চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম; টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪!
স্বাগতিক বাংলাদেশকে চমকে দিয়ে সেদিন জিতে গিয়েছিল হংকং। মুনির দারের সাহস দেখানো সে ম্যাচে ১৯ বছরের মার্ক চাপম্যানকে হয়তো আপনার মনে নেই; না থাকারই কথা। কিন্তু দুর্ধর্ষ প্রতিভাবান মার্ক চ্যাপম্যান এবার আপনাকে নিজের নাম মনে করিয়েই ছাড়বেন। সে ম্যাচের পর হংকং ক্যারিয়ারটা আর বেশি লম্বা করতে পারেননি, পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডে। সেখানেই ঘরোয়া ক্রিকেটে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন বসন্তের মৌসুমী সময়। তবে আসল লক্ষ্য তাঁর সবসময়ই ছিল জাতীয় দল! আর সেটা তিনি পেয়েছেনও!
হংকংয়ের চাপম্যান এখন নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়।
মার্ক চাপম্যান। কোন তর্ক ছাড়াই হংকং ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা প্রতিভা। জন্ম হংকংয়েই; বেড়ে ওঠাও সেখানেই। হংকংয়েরই বয়সভিত্তিক নানা দলে খেলে আলোয় আসা চ্যাপম্যানের। তবে এর আগেও নিউজিল্যান্ডের সাথে যোগসূত্র আছে চ্যাপম্যানের। মার্ক চাপম্যানের বাবার নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব আছে। সে সূত্রে তিনি ছেলেকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে অকল্যান্ডের এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। সেসময়েই ক্রিকেট ক্লাব ‘অকল্যান্ড এসেস’-এর সুনজরে পড়ে গেলে তারা দলে টেনে নেয় চাপম্যানকে। সেখানে তিনি দুই মৌসুম খেলেওছিলেন।
তবে এরপরই চ্যাপম্যানের হংকং অধ্যাইয় শুরু হয়। বাহাতি মিডল অর্ডারের এই হার্ড হিটার হংকংয়ের হয়ে মাঠে নেমেছেন দুই ওয়ানডে আর উনিশটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে। হংকং থেকে আবার নিউজিল্যান্ড যাবার আগে দুটো বিশ্বকাপও খেলেছিলেন চাপম্যান। সেখান থেকে তিনি নিউজিল্যান্ডে এসেছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে ছড়ি ঘুরিয়েছেন, দলে জায়গাও করে নিয়েছেন। গেল বছরের শুরুর দিকে ভারতের সাথে ওয়ানডে দলে ছিলেন, ছিলেন সদ্য শেষ হওয়া নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজের টি-টোয়েন্টি দলেও!
তবে হংকং ছেড়ে আসা চ্যাপম্যানকে এতটা সুযোগ যে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দিচ্ছে, সেটারও কারণ আছে। মার্ক চাপম্যান পুরোদস্তুর আধুনিক দিনের ক্রিকেটের সাথে মানানসই। ক্রিজে নেমেই উইকেটের চারপাশে যেমন শট খেলতে পারেন, তেমনই আক্রমণে গেলে নিজের ব্যাটিংয়ের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেন তিনি। এখনই অকল্যান্ডে চাপম্যানের খেলার সাথে ইয়ন মরগ্যানের খেলার তুলনা দেওয়া হচ্ছে।
বাকিটা চ্যাপম্যানের মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘আমি সবসময়ই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে চাই। নিউজিল্যান্ডের মাঠগুলো বেশ ছোট, আমি সেখানে তাই আমার স্কিল দেখাতেই বেশি পছন্দ করি। তবে ম্যাচের পরিস্থিতিও আমাকে মাথায় রাখতে হয়।’
চ্যাপম্যানের এই নিউজিল্যান্ড স্থানান্তুর প্রক্রিয়ার শুরু ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে। বলে রাখি, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যাপম্যান পড়াশোনা করেন যন্ত্রকৌশল অনুষদে। সে হিসেবে তাই সেদিকের ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ভালভাবেই জানতেন চাপম্যান। আর এরপরই তিনি হংকং দলে নিজেকে ‘আনএভেইলেবল’ ঘোষণা করে আবারও খেলতে শুরু করেন অকল্যান্ড এসেস এর হয়ে।
সেখানকার ঘুরোয়া ক্রিকেটেও চ্যাপম্যানের পারফরম্যান্স চোখে পড়ার মত। নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির শেষ আসরেও চাপম্যান রান করেছেন ৩৪.১১ গড়ে। চাপম্যানের করা ৩০৭ রানও এসেছে ১৭১.৫ স্ট্রাইক রেটে! এর মধ্যে আবার ৫৮ বলে সেঞ্চুরির এক নান্দনিক ইনিংসও আছে। টি-টোয়েন্টি ছেড়ে যদি পঞ্চাশ ওভার ধরি, সেখানেও আছে চাপম্যান চমক- ৮৬.৬৬ গড়ে ৪৩৩ রান করে তিনি হয়েছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানের মালিক!
তবে এই যাত্রা কোনভাবেই সহজ ছিল না চাপম্যানের জন্যে। সেই কঠিনেরে জয় করে চ্যাপম্যান যেদিন প্রথমবারের মত অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলতে নামলেন, স্ট্যান্ডে সেদিন খেলা দেখতে এসেছিলেন চ্যাপম্যানের বাবা, মা, বোন থেকে শুরু করে আংকেল-আন্টিও। প্রথম ম্যাচে চাপ থাকবেই, সেদিনও তা ছিল চ্যাপম্যানের জন্যে। কিন্তু চাপম্যান তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর সেদিন প্রথমবারের মত খেলছেন না। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেদিন সে চাপ উতরে গেছিলেন চ্যাপম্যান।
চ্যাপম্যানও মনে করেন হংকংয়ের খেলাটা কাজে লেগেছে তাঁর, ‘সহযোগী দেশগুলো অমানবিক চাপের মধ্যে খেলতে নামে। এটা আমাকে পরে বিভিন্ন পর্যায়ে খেলতে কাজে দিয়েছে। হংকংয়ের খেলার স্মৃতি অমূল্য।’
তবে এর চাইতেও অমূল্য অভিজ্ঞতাও কিন্তু আছে চাপম্যানের কাছে। চ্যাপম্যানের ভাষায় যেটা ৩০ হাজার দর্শকের সামনে একটা দলকে হারানো নাকি তিনি কোনদিন ভুলবেন না।
সেই মার্ক চ্যাপম্যান আবারও ডাক পেয়েছেন নিউজিল্যান্ড দলে; আবারও বাংলাদেশের বিপক্ষে! সেদিন হংকংয়ের হয়ে কঠিনকে সহজ হতে দেখেছিলেন, এবার তাঁর দায়িত্ব সহজকে সহজতর করার!