জাদুকর জোলার প্যান্ডোরার বাক্স

২০০৩/০৪ মৌসুমে ইংলিশ ক্লাব চেলসি এফ.সি তাদের সর্বকালের সেরা ফুটবলার নির্বাচনের জন্য ভোটের আয়োজন করেছিল। সমর্থকদের ভোটে সেদিন সেরা ব্লুজ ফুটবলার হয়েছিলেন একজন অপরিচিত ইতালিয়ান। হ্যাঁ, অপরিচিতই বটে; জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলা নামের এই ফুটবলারের নাম কয় জনই বা শুনেছে।

২০০৩/০৪ মৌসুমে ইংলিশ ক্লাব চেলসি এফ.সি তাদের সর্বকালের সেরা ফুটবলার নির্বাচনের জন্য ভোটের আয়োজন করেছিল। সমর্থকদের ভোটে সেদিন সেরা ব্লুজ ফুটবলার হয়েছিলেন একজন অপরিচিত ইতালিয়ান। হ্যাঁ, অপরিচিতই বটে; জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলা নামের এই ফুটবলারের নাম কয়জনই বা শুনেছে।

জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলা ১৯৬৬ সালের পাঁচ জুলাই ইতালির ওলিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন। শিশু অস্থা থেকেই চামড়ার বলের সঙ্গে প্রেম সৃষ্টি হয় জোলার। তাই স্কুল পালিয়ে ফুটবল অনুশীলন করতেন তিনি। সকাল আট থেকে রাতের আটটা পর্যন্ত ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। এমনকি জোলা ফুটবল ছাড়া মজার কিছু করতে পারতেন না। তাই তিনি এই খেলাতেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে শুরু করেন। 

আরেকটু বড় হওয়ার পরেই জিয়ানফ্র্যাঙ্কোর সক্ষমতা সবার নজর কাড়ে৷ ফুটবল খেলায় এমন কিছু ছিল না যা ফ্র্যাঙ্কো করতে পারতো না। হৃদয়ের সব আবেগ-অনুভূতি দিয়েই বলকে আপন করে নিতেন এই ইতালিয়ান। মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব নুরিজে সুযোগ পান জিয়ানফ্র্যাঙ্কো। 

তিন বছর পর ১৯৮৬ সালে নুরিজ ক্লাব ছেড়ে সাসুলৌতে যোগ দেয়ার পরেই মূলত ক্যারিয়ারের মূল পর্ব শুরু হয় তাঁর। আরো তিন বছর সাসুলৌতে কাটানোর পর ২ মিলিয়ন লিরার (১৮৬১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ইতালিয়ান মুদ্রা) বিনিময়ে পার্মাতে চলে আসেন এই ফরোয়ার্ড।

দলটির হয়ে সব মিলিয়ে ১৪৯ ম্যাচ খেলে ৬৪ গোল করেছিলেন তিনি। ম্যাচপ্রতি গোলের হিসেবে পার্মাতেই সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন এই ইতালিয়ান। এছাড়া এই ক্লাবে থাকাকালীন দু’টি শিরোপা জিতেছিলেন তিনি। ১৯৯২/৯৩ মৌসুমে লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের মালিক ছিলেন এই কিংবদন্তি। 

সে বছর ট্রান্সফার মার্কেটে জোলার মূল্য ছিল ১৩ মিলিয়ন লিরা। অর্থাৎ এই তারকার দাম ৬ গুন বেড়ে গিয়েছিল। আর এটির মূল কারন তাঁর পারফরম্যান্স এবং তার দুর্দান্ত ফর্মের কারণে। আরো তিন বছর পর ক্যারিয়ারে প্রথম এবং একমাত্র বারের মত ইতালির বাইরে খেলতে এসেছিলেন জোলা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল চেলসির জার্সি গায়ে জড়ান তিনি। 

আর অন্য ক্লাবের তুলনায় চেলসিতেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন জিয়ানফ্র্যাঙ্কো। ব্লুজদের হয়েই ক্লাব ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। অর্জনের হিসেবেও তাই সবার আগে বলতে হয় ক্লাবটির কথা। এই দলটির হয়ে জোলা ৩১১ ম্যাচে ৮০ গোল করেছিলেন।

সবচেয়ে বেশি ট্রফিও জিতেছেন ইংলিশ ক্লাবটির হয়ে। দু’টি এফএ কাপ, একটি উয়েফা সুপার কাপ সহ মোট ছয়টি শিরোপা উদযাপনের স্বাদ পেয়েছিলেন জিয়ানফ্র্যাঙ্কো। এছাড়া ১৯৯৮/৯৯ এবং ২০০২/০৩ মৌসুমে চেলসির বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন তিনি। 

চেলসিকে বিদায় বলে ২০০৩ সালে আবারো ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন। ইতালিয়ান ক্লাব ক্যাগলিরি, নাপোলি, টরেস এর মত দলে খেলেছিলেন ক্যারিয়ারের বাকি অংশে। নাপোলিতে আর্জেন্টাইন জাদুকর দিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে খেলার সুযোগ হয়েছিল জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলার।

২০০৪ সালে ক্যাগলিরিকে সিরি বি থেকে সিরি এ উন্নীত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন জোলা। এর পরের বছরই দলটির হয়ে খেলা শেষে নিজের বুটজোড়া তুলে রাখেন তিনি। তাঁর সম্মানে ক্লাবের দশ নম্বর জার্সিটি সাময়িক অবসরে পাঠায় ক্যাগলিরি। সব মিলিয়ে নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারে ৭৯৬ ম্যাচ খেলে ২৩৮টি গোল দিয়েছিলেন ইতালিয়ান কিংবদন্তি।

এছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতালির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। এ সময় ৩৫ ম্যাচ খেলে ১০ গোল করেন এই ফরোয়ার্ড। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই রাউন্ডে ইতালিতে মূল পর্বের টিকিট এনে দিলেও তৎকালীন কোচ জোলাকে রাখেননি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। আর সেই অভিমানে ১৯৯৭ সালেই অবসর নিয়েছিলেন এই তারকা। 

পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পরে ম্যানেজার হয়ে ফিরেছিলেন জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলা। একজন ম্যানেজার হিসেবে জোলা ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড, ওয়াটফোর্ড, ক্যাগলিরি, আল-আরাবি, বার্মিংহাম সিটি, এবং চেলসির ক্লাবগুলো সেবা প্রদান করেছেন। অবশ্য চেলসিতে তিনি ছিলেন সহকারী কোচ। 

জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলার মূলত একজন উইঙ্গারের ভুমিকা পালন করতেন। তাই তাঁর কাজ ছিল সতীর্থদের জন্য গোলস্কোরিং সুযোগ তৈরি করা। আর এই কাজটি নিজের ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই করে গিয়েছেন তিনি। মনোমুগ্ধকর ড্রিবলিং আর স্কিল ছাড়াও, জোলা পেনাল্টি এবং ফ্রি কিক থেকে গোল করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

সিরি এ লিগের ইতিহাসে ফ্রি কিক থেকে সর্বোচ্চ গোল দাতার তালিকায় ফ্রান্সেস্কো টটি, রবার্টো বাগিও, অ্যালেসান্ড্রো ডেল পিয়ারো এবং আন্দ্রেয়া পিরোওর পিছনেই আছে বিশ গোল করা জোলা।

স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে থাকাকালীন জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলাকে ‘দ্য ম্যাজিক বক্স’ বলা হতো। পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই এই জাদুর বাক্স থেকে জাদু দেখিয়ে সম্মোহিত করেছিলেন একটি প্রজন্মকে৷ সেই সম্মোহন অবশ্য বর্তমানে নেই বললেই চলে।

তাই ডেল পিয়েরো, টট্টিদের মত তাকে নিয়ে আলোচনা করা হয় না এখন৷ তারপরও একজন কিংবদন্তি হিসেবে জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলাকে মনে রাখবে চেলসি, মনে রাখবে ইতালি। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...