ইতিহাসের সবচেয়ে একতরফা বিশ্বকাপ ফাইনাল

সেবার ইমরান খানের দেখানো পথেই হাঁটছিল ওয়াসিম আকরামরা। ১৯৯২ সালে ইমরান খান প্রথম বিশ্বাসটা করতে শিখিয়েছিলেন যে পাকিস্তান বিশ্বজয় করতে পারে। ওয়াসিম আকরামের নেতৃত্বে মইন খান, শহীদ আফ্রিদি, সাঈদ আনোয়াররা সেই বিশ্বাস বুকে গেঁথেই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন। তবে বিশ্বজয়ের শেষ সিঁড়িটায় পাকিস্তানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সোনালি প্রজন্ম।

এশিয়ার ক্রিকেটে তখন জয়জয়কার। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারত ইতোমধ্যেই বিশ্বক্রিকেটে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে। এরপর ১৯৯২ সালে ইমরান খান জানান দিলেন পাকিস্তানের শক্তিমত্বা। পরের বিশ্বকাপেই পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে অর্জুনা রানাতুঙ্গার বিশ্বকাপ জয় করে ফেললেন। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার এই তিন দল তখন বিশ্বক্রিকেটে রীতিমত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই তিনদলে প্রতিনিধি হিসেবেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছালো ‘দ্য আনপ্রেডিক্টেবল’ পাকিস্তান।

ফাইনালে তাঁদের মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়ার সোনালি প্রজন্মের সবচেয়ে রঙিন দিনগুলো। স্টিভ ওয়াহ’র নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া তখন ভয় ডর বিহীন এক দল। মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং, ড্যারেন লেহম্যান, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, টম মুডি, শেন ওয়ার্নদের সেই দলের মুখোমুখি হওয়াটাও এক দু:সাহস।

তবে, পাকিস্তানেও তখন তারকার ছড়াছড়ি। সাঈদ আনোয়ার, আব্দুল রাজ্জাক, ইজাজ আহমেদ, ইনজামামুল হক ও তরুণ শহীদ আফ্রিদিদের নিয়ে গড়া ব্যাটিং লাইন আপ। এছাড়া বোলিং এ ওয়াসিম আকরাম এর নেতৃত্বে ছিলেন শোয়েব আখতাম ও সাকলাইন মুশতাকরা।

ক্রিকেট তো গর্বিত অনিশ্চয়তার খেলা। কত বিস্ময়কর সব ঘটনাই না ঘটে ওই বাইশ গজে। তারপর মাঠে যদি থাকে পাকিস্তান তাহলে তো সে বিস্ময়ে যোগ হয় এক ভিন্ন মাত্রা। হ্যাঁ, বিস্ময়ের চূড়ান্ত মাত্রাই দেখিয়েছিল সেদিন পাকিস্তান। পুরো বিশ্বকাপে যাদের ব্যাটে চড়ে ফাইনালে উঠেছিল পাকিস্তান সেই ব্যাটিং লাইন আপ ভেঙে পড়লো তাসের ঘরের মত।

শুরুটা করেছিলেন গ্ল্যান ম্যাকগ্রা। মাত্র ১ রানেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ওপেনার ওয়াজাহানতুল্লা ওয়াসটিকে। এরপরই ফ্লেমিং ফেরান সাঈদ আনোয়ারকে। টপ অর্ডারের ব্যর্থতায় দলের হাল ধরতে চেয়েছিলেন আব্দুল রাজ্জাক ও ইজাজ আহমেদ।

তবে টম মুডি ১৭ রানে আব্দুল রাজ্জাক ও শেন ওয়ার্ন ২২ রানে ইজাজ আহমেদকে ফেরালে চাপে পড়ে পাকিস্তান। তখন পাকিস্তানের শেষ আসা ইনজামামুল হক। তবে ইনজামাম ও ফিরে যান ১৫ রান করেই। মাত্র ১০৪ রানেই ছয় উইকেট হারিয়ে দিশেহারা হয় এশিয়ার এই পাওয়ার হাউজ।

৩৯ ওভার শেষে মাত্র ১৩২ রানেই অল আউট হয়ে যায় পাকিস্তান। শেন ওয়ার্ন ৩৩ রান দিয়ে নিয়েছিলেন চার উইকেট। তারমধ্যে ইজাজ আহমেদ, মঈন খান ও শাহীদ আফ্রিদির উইকেটও ছিল। লর্ডসে ১৩২ রানের পুঁজি নিয়ে ম্যাচ জেতাটা অসম্ভবই ছিল। তাও অজিদের সেই বিধ্বংসী ব্যাটিং লাইন আপের বিরুদ্ধে। তবুও কিছু একটা করে দেখাতে চাইছিল ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতাররা।

পাকিস্তানের সেই আশায় গুরে বালি দেয় অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ঝড়ো শুরু। তাঁর ৩৬ বলে ৫৪ রানের ইনিংসেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় পাকিস্তান। এছাড়া মার্ক ওয়াহর ৩৭ রানে ভর করে ১৭৯ বল হাতে রেখেই ৮ উইকেটের বিশাল জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে এতটা একপেশি ম্যাচ বোধহয় আর কখনো দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব।

অথচ, এই অস্ট্রেলিয়ারই সেমিফাইনাল লড়াইটা সহজ ছিল না। শেষ মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকা ‘চোক’ না করলে তো ফাইনালের টিকেটও পাওয়া হয় না স্টিভ ওয়াহর দলের।

১৯৯৯ সালে পাকিস্তানকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে এক নতুন যুগে নিয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এরপরের এক দশক ক্রিকেট বিশ্বের শুধু একটি নামই উচ্চারিত হত; অস্ট্রেলিয়া। ২০০৩ ও ২০০৭ সালেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে টানা তিনটি বিশ্বকাপ জয় করে অস্ট্রেলিয়া।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link