ও ক্যাপিতা!

বলের নিয়ন্ত্রন, ড্রিবলিং কিংবা প্লে-মেকিং – ওই সময়ে এত গুণ একজন ডিফেন্ডারের মধ্যে কেউ খুঁজতেও যেত না। কিন্তু, তাঁর মধ্যে সবই ছিল। তিনি সেই সব দক্ষতা নিয়েই এসেছিলেন – যা যা একজন গ্রেট ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের মধ্যে দরকার হয়। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হওয়ার পরও তিনি ফুটবলের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা গোলের মালিক।

জন্ম ১৯৪৪ সালের ১৭ জুলাই। ফ্লুমিনেন্সে যোগ দেন ১৯ বছর বয়সে। ১৯৬৫ সালে আসেন স্যান্তোসে। স্যান্তোসে আগে থেকেই ছিলেন নাসিমেন্তো পেলে। এরপর দু’জনে মিলে করেন ইতিহাস। স্যান্তোস ক্যারিয়ারে ৪৪৫ টি ম্যাচ খেলেন, করেন ৪০ টি গোল।

তিনি ছিলেন আধুনিক ফুটবলের ‘উইং ব্যাক’ পজিশনের পাইওনিয়ার। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৭ – এই সময়ে ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন ৫৭ টি ম্যাচ, করেন আট গোল। তার নাম কার্লোস আলবার্তো তোরেস। তবে, ব্রাজিল ও ফুটবল বিশ্বের কাছে তাঁর পরিচয় একটাই – ‘ও ক্যাপিতা!’ ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর জীবনাবসান হলেও আজো তিনি সমাদৃত একই ভাবে!

বয়স তখন মাত্র ২৫। মেক্সিকোতে সেবারই বিশ্বকাপে অভিষেক হয়ে গেল। বয়সে ছোট আর মাত্র পাঁচজন খেলোয়াড়ই ছিলেন ব্রাজিল দলে। ছিলেন পাপাগাইয়ো নামে খ্যাত মিডফিল্ডার জার্সন। ছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন ও দু’বারের বিশ্বকাপ জয়ী পেলে। এত তারকার ভিড়ে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পড়লেন সেই ২৫ বছর বয়সী যুবা — কার্লোস আলবার্তো তোরেস।

সে সময়ের অনুভূতিটা কেমন ছিল? ফিফা ডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বজয়ী অধিনায়ক ফিরে গিয়েছিলেন ৪৪ বছর আগে, ‘অনেকেই আমাকে অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে। তারা জানতে চায়, কিভাবে আমি পেলের অধিনায়কত্ব করতাম? আমি ও পেলে স্যান্তোসে খেলতাম। ক্লাবটিতে আমি কাটিয়েছি ১১ বছর। এর মধ্যে ১০ বছর পেলেকে পাশে পেয়েছি। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমাদের অধিনায়ক ছিলেন ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডার জিতো। জিতো অবসর নেয়ার পর ক্লাব পরিচালকরা নতুন কাউকে দায়িত্ব দেয়ার কথা ভাবছিলেন।’

তখন থেকেই একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে কার্লোস আলবার্তোর জীবন। তার ভাষায়, ‘ক্লাব একেক ম্যাচে একেকজনকে অধিনায়ক হিসেবে পরখ করে নিচ্ছিল। আমার সুযোগ আসে ১৯৬৮ সালে। মাঠে আমার সবার সাথে যোগাযোগটা ভালো ছিল। ২৩ বছর বয়সে আমি ব্রাজিলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটা দলের অধিনায়ক হবার সুযোগ পাই। এদের মধ্যে কয়েকজন আবার ছিলেন তৎকালীন বিশ্ব সেরাদের কাতারে। ছিলেন পেলে, কোতিনহো, পেপে, গিলমার ও মোউরা।’

স্যান্তোস হয়ে ১৯৬৮ সালে জাতীয় দলেও সেনাপতির পদে চলে আসেন তোরেস। বাকিটা ইতিহাস। সবচেয়ে তরুণ অধিনায়ক হিসেবে জিতে ফেললেন বিশ্বকাপ, ‘নি:সন্দেহে বলে দেয়া যায় যে, স্যান্তোসের অধিনায়ক হবার পরই আমার সেলেচাওদের আর্মব্যান্ড পরাটা নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে ব্রাজিল ইউরোপ সফরে যায়, তখনই প্রথম অধিনায়ক হই আমি। সবচেয়ে কম বয়সী অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ তুলে ধরাটাই এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত।’

নেতৃত্বের গুণেই কেবল নয়, খেলোয়াড় হিসেবেও কার্লোস আলবার্তো ছিলেন অনন্য। তাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুল ব্যাক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে একটা পরিচয়ই প্রাধান্য পায়—ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে তিনি ছিলেন পরম সম্মানের ‘ও ক্যাপিতা’।

পেলে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গিয়েছেন, ‘আমি সব সময় আমার ছেলে এডিনহোর সাথে খেলতে পছন্দ করি। এডিনহো পেশাদার গোলরক্ষক। আমি ওর বিরুদ্ধে দশটা পেনাল্টি নেই, আবার ও নিজেও আমার বিরুদ্ধে দশটা পেনাল্টি নেয়। কখনওই ও আমাকে হারাতে পারেনি। আমি জাতীয় দলের হয়ে অনেক ট্রেনিং সেশনে ছিলাম আর আমি প্রত্যেককেই হারিয়েছি। কেবল একজনই আমাকে হারাতে পেরেছিলেন—কার্লোস আলবার্তো। পেনাল্টি নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মাস্টার।’

স্যান্তোসেও পেনাল্টি নেয়ার সময় সব সময় ডাক পড়তো তোরেসের। ভাস্কো দ্য গামার বিপক্ষে ১৯৬৯ সালে মারাকানা স্টেডিয়ামে তিনি নিজে না এসে পেলেকে পেনাল্টি কিক নিতে পাঠান। কথিত আছে, ১৯ নভেম্বর পেলের করা সেই গোলটাই ছিল তার ক্যারিয়ারের হাজারতম গোল।

এক অর্থে, ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ব্রাজিলিয়ানদের জন্য ছিল অনেক পাওয়ার একটা টুর্নামেন্ট। সেমিফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয় দিয়ে মারারাকানাজোর দু:খ ভোলা, ইতালিকে ফাইনালে ৪-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মত বিশ্বকাপ জয়, চার গোল করে শেষ বিশ্বকাপটাও পেলের আলোকিত করে রাখা— এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে ব্রাজিল স্থাপন করেছিল সুন্দর ফুটবলের অপূর্ব এক নিদর্শন। ফাইনালে তার করা শেষ গোলটি কেবল ইতালির কফিনে শেষ পেড়েকটাই ঠুঁকে দেয়নি, তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা গোলদাতাদের একজন।

১৯ বছরের ক্যারিয়ারে কার্লোস আলবার্তোর স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর একটি হল সেই গোল। মেক্সিকো সিটির সেই সন্ধ্যাটা এখনও অম্লান তার স্মৃতিতে। এরপরই আসে ট্রফি তুলে ধরার সুযোগ। কার্লোস আলবার্তো একবার বলেছিলেন, ‘অধিনায়ক হিসেবে আমি ট্রফি হাতে নেই। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে চুমু খাই। খুব সম্ভবত ট্রফি তুলে ধরার আগে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আমি ট্রফিতে চুমু খাই। সেটা ছিল অসাধারণ একটা অনুভূতি। এখনও আমি যেখানেই যাই মানুষ আমাকে অভিভূত হয়ে দেখে। আমি নিশ্চিত এই ৬৯ বছরের বুড়োটার মাঝেও ওরা ২৫ বছর বয়সী অধিনায়ককে খুঁজে পায়।’

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link