‘ব্যাক অ্যাগেইন টু টেক মাই প্লেস। হেয়ার টু স্টে।’ সোজা বাংলায়, ‘আবার নিজের জায়গা নেওয়ার জন্য ফিরে এসেছি।’ প্যারিস অলিম্পিক শুরুর আগে সিমোন বাইলস ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন।
যে অলিম্পিক্সের মঞ্চে জুটেছিল অপমান, সেই অলিম্পিকের মঞ্চেই আবারও ফিরলেন জিমন্যাস্টিকসের রাণী সিমোন বাইলস, সঙ্গে অদম্য জেদ আর পরিশ্রম। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
কাট ব্যাক টু ২০২১। ২০১৬ অলিম্পিকে ১৯ বছর বয়সে প্রথম অভিযানেই চারটি সোনা জেতা বাইলস, টোকিয়ো অলিম্পিকে ২৪ বছরের পূর্ণ যৌবনে পদক জিতবেন জানাই ছিলো, প্রশ্ন ছিলো কতগুলো জিতবেন?
প্রত্যাশার চাপের পাশাপাশি বাইলসকে ধাক্কা দেয় কোভিড। প্রথম বার কোনও অলিম্পিক হচ্ছিল দর্শক ছাড়া। প্রতিযোগীদের পরিবারেরও যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সামাজিক দূরত্ব মেনে উদ্বোধনী প্যারেড হয়। সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হচ্ছিল। কোনও চিৎকার নেই, উৎসাহ নেই। যেন কবরের নিস্তব্ধতা।
তার প্রভাব পড়ে বাইলসের খেলায়। অনুশীলনে কোনও রুটিন ঠিক মতো করতে পারছিলেন না। তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ল্যান্ডিংয়ের সময় শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখা, সেটাই হচ্ছিল না। বার বার পড়ে যাচ্ছিলেন। বাইলসের মুখের হাসি উধাও হয়ে গিয়েছিল।
দলগত ফাইনাল। টানা তৃতীয় বার সোনা জিততে নেমেছিলো আমেরিকা। ভল্টে বাইলসের ল্যান্ডিং ঠিক হয়নি। শূন্যে আড়াই পাক ঘোরার বদলে দেড় পাক ঘোরেন তিনি। ভল্ট শেষে যেন নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলেন না বাইলস।
তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। কিছুক্ষণের জন্য অ্যারেনা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তার পরেই জানা যায়, বাকি ফাইনালে আর খেলবেন না বাইলস। তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানান কোচ ও সতীর্থেরা। পরে নিজের ব্যক্তিগত ইভেন্ট থেকেও সরে দাঁড়ান বাইলস।
দল মেনে নিলেও সমালোচকেরা মানেননি বাইলসের যুক্তি। টোকিয়োয় নাম তুলে নেওয়ার পরে তাঁকে শুনতে হয়েছিল, পালিয়ে গিয়েছেন। খালি নিজের কথা ভেবেছেন। খারাপ পারফরম্যান্সের অজুহাত দিয়েছেন।
সামাজিক মাধ্যমে রাম, শ্যাম, যদু, মধুরা তাঁকে নিয়ে মজা করেছেন। সাবেক সতীর্থরাও সুযোগে কটুকথা বলতে ছাড়েন নি, বর্ণবাদের সবথেকে খারাপ রূপটাও দেখা হয়ে গেলো সদ্য রাজত্ব ত্যাগ করা আমেরিকান রাণীর।
বাইলসের গলার কাছে একটি ট্যাটু রয়েছে। সেখানে লেখা, ‘অ্যান্ড আই স্টিল রাইজ়।’ টোকিয়োর পরে সেই ট্যাটু করিয়েছেন তিনি। নিজেকে বুঝিয়েছেন, ফুরিয়ে যাননি। বাইলস ঠিক করে ফেলেন, ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক্সে শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। আমেরিকার ৭২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সি জিমন্যাস্ট হিসাবে এ বার নামবেন ২৭-এর বাইলস।
সেরাদের নাকি ‘সেটব্যাক’ দরকার হয়। এই ‘সেটব্যাক’ সর্বকালের সেরা হওয়ার পথের সিঁড়ি। ‘সেটব্যাক’ থেকে ফিরে লিওনেল মেসি জিতেছিলেন বিশ্বকাপ। বাইলসও প্যারিসে ডানা মেললেন। সেই একই আত্মবিশ্বাস। সেই একই দৌড়।
সেই একই ভল্ট। সেই একই ঝাঁপ। প্রতিটি ক্ষেত্রে আরও সংযোজন করেছেন বাইলস। আগে পাঁচটি রুটিন ছিল তাঁর নামে। এ বার আরও একটি রুটিন নিজের নামে করতে চাইলেন।
আসলে সেরা ও সর্বকালের সেরার মধ্যে হয়তো এটাই তফাৎ। সর্বকালের সেরারা এক জায়গায় আটকে থাকেন না। তাঁরা নিয়মিত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যান। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যান। বাইলস উড়লো, উড়লো আমেরিকা। উড়লো সকল কৃষ্ণাঙ্গ জিমন্যাস্টদের স্বপ্নের ‘উড়ান’।
কার সাধ্য থামায় তারে? দলগত স্বর্ণপদকের পরে ব্যক্তিগত ইভেন্টেও এলো স্বর্ণের ছোঁয়া। দু’হাত প্রসারিত করে, দুই পা শূণ্যে ছুড়ে সিমোন বাইলস জানিয়ে গেলেন, আই হ্যাভ রাইজেন টু দ্য টপ।