অধিকারীর অধিকার

বাবা-মা নাম রাখেন হেমচন্দ্র রামাচন্দ্র অধিকারী। পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে ওঠেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেমু অধিকারি। আবার ভারতের ক্রিকেটে তিনি শুধুই আদরের হেমু। ওদিকে একবার ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল হারি-কারি। যে যেই নামেই ডাকুক তিনি সবার আপন, কাছের।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেমু অধিকারী ভারতের ক্রিকেটের খুব কাছের মানুষ। অবাক হচ্ছেন? সবাইকে অবাক করেই সীমান্তে অস্ত্র হাতে যতটা সতর্ক থাকতেন ঠিক ততটাই সতর্ক কাভার পয়েন্টে। একটা বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে এসে আবার নেমে পড়েছিলেন বাইশ গজে ব্যাট হাতে লড়বেন বলে। ক্রিকেটার হিসেবে নিজের পুরোটা দেয়ার পরেও ভারতের ক্রিকেটকে দিয়ে গিয়েছেন নানা উপলক্ষে। তিনি তো ভারতের ক্রিকেটের সবচেয়ে কাছের মানুষই বটে।

১৯১৯ সালের ৩১ জুলাই ভারতের পুনে শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা-মা নাম রাখেন হেমচন্দ্র রামাচন্দ্র অধিকারূ। পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে ওঠেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেমু অধিকারি। আবার ভারতের ক্রিকেটে তিনি শুধুই আদরের হেমু। ওদিকে একবার ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল হারি-কারি। যে যেই নামেই ডাকুক তিনি সবার আপন, কাছের।

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই গুজরাটের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। ১৯৩৬-৩৭ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে নিজের প্রথম ম্যাচে খেলেন দলের সর্বোচ্চ ৩০ ও ২৬ রানের ইনিংস। দ্রুতই ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে পরিচয় করান। তবে এর মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধা হয়ে আসে হেমু ও ক্রিকেটের মাঝে।

১৯৪৫-৪৬ মৌসুমে আবার ফিরে আসেন আপন রূপে। সেই বছর বারোডার হয়ে ব্যাট হাতে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। রঞ্জি ট্রফিতে ৬৯.৩৭ গড়ে করেছিলেন ৫৫৫ রান। তাঁর ব্যাটে চড়েই প্রথমবারের মত রঞ্জির ফাইনাল খেলে বরোদা। তবে সেই সময় ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ ছিল দারুণ শক্তিশালী। ফলে তাঁর অসাধারণ এই ফর্ম থাকা সত্ত্বেও সে বছর ইংল্যান্ড সফরের দলে ডাক পাননি এই ক্রিকেটার। তবে ১৯৪৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে জন্য দলে ডাক পান তিনি।

ভারতের হয়ে হেমু অধিকারীর প্রথম সিরিজটা খুব একটা সুখকর ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫ টেস্টে মাত্র ১৭.৩৩ গড়ে করেছিলেন ১৫৬ রান। তবে অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং এর বিরুদ্ধে ভয় ডরহীন ক্রিকেট খেলে নির্বাচকদের মুগ্ধ করেছিলেন ঠিকই। সেই বছরই ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার অব দ্য ইয়্যার নির্বাচিত হন তিনি।

তবে ভারতের সবচেয়ে কঠিন দিনে নিজের সেরাটা দেখান এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার। দিল্লীতে আগে ব্যাট করে ৬৩১ রানের বিশাল পাহাড় গড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে ২৪৯ রানেই পাঁচ উইকেট পড়ে গেলে ইনিংস হারের শঙ্কায় পড়ে ভারত। সেই সময় সাত নম্বরে ব্যাট করতে আসেন হেমু অধিকারী।

খেলেন ১১৪ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র সেই সেঞ্চুরিতেই ম্যাচ ড্র করেছিল ভারত। সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এটাই কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর।

আবার ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে ১৮০ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। সেই সময়ে ৮১ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস খেলেন তিনি। দশম উইকেট জুটিতে গোলাম আহমেদের সাথে যোগ করেন ১০৯ রান।

৫০ বছরেরও বেশি সময় এটিই ছিল দশম উইকেটে ভারতের সর্বোচ্চ জুটি। এরপর ঢাকায় ২০০৪-০৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে শচীন টেন্ডুলকার ও জহির খান দশম উইকেটে ১৩৩ রান যোগ করেন। তবে এমন একটি ইনিংস খেলার পর ভারতের হয়ে আর মাত্র ৩ টি টেস্ট খেলেছিলেন তিনি।

ফিল্ডার হিসেবেও হিমু অধিকারি ছিলেন সেরাদের সেরা। বিশেষ করে কাভার পয়েন্টে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোদ্ধ। ওখান থেকে মোটামুটি সবগুলো বল তিনি সরাসরি স্ট্যাম্পে থ্রো করতে পারতেন। তিনি ভারতের প্রথম বিশ্বমানের ফিল্ডার।

১৯৫২ সালে ইংল্যান্ড সফরে কাভারে বল খেলে ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা রান নেয়ারই চেষ্টা করতেন না। কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল হারি-কারি। হারি-কারি একটি আত্মহত্যা প্রথা। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে খুব প্রচলিত ছিল। আর পয়েন্টে হিমুর কাছে বল পাঠানো মানে তো আত্মহত্যা করার মতই।

ওদিকে হিমু অধিকারির লেগ স্পিনটাও একেবারে খারাপ ছিল না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৯ টি উইকেটও নিয়েছেন। ওদিকে ঘরোয়া ক্রিকেটে সেই সময় ব্যাটিং দৈত্য ছিলেন তিনি। ১৫২ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে প্রায় দশ হাজারের মত রান। ১৭ টি সেঞ্চুরিসহ রান করে গেছেন ৪১.৭৪ গড়ে। ভারতের হয়ে খেলা ২১ টেস্টেও একটি সেঞ্চুরি সহ আছে ৮৭২ রান। সাত নম্বর পজিশনে ভারতের অন্যতম সেরাদের একজন ছিলেন তিনি। এছাড়া ১৯৫৯ সালে ভারতের অধিনায়কও হয়েছিলেন তিনি।

সেনা জীবন ও ক্রিকেটীয় জীবন শেষেও দীর্ঘদিন ভারতের ক্রিকেটের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি যখন ভারতের ম্যানেজার সেবারই প্রথম ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট জিতলো ভারত। এছাড়া বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরিতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় ক্রিকেটে উঠে এসেছে সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, রবি শাস্ত্রী কিংবা মহিন্দর অমরনাথের মত গ্রেটরা।

ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতি তাঁর এই নিবেদনের জন্য ১৯৯৯ সালে সিকে নায়ডু আজীবন সম্মাননা পান হেমু অধিকারি। ২০০৩ সালে ৮৪ বছর বয়সে যখন এই পৃথিবীকে বিদায় জানান তখন পুরে ভারতে পরে শোকের ছায়া। তিনি হয়তো ভারতীয় ক্রিকেটের কোনো মহাতারকা ছিলেন না তবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন ভারতের ক্রিকেটে এক ইতিহাস হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...