দ্য কিং মাদ্রিদিস্তা

আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির মতে তিনি ছিলেন ফুটবলের চারজন রাজার একজন। তিনজনের নাম পেলে, ম্যারাডোনা এবং ক্রুইফ। বাকি একজনের নাম স্টেফানো। আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। নিকনেম ব্লন্ড অ্যারো। ববি চার্লটন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হি ইজ দ্য বেস্ট আই এভার স।’

আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির মতে তিনি ছিলেন ফুটবলের চারজন রাজার একজন। তিনজনের নাম পেলে, ম্যারাডোনা এবং ক্রুইফ।

বাকি একজনের নাম স্টেফানো। আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। নিকনেম ব্লন্ড অ্যারো। ববি চার্লটন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হি ইজ দ্য বেস্ট আই এভার স।’

জন্মসূত্রে ছিলেন আর্জেন্টাইন। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন দেশীয় ক্লাব রিভারপ্লেটে। সেখানে থাকার সময়ই জেতেন ক্যারিয়ারের একমাত্র আন্তর্জাতিক শিরোপা ১৯৪৭’র কোপা। রিভারপ্লেট থেকে কলম্বিয়ার ক্লাব মিলোনারিওস ঘুরে যখন বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে আসেন মাদ্রিদের তখন দু:সময়। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের পরে প্রায় ১৫ বছর কেটে গেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তাঁরা। এমনই সময় ডি স্টেফানো আসলেন। যে রিয়াল মাদ্রিদ আগের ২০ বছর একবারও লা লিগা জিতেনি ডি স্টেফানো যোগ দেবার পর তাঁরাই পরের ১১ বছরে জিতল ৮ লা লীগা আর টানা ৫বার চ্যাম্পিয়নস লিগ। সঞ্জীবনী সুধা কি একেই বলে!

রিয়ালের হয়ে ৩৯৬ ম্যাচে করলেন ৩০৮ গোল। জিতলেন ১৯৫৭ এবং ১৯৫৯ সালের ব্যালন ডি’অরসহ অসংখ্য ব্যক্তিগত পুরষ্কার। ১৯৬৪ সালে ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে যোগ দেন বার্সেলোনার নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিওলে। সেখানে ৩ মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে ১১ গোল বুঝিয়ে দেয় বয়স থাবা বসিয়েছে ভালোভাবেই। ১৯৬৬ সালে সকল ধরণের ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হলেও পরে স্পেনের নাগরিকত্ব নিয়ে খেলেছেন স্পেনের হয়েও। ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি জাতীয় দলেও দুর্দান্ত ফর্ম ছিল তাঁর। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে খেলেছেন কলম্বিয়ার হয়ে। আর্জেন্টিনার হয়ে ৬ ম্যাচে ৬ গোল, স্পেনের হয়ে ৩১ ম্যাচে ২৩ গোল এবং কলম্বিয়ার হয়ে ৬ ম্যাচে ৬ গোলই বলে দিচ্ছে শুধু ক্লাব ফুটবলেই না, জাতীয় দলেও আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর নামের পাশে ১৯৪৭ এর কোপা আমেরিকা ছাড়াও থাকতে পারতো আরও অনেক শিরোপা।

তবে, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১৫ টি শিরোপা জেতা ডি স্টেফানোর হয়তো এসব নিয়ে আক্ষেপ ছিল না। আক্ষেপ থাকতে পারতো অন্য একটা বিষয়ে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার যে কখনোই বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি। প্রতিবারই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিছু না কিছু। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আর্জেন্টিনা ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণই করেনি। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা অংশ নিলেও বিস্ময়করভাবে স্কোয়াডে ছিলেন না ডি স্টেফানো।

ততদিনে রিয়াল মাদ্রিদে খেলতে থাকলেও স্পেনের নাগরিকত্ব না পাওয়ায় বাদ যায় এই বিশ্বকাপও। সেরা সুযোগ হতে পারতো ১৯৫৮’র বিশ্বকাপ। কিন্তু কুবালা-ডি স্টেফানো-জেন্টোর স্পেন স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে বাদ পড়ে বাছাইপর্বেই। ডি স্টেফানো প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে যান ১৯৬২ সালে, চিলিতে। কিন্তু স্পাইনাল ইনজুরির কারণে এক মিনিটও খেলতে পারেননি তিনি। বিশ্বকাপ থেকে যায় তাঁর জন্য এক মরীচিকার নাম।

হায় বিশ্বকাপ!

ফুটবল মিশে ছিল তাঁর রক্তে। তাইতো ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরে বেশীদিন বসে থাকতে পারেননি। পরের বছরই যোগ দেন কোচিঙে। কোচিং করিয়েছেন বোকা জুনিয়র্স, রিভারপ্লেট, ভ্যালেন্সিয়া, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবকে। খেলোয়াড়ি জীবনের মতো সফল ছিলেন কোচিঙেও। বোকা জুনিয়র্স, রিভারপ্লেট, ভ্যালেন্সিয়াকে লীগ শিরোপা জিতিয়েছেন। তবে এর মধ্যে ভ্যালেন্সিয়ার কথা বলতেই হবে আলাদা করে। ১৯৪৬-১৯৪৭ মৌসুমের ২৪ বছর পরে ভ্যালেন্সিয়া আবার লিগ জেতে ১৯৭০-৭১ মৌসুমে, ডি স্টেফানোর হাত ধরে।

রিয়ালকেও দুবার প্রায় চ্যাম্পিয়ন বানিয়েই ফেলছিলেন তিনি। বাধা হয়ে দাঁড়ায় অ্যাটলেটিকো বিলবাও। একবার ১ পয়েন্ট, আরেকবার গোল ব্যবধানে রিয়ালকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয় তাঁরা। পরে আরও একবার রিয়ালের কোচ হলেও সেবার ভাগ্য তাঁকে ফিরিয়ে দেয় খালি হাতে।

ডি স্টেফানো সম্পর্কে গুজব আছে যে তিনি বার্সেলোনার হয়ে খেলতে চাইলেও একনায়ক ফ্রাংকোর হুমকির মুখে শেষ পর্যন্ত যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে। ফ্রাঙ্কো নাকি স্টেফানোকে বলেছিলেন, ‘না (বার্সেলোনা নয়), তুমি খেলবে রিয়াল মাদ্রিদে।’

গুজবটা সত্যি নয়। আসল ঘটনা হলো এরকম।

১৯৪৭ সালে আর্জেন্টাইন লিগে রিভারপ্লেটের সর্বোচ্চ গোলদাতা আলফ্রেডো ডি স্টেফানো অভ্যন্তরীণ ধর্মঘট এবং ক্লাবের সাথে সম্পর্কের অবনতির কারণে কলম্বিয়া চলে যান এবং সেখানকার মিলোনারিওস ক্লাবের সাথে চুক্তি করেন। কিন্তু সে বছর কলম্বিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে বিভক্তি শুরু হয়। ফিফা মিলোনারিওসের সাথে স্টেফানোর চুক্তি সমর্থন করেনি।

পরবর্তীতে প্যাক্ট অফ লিমা সমঝোতায় ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্টেফানোর অধিকারস্বত্ব মিলোনারিওস নিয়ে নেয় এবং এর পরদিন থেকে স্টেফানোর স্বত্ব রিভারপ্লেটের কাছে চলে যাবে।

লক্ষ্য করুন, ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্টেফানো মিলোনারিওসের খেলোয়াড়। ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্টেফানো আবার রিভারপ্লেটের খেলোয়াড় হয়ে যাবেন।

এর মধ্যে কলম্বিয়া ফুটবলের অচলাবস্থা চলতে থাকলে স্টেফানো হতাশ হয়ে ১৯৫২ সালে আর্জেন্টিনা চলে যান। পরের বছর তিনি সেখানেই কাটান। এর মধ্যে মিলোনারিওসের সাথে রিয়াল

মাদ্রিদের এক প্রীতি ম্যাচে স্টেফানোর দিকে চোখ পড়ে মাদ্রিদের। কিন্তু প্যাক্ট অফ লিমার কারণে তারা অগ্রসর হয়নি।

অন্যদিকে দূর্দান্ত ফর্মে থাকা বার্সেলোনার মূল কান্ডারি কুবালা ১৯৫৩ সালে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হন। কুবালার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে স্টেফানোকে পছন্দ করেন বার্সেলোনা সভাপতি এনরিকে মাত্রি। বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ তখন স্টেফানোর প্রাক্তন ক্লাব রিভারপ্লেটের সাথে চুক্তি করে যদিও তখন স্টেফানোর অধিকারস্বত্ব রিভারপ্লেটের কাছে ছিল না।

লক্ষ্য করুন আবার, স্টেফানোর অধিকারস্বত্ব রিভারপ্লেটের কাছে ছিল না, ছিল মিলোনারিওসের কাছে। তা সত্ত্বেও রিভারপ্লেট চুক্তি করে বার্সেলোনার সঙ্গে। এ যেন অনেকটা ‘অন্যের জমি, বিক্রি করি আমি’ টাইপের ব্যাপার।

এই চুক্তি মোতাবেক স্টেফানো ১৯৫৫ সাল থেকে বার্সেলোনায় খেলার কথা। ডি স্টেফানো বার্সেলোনায় খেলার জন্য ১৯৫৩ সালের ২৩ মে বার্সেলোনায় চলে আসেন। এরপর দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় মিলোনারিওস। যেহেতু ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্টেফানোর অধিকার তাদের দখলে ছিল, তারা বার্সেলোনা সভাপতির কাছে ২৭০০০ ডলার দাবি করে।

কিন্তু, বার্সেলোনা সভাপতি তা প্রত্যাখ্যান করে স্টেফানোকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত না খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই অচলাবস্থায় সামনে এগিয়ে আসে রিয়াল মাদ্রিদ। মিলোনারিওসকে তারা সেই ২৭০০০ ডলার দিয়ে দেয়। এরপর তারা রিভারপ্লেটের কাছে যায়। কিন্তু রিভারপ্লেট বার্সেলোনার সাথে চুক্তি করে ফেলায় তারা রিয়ালকে ফিরিয়ে দেয়।

এদিকে বার্সেলোনায় স্টেফানোর ভালো লাগছিল না কারণ তিনি কোনও ম্যাচ খেলতে পারছিলেন না এবং বার্সেলোনা তাঁকে কোনও বেতনও দিচ্ছিল না। এই সুযোগে রিয়াল মাদ্রিদ বার্সেলোনায় গিয়ে স্টেফানোর সাথে কথা বলে তাকে মাদ্রিদের পক্ষ থেকে অগ্রীম বেতন প্রদান করে। পরের সপ্তাহে স্টেফানোর অধিকারভোগী মিলোনারিওসের সাথে রিয়াল মাদ্রিদের আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত স্টেফানো রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড় হয়ে যান।

এমনবস্থায় ফিফা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, বার্সেলোনা- রিয়াল মাদ্রিদ একমত না হলে স্টেফানো খেলার লাইসেন্স পাবেন না। এর মধ্যে বার্সেলোনা রিভারপ্লেটের সাথে করা চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নেয় যাতে রিভারপ্লেট রাজি হয়নি। ফিফার নির্দেশে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন।

তাঁদের উদ্যোগে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা সভাপতিদ্বয় প্রত্যেকে দুই মৌসুম করে ডি স্টেফানোকে খেলানোর চুক্তিতে সই করেন। কিন্তু এই চুক্তি করায় বার্সেলোনা সভাপতির উপর বেজায় ক্ষেপে যায় বার্সেলোনা বোর্ড ও সমর্থকরা। এর জের ধরে পরের সপ্তাহে পদত্যাগ করেন বার্সেলোনা সভাপতি। বার্সেলোনা সরে আসে স্টেফানোর দুই ক্লাবে খেলার চুক্তি থেকে। রিয়াল মাদ্রিদেই খেলতে থাকেন স্টেফানো।

মিলোনারিওস খেলোয়াড়স্বত্ব বাবদ যে টাকাটা বার্সেলোনার কাছে দাবি করেছিল,সেটা যদি বার্সেলোনা দিয়ে দিত তাহলেই স্টেফানো বার্সেলোনার খেলোয়াড় হয়ে যেতেন। তা না করে বার্সেলোনা রিভারপ্লেটের সাথে চুক্তি করেই থেমে গিয়েছিল।

অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদ মিলোনারিওসকে টাকা পরিশোধ করেছিল, রিভারপ্লেটের সাথে সমঝোতা করেছিল এবং স্টেফানোকে কনভিন্সও করতে পেরেছিল। সত্যি কথা হলো, রিয়াল মাদ্রিদের চূড়ান্ত ব্যবসায়িক দক্ষতাই স্টেফানো কে বার্নাব্যু তে নিয়ে এসেছিল।

কাজেই, একনায়ক ফ্রাঙ্কোর নির্দেশে ডি স্টেফানো বার্সেলোনার বদলে রিয়ালে খেলা শুরু করেছিলেন এই গুজব সর্বৈব মিথ্যা।

এত বড় লেখাটা শেষ করব ডি স্টেফানোর বিখ্যাত একটা উক্তি দিয়ে। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘হোয়াট ইজ রিয়াল মাদ্রিদ?’ তাঁর উত্তর ছিল, ‘ইট ইজ জাস্ট আ ফিলিং।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...