২০১৯ সালের কথা।
মুমিনুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ‘এ’ দল তখন শ্রীলঙ্কা সফর করছে। হাম্বানটোটায় শেষ চার দিনের ম্যাচের স্কোরকার্ড হাতে পেয়ে চমকে উঠতে হলো-মোহাম্মদ মিঠুন ২ উইকেট পেয়েছেন!
হ্যাঁ, উইকেটরক্ষক মিঠুন অফস্পিন করে দু’টি উইকেট নিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। এরপর দেশের মাটিতেও একটা টুর্নামেন্টে বেশ কিছু উইকেট নিলেন মিঠুন। তাহলে কী কিপিং ছেড়ে বোলিং শুরু করে দিচ্ছেন?
প্রশ্নটা শুনে মিঠুন সেদিন একটু ম্লান হেসেছিলেন, ‘এখন যে প্রতিযোগিতা, তাতে আমি তো কিপার হিসেবে সেরা তিনে থাকতে পারছি না। বোলিং করলে মন্দ কী? তবে আমার আসল কথা হলো, দলের জন্য যা দরকার তাই করতে তৈরী আমি। এমনকি দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে পানি টানলেও যদি দলের উপকার হয়, তাতেই আমি খুশি।’
এটাই মিঠুনের এক্স ফ্যাক্টর। এবং বলা ভালো, একমাত্র এক্স ফ্যাক্টর।
মোহাম্মদ মিঠুন সম্ভব গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হওয়া ক্রিকেটার। শুভাগত হোম, ফরহাদ রেজা, ইমরুল কায়েসকে মাথায় রেখেও বলা যায়, মিঠুন আজকাল সর্বাত্মক একটা আক্রমণের শিকার। তাকে স্যার থেকে শুরু করে আজকাল লর্ড বলে ডাকা হচ্ছে।
এখন আমাদের কাছে প্রশ্ন হলো, মিঠুন কী আসলেই লর্ড ডাকার মতো খেলোয়াড়?
টেস্টে ১৮.৫০, ওয়ানডেতে ২৮.৭৫ এবং টি-টোয়েন্টিতে ১২.২০ গড়। এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটেও তার কোনো ফরম্যাটে গড় ৩৪-এর উপরে নয়। ওয়ানডেতে ৮০.০৮ এবং টি-টোয়েন্টিতে ৯৫.৩১ স্ট্রাইকরেট।
এসব পরিসংখ্যান একেবারে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলে দেয় যে, মিঠুন আসলেই আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে মানানসই নন। তাহলে তিনি কী করে দলে থাকছেন? ২০১৪ সাল থেকে টানা তিন জন বিদেশি কোচ কী গুন দেখে মিঠুনকে দলে অপরিহার্য বলে মনে করছেন?
এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া একটু কঠিন।
মিঠুন কোনোকালেই খুব প্রতিভাধর বলে বিবেচিত ছিলেন না। কুষ্টিয়া থেকে উঠে আসা এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান প্রথম গ্রাউন্ড ব্রেক করেছেন অনুর্ধ্ব-১৯ দলের মাধ্যমে। ২০০৮ যুব বিশ্বকাপ খেলেছিলেন তিনি। সে পর্যায়েও বলার মত কোনো পারফরম্যান্স নেই। সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলা যায়, ২০০৮ সালের বাংলাদেশ যুব দলটি ছিলো এই পর্যায়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে লো প্রোফাইল দল। এই দল থেকে রুবেল হোসেন ছাড়া জাতীয় দলে এসে বলার মত কেউ কিছু করতে পারেননি। এই দলের বেশীরভাগ খেলোয়াড়ই এখন হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
মিঠুনও এদের থেকে আলাদা ছিলেন না।
তারপরও ঘরোয়া প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলে গেছেন। তার ক্ষেত্রে একমাত্র ইতিবাচক বিশেষন ছিলো – পরিশ্রমী এবং নিবেদিতপ্রাণ। যিনি দলের জন্য যে কোনো কিছু করতে তৈরি।
কিন্তু ‘তৈরি’ থাকলে তো হবে না, কিছু করে দেখাতে তো হবে। মিঠুনের অতি শুভাকাঙ্খিও মানবেন যে, মিঠুন তা করে দেখাতে কখনো পারেননি।
হ্যাঁ, ওয়ানডেতে কিছু বলার মত ইনিংস তার আছে। এই নিউজিল্যান্ডে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে টানা দুটো ফিফটি করেছিলেন, এশিয়া কাপে দু’বারে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটো ফিফটি করেছেন। এই পরিসংখ্যান সাগরে ঝিনুকের চেয়েও দুর্বল।
বিশেষ করে টেস্টে তো মিঠুন কেনো, এই প্রশ্নের জবাব হয়ই না। দেশের রেকর্ড ৮৮ প্রথম শ্রেনীর ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে টেস্ট খেলতে এসেছিলেন। ১৫ টেস্টে এখন পর্যন্ত কোনো ফিফটি নেই। তারপরও তিনি টেস্টে খেলে যাচ্ছেন।
কেনো?
এসব প্রশ্নের উত্তরে বারবারই বলা হয়, কোচরা তাকে পছন্দ করেন। এখন মিঠুন নিশ্চয়ই কোচদের উপঢৌকন দিয়ে পছন্দ করান না। নিশ্চয়ই কোচরা তার মধ্যে এমন কিছু দেখেন, যা আমরা দেখি না। বাংলাদেশে এটা নতুন কিছু নয়। জেমি সিডন্সের সময় আমরা দেখেছি তিনি এরকম কিছু ক্রিকেটারকে কী এক অলৌকিক কারণে পছন্দ করতেন। প্রায় সব কোচের এরকম দু-একজন অতি পছন্দের, রহস্যময় ক্রিকেটার থাকেন।
আর এসব ক্রিকেটার সম্পর্কে খোজ নিতে গেলে একটা ‘কমন’ গুণ জানা যায় যে, তাঁরা অত্যন্ত বাধ্য ছাত্র। কোচ যা বলেন, তাই করেন। ব্যাটিং, বোলিং, কিপিং; সবকিছুতে কোচের দেওয়া কাজ সবার চেয়ে মন দিয়ে এই ছাত্ররা শেষ করেন। এতো মনোযোগি ছাত্র তাই স্বাভাবিক ভাবেই কোচের মন জয় করে ফেলেন। ফলে পারফরম্যান্স যেমনই হোক, কোচ তাঁকে নিয়ে ঝুঁকি নিতেই থাকেন।
এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্ট এই ঝুঁকিটা নিতে থাকবেন কি না।
মিঠুন পারছেন না, এটা তাঁর দোষ নয়। হয় তিনি উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছেন না, নইলে তাঁর সক্ষমতা নেই। যেটাই হোক, ম্যানেজমেন্টকে এটা দ্রুত বুঝতে হবে। মিঠুনকে খেলিয়ে গেলে একটা জায়গা নষ্ট হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে; এসব তো আছেই। তার পাশাপাশি একটা ভালো মানুষ অযথা ট্রলের শিকার হচ্ছেন।
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, মিঠুন একটা ভালো ছেলে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এতোশত গালিগালাজ তার প্রাপ্য না। তাঁকে জোর করে যারা উচ্চতর একটা মঞ্চে তুলে দিচ্ছেন, এই দায়টা তাঁদের।
লর্ড বলতে হলে তাই ম্যানেজমেন্টকে বলুন; বেচারা মিঠুনকে নয়।