জীবনে একবার অন্তত ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকেই। কেউ কেউ হয়ত ক্রিকেটের প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়িও নিয়েছেন হয়ত একটা সময়ে। বাংলাদেশের অধিকাংশ কোচই আপনাকে নিশ্চয়ই বলেছে একজন বাঁ-হাতি স্পিনার হতে।
সেটাই যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংস্কৃতি। তেমন এক সংস্কৃতি থেকে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস ক’জনই বা দেখায়! কিন্তু রিশাদ হোসেন সেই সাহস দেখিয়েছেন। আর সেই সাহসের পুরষ্কার তিনি পেতে শুরু করেছেন। তবে আদৌ কি তার যাত্রা এতটাই সহজ ছিল?
বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিরদিনের আক্ষেপ একজন লেগস্পিনার। সেই আক্ষেপকে দীর্ঘায়িত করবার দায় অবশ্য ঘরোয়া ক্রিকেটের। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দলগুলো বড্ড বেশি সেকেলে ভাবনায় দিনাতিপাত করতেই পছন্দ করে।
ক্লাবগুলো টিকে থাকার লড়াই করেই সন্তুষ্ট থাকতে চায়। ঝুঁকি নিতে চায় না। নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চায় না। তাইতো রিশাদদের উঠে আসার রাস্তাটা হয় বন্ধুর। নিজেদেরকে প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে অবলোকন করে যেতে হয় সূর্যের ওঠা-নামা।
নীলফামারি থেকে উঠে এসেছেন রিশাদ হোসেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট কাঠামোর কেন্দ্র থেকে অনেকটাই দূরে তাঁর জেলা। ১২ বয়স থেকেই ক্রিকেটের পথে যাত্রা শুরু। সেই শুরু থেকেই তিনি লেগ স্পিনার হবেন বলেই ঠিক করেছিলেন। জীবনের প্রথম বলটা তিনি করেছিলেন লেগ স্পিন গ্রিপেই।
বাঁ-হাতি স্পিনার হওয়ার সংস্কৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি এক ঝুঁকিপূর্ণ স্বপ্নই দেখেছিলেন। স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করবার মত ধৈর্য আর একাগ্রতা সকলের থাকে না। রিশাদ সেদিক থেকে ব্যতিক্রম।
রিশাদ আরও বিভিন্ন দিক থেকেও ভিন্ন। স্কুল ক্রিকেট থেকে জেলা পর্যায়ের খেলার রাস্তাটা মোটামুটি সহজই ছিল। নিজ স্কুলের হয়ে বল হাতে চমকই দেখিয়েছিলেন। এরপর জেলা দল ও বিভাগীয় দলেও খেলার সুযোগ মিলেছিল তাঁর।
ততদিনেও অবশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট কেন্দ্রের নজর কাড়তে পারেননি। রবি আয়োজিত স্পিনার হান্ট থেকে নজরে আসেন রিশাদ। টেলিকম প্রতিষ্ঠান ‘রবি’ একসময় নিয়ম করে ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম চালিয়েছিল। তেমন এক প্রোগ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন বাগেরহাটের রুবেল হোসেন।
সেই স্পিনার হান্টে রিশাদের উচ্চতা আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রায় ৬.৩ ফুট লম্বা লেগ স্পিনার যে বিরল। তখনও অবশ্য রিশাদের উপর কেউ ভরসা করেনি। অবশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট কখনোই খুব বেশি লেগ স্পিনারদের উপর আস্থা রাখেনি।
দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে মোটে দুইজন সত্যিকার অর্থেই লেগি খেলেছেন রিশাদের আগমনের আগে। এক ওয়াহিদুল গণির পর জুবায়ের হোসেন লিখন। তবে কারও ক্যারিয়ারই খুব বেশি লম্বা হয়নি।
তাঁর কারণ ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরবার পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া। সেই একই পথের পথিক হতে চলেছিলেন রিশাদ হোসেন। তবে তিনি তো কিছু করে দেখাবার ব্রত নিয়েছিলেন। তাছাড়া কোচ চান্ডিকা হাতুরুসিংহের শুরু থেকেই লেগ স্পিনারদের প্রীতি রয়েছে।
তাঁর আমলেই তো জুবায়ের লিখনের অভিষেক ঘটেছিল। সেই ধারায় রিশাদকেও জাতীয় দলের জার্সি তুলে দেওয়া হয়। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের অভিষেক সিরিজে বড্ড সাদামাটা ছিলেন রিশাদ। সবাই ভেবেই নিয়েছিল তিনি হবেন আরও একটি ‘লস প্রজেক্ট’।
নিজেকে ঝালাই করে নেওয়ার, সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ বাংলাদেশের ক্রিকেট সার্কিটের কোন লেগ স্পিনার পাননা। একই দশা ছিল রিশাদেরও। তিনিও ডাগআউটে বসে দিনাতিপাত করেছেন লম্বা সময়। দেশীয় ক্লাবগুলো ইকোনমিক্যাল বাঁ-হাতি অফ স্পিনার খেলাবে নির্দ্বিধায়।
তবুও আক্রমণাত্মক লেগ স্পিনারকে একাদশে সুযোগ দেওয়া যেন ঘোরতর অপরাধ। তাতে করে ক্লাবের দায়ও তাকে। যদিও অধিকাংশ সময় কোচের উপর দায় চাপিয়ে নিস্তার পেতে চেয়েছে সকলে।
রিশাদ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তবেই তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তবে সেটাও নিজ ক্লাবের হয়ে নয়। চ্যাম্পিয়ন আবাহনী তাকে ধারা খেলতে পাঠায় শাইন পুকুর ক্রিকেটে ক্লাবে।
সদ্য শেষ হওয়ার ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে বল হাতে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন রিশাদ। শাইন পুকুরকে প্রথমবারের মত ডিপিএলের সুপার লিগে তোলেন তিনি। তবুও রিশাদকে নিয়ে যতটা চর্চা হওয়ার ছিল। তা হয়নি।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রে বিপক্ষে সিরিজে তিনিই ছিলেন অত্যন্ত ইকোনমিকাল বোলার। বাকিদের দুর্দিনেও তিনি ছড়িয়েছেন উজ্জ্বল আলো। ক্রমশ রিশাদ পরিণত হওয়ার পথে হাঁটছেন। প্রতিদিন শেখার দিন। রিশাদও শিখছেন। আন্তর্জাতিক সার্কিটে পারফর্ম করে শিখছেন তিনি।
তবে সে জন্যে নির্ভীক হতে হচ্ছে তাকে। একটা বৈরি সংস্কৃতি পেরিয়ে তিনি পদার্পণ করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সেই যাত্রাটা সহসাই শেষ হয়ে যাক সেটা তিনি প্রত্যাশা করেন না বোধহয়। তাইতো বিশাল সব ছক্কা হাঁকাতেও দ্বিধা করেন না।
ঠিক এ কারণেই রিশাদ হতে পারেন বাংলাদেশের বিশাল বড় এক সম্পদ। লোয়ার অর্ডারে রান করবার মত খেলোয়াড়ের ছিল বড্ড অভাব। সেই অভাবটা অনায়াসে পূরণ করতে পারবেন রিশাদ হোসেন। সেই সক্ষমতা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮ বলে ৪৮ রানের ইনিংসটি যে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে দ্রুততম ৪০ রানের ইনিংস।
তাছাড়া দিন যত গড়াচ্ছে রিশাদের বোলিংয়ের ধার বাড়ছে। বোলিংয়ে বৈচিত্র আগে থেকেই ছিল তার। সময়ের সাথে তীক্ষ্মতা বাড়ছে ডানহাতি এই লেগির। তার উচ্চতাও বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে তাকে। কেবল তার উপর আরেকটু বেশি ভরসা করা প্রয়োজন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাকে বল হাতে বাইশ গজে নিয়ে আসা হতে পারে আস্থার প্রতীক।
কেননা এখন অবধি ডেথ ওভারে রিশাদকে ব্যবহার করছে না বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। সে জায়গা আরও একটু পরিপক্ক হওয়া প্রয়োজন রিশাদের। কেবল তবেই রিশাদ হয়ে উঠতেন পারবেন আস্থাভাজন গেম চেঞ্জার। ভরসার প্রতিদান দিতে শুরু করেছেন তিনি। আরেকটু আস্থা তাকে বানাতে পারে অপ্রতিরোধ্য।
এখনও রিশাদের অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি। এখনও তার অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া বাকি। একেবারেই ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই রয়েছেন। অন্তত প্রতিকূল সংস্কৃতির স্রোতে হারিয়ে যাবেন না রিশাদ, সেটাই প্রত্যাশা সকলের।