনাথ জয়সুরিয়া, দিলশান, সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনদের ভীড়ে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে সেসময়ে সুযোগ করতে পারেননি বলা চলে। তবে জয়সুরিয়ার অবসরের পর ওয়ানডেতে  তিনি ছিলেন দলের অন্যতম পরিচিত মুখ। ২৩৫ ওয়ানডেতে ৩৪ এর কাছাকাছি গড়ে করেছেন ৬৯৫১ রান। আছে ১৫টি শতক ও ৩৭টি অর্ধশতক। তার পরিসংখ্যানই বলে দেয় ওয়ানডেতে লঙ্কানদের জন্য তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা অস্ত্র।

১৫ বছরের দীর্ঘ ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি দেখেছেন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের উথান এবং পতন! ২০০৬ সালে থারাঙ্গার অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশ করে শ্রীলঙ্কা। ৫ ম্যাচের সিরিজে ৩০০ এর অধিক রান করেন থারাঙ্গা৷ সিরিজে শেষ ম্যাচে লিডসে সনাথ জয়সুরিয়ার সাথে করা ২৮৬ রানের জুটি আজ পর্যন্ত ওয়ানডেতে ওপেনিংয়ে সর্বোচ্চ রানের জুটি! ১০২ বলে ১০৯ রানের দূর্দান্ত ইনিংস খেলে সেদিন ইংলিশদের ধবলধোলাইয়ে বড় অবদানই রেখেছিলেন তিনি।

২০০৭ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি মাত্র অর্ধশতক ছাড়া ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন ব্যর্থ। একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও বাজে ফর্মের পর বাদ পড়েন দল থেকে। তবে পরের বিশ্বকাপ ২০১১ সালেই তিনি আবারো ব্যাট হাতে ফেরেন ছন্দে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডিলশানের সাথে গড়া ২৮২ রানের জুটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ এবং ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের জুটি!

রিকি পন্টিংয়ের পর থারাঙ্গা বিশ্বের ২য় ক্রিকেটার যিনি কিনা ওয়ানডেতে ৭ বার ২০০+ রানের জুটি গড়েছেন। ২০১৩ সালে ভারতের বিপক্ষে তার করা ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৭৪ রানের ইনিংসটি ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার হয়ে ২য় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান! ১৮৯ রান করে থারাঙ্গার উপরে আছেন সনাথ জয়সুরিয়া। এই ইনিংসে খেলার পথেই ৯ম লংকান ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ৫০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। দ্রুততম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ৪০০০ রানের রেকর্ডটি তারই দখলে।

ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে দুরন্ত হলেও অধিনায়ক হিসেবে থারাঙ্গা ছিলেন যাচ্ছেতাই! ২০১৬ সালে এঞ্জেলো ম্যাথিউসের ইনজুরিতে দায়িত্ব পান অধিনায়কত্বের। তিনি ছিলেন লঙ্কান ক্রিকেটে ১৯তম ওয়ানডে অধিনায়ক। নিজের প্রথম ম্যাচেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ও পান তিনি। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেই প্রোটিয়াদের বিপক্ষে তার অধীনে লংকানদের ৫-০ তে ধবলধোলাইয়ের মাধ্যমে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ধাক্কা পান তিনি! শুধু আফ্রিকা নয় ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষেও তার অধীনে হোয়াইটওয়াশ হয় লঙ্কানরা।

এরপর অবশ্য দীনেশ চান্দিমালের ইনজুরিতে ২০১৭ সালে টি-টোয়েন্টিতেই অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। লঙ্কানদের নবম টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নেতৃত্ব দেন তিনি। তার অধীনের অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজে জয় পায় লংকানরা। ২০১৭ সালের মার্চে বাংলাদেশের বিপক্ষে থারাঙ্গা খেলেন নিজের ২০০ তম ওয়ানডে ম্যাচ! সে ম্যাচে অর্ধশতক করলেও বৃষ্টিতে ভেস্তে যায় ম্যাচের ফলাফল।

অধিনায়ক হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার স্লো ওভাররেটের কারণে জরিমানার সাথে  নিষিদ্ধ হয়েছেন বেশ কয়েক ম্যাচেই! ২০১৭ সালের নভেম্বরে উপুল থারাঙ্গাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে দায়িত্ব দেয়া হয় থিসারা পেরেরাকে। উপুল থারাঙ্গার অধিনায়কত্বে ২০১৭ সালে তিন সিরিজে ধবলধোলাই হয় লঙ্কানরা।

প্রথম লংকান ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট বিশ্বের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ওপেনিংয়ে নেমে শেষ পর্যন্ত নট আউট থাকা একমাত্র খেলোয়াড় হলেন উপুল থারাঙ্গা!

খেলোয়াড়ি জীবনে বিতর্কও ছুঁয়ে গেছে তাঁকে।

নিষিদ্ধ ঔষধ সেবনের ফলে অভিযোগ ওঠে থারাঙ্গার বিপক্ষে তবে তিনি  তা জানতেন না এবং অনিচ্ছকৃত ঘটনা প্রমাণ করায় সামান্য শাস্তিস্বরুপ নয় মে ২০১১ থেকে আট আগস্ট ২০১১ পর্যন্ত আইসিসির এন্টি ডোপিং ইউনিট থারাঙ্গাকে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয়।

নিজ দেশের ঘরোয়া লীগ ছাড়াও থারাঙ্গা খেলেছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএলে)। ২০১৭ আসরে সিলেট সিক্সার্স ও ১৮-১৯ আসরে তিনি খেলেন ঢাকা ডাইনামাইটসের হয়ে। সর্বশেষ  ২০১৭ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট, ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অংশ নেন থারাঙ্গা৷ এরপর আর শ্রীলঙ্কার হয়ে জাতীয় দলে ডাক পাননি এই ৩৬ বছর বয়সী বাঁহাতি ওপেনার। 

থারাঙ্গা ছিলেন জয়াসুরিয়ার ‍উত্তরসুরী। মাতারা হারিকেনের রেখে যাওয়া জায়গায় তিনি খেলেছেন ধারাবাহিক ভাবে। তবে, তিনি নিজে জয়াসুরিয়া হতে পারেননি, এমনকি বিদায় বেলায়ও নিজের মানের কাউকে রেখে যেতে পারেননি। এটাই লঙ্কান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সংকট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link