টি-টোয়েন্টি রহস্য ও বাংলাদেশের সংকট

ওয়স্ট ইন্ডিজের সাথে টেস্ট সিরিজে হারের পর নিউজিল্যান্ডে ভরাডুবি। তাছাড়া সিনিয়র ক্রিকেটারদের বোর্ড নিয়ে খোলামেলা সমালোচনা। সবমিলিয়ে বলা যায় মাঠে কিংবা মাঠের বাইরেও বাজে সময় পাড় করছে দেশের ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ক্ষেত্রে অবশ্য বাজে সময় পাড় করছে বলা যায় না। কেননা এই ফরম্যাটে ভালো সময় কী কখনো এসেছিল বাংলাদেশের। গত পাঁচ বছরে এই ফরম্যাটে জয়-হারের অনুপাত করলে বাংলাদেশ একেবারে তলানীর দল।

এদিকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের সবচেয়ে বড় আকর্ষন আইপিএল মাঠে গড়াচ্ছে আজ থেকে। এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের নিয়মিত প্রতিনিধি বলতে গেলে শুধু সাকিব আল হাসানই। মুস্তাফিজ ২০১৬ সাল থেকে খেললেও তিনি কোনো এক আসর বাদে তাঁর পারফর্মেন্সও খুব আশাজনক না। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার বেরই হচ্ছেনা।

এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের ব্যাটিং লাইন আপে কোনো বিগ হিটার নেই। তাছাড়া বোলিং লাইন আপে আমরা আজ অবধি একজন মান সম্পন্ন লেগ স্পিনার তৈরি করতে পারিনি। আমাদের কোনো রিস্ট স্পিনারও নেই যিনি তাঁর বোলিং বৈচিত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে হাঁপিয়ে তুলবেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা এই ফরম্যাট নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো পরিকল্পনাও নেই। অনেকটা ওয়ানডে ক্রিকেটের মত করেই খেলা হচ্ছে টি-টোয়েন্টিও। ফলে আমাদের আলাদা কোনো বিশেষায়িত টি-টোয়েন্টি দলও তৈরি হচ্ছেনা।

  • আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ নিয়ে কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম ইএসপিএন ক্রিকইনফো’কে বলেন, ‘আমরা ওখানে ভালো একটি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেছি এবং সেটা আমাদের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে। ওখানে দল হারতেই পারে, তবে যে মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেটাররা খেলেছে সেটা ঠিক না। আমরা মাঠের নামার আগেই হার মেনে নিয়েছি। যেহেতু সবকিছু আমাদের প্রতিকূলে তাই হারাটাই স্বাভাবিক। ক্রিকেটারদের মানসিকতাই এমন ছিল। অথচ যেহেতু এই সিরিজে তেমন কোনো আশা ছিল না কারো তাই ক্রিকেটাররা স্বাধীন ভাবে নিজেদের খেলাটা খেলতে পারতেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ঠিক সাহসী, পজিটিভ ক্রিকেট খেলার কালচারই নেই এখানে। ক্রিকেটাররা ধারাবাহিক ক্রিকেট খেলায় বেশি মনোযোগ দেন ফলে টি-টোয়েন্টি টা আর খেলা হয়না। তাছাড়া আমাদের শারীরিক গঠন ও টি-টোয়েন্টির জন্য উপযুক্ত নয়।’

বাংলাদেশের সাবেক ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জি কোচিং করানোর সময় বলেছিলেন,’ বাংলাদেশে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে। তবে তাঁদের আরো ধারাবাহিক ও বড় ইনিংস খেলতে হবে। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরের ম্যাচের জন্য দলে জায়গা নিশ্চিত হলেই ক্রিকেটাররা খুশি হয়ে যান। ৪০-৬০ রান করতে পারলেই তাঁরা খুশি। তবে এটা ক্রিকেটের জন্য ঠিক নয়। এই মানসিকতা সত্যিই দ্রুত পরিবর্তন হওয়া দরকার।

  • বিপিএলের ভূমিকা কী?

বিপিএলের সাতটা আসর হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ক্রিকেটার তৈরি করতে পারেনি এই টুর্নামেন্ট। কেননা এখানে ফ্র্যাঞ্চাইজি গুলো বিদেশি ক্রিকেটারদের উপরই বেশি ভরসা করে। ম্যাচের গুরুত্ত্বপূর্ন সময় গুলোতে তাঁদের হাতেই বল বা ব্যাট তুলে দেয়া হয়। ফলে এখানকার ক্রিকেটাররা কঠিন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়ে জাতীয় দলে আসতে পারছেন না।

বিপিএল নিয়ে ফাহিম বলেন, ‘এখানে ম্যাচের ক্রাইসিস মোমেন্ট গুলোতে বাইরের ক্রিকেটারদের উপরই ভরসা রাখা হয়। ফলে লোকাল ক্রিকেটাররা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগই পাচ্ছেন না। আসলে লোকাল ক্রিকেটারের উন্নতি করানোর সুযোগ বা চেষ্টা কোনোটাই ফ্র্যাঞ্চাইজি গুলোর থাকেনা। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তিন চারদিন অনুশীলন করা হয়। বিদেশ থেকে একজন কোচ আসেন এবং তাঁর সাথে সেলফি তুলতে তুলতেই সময় কেটে যায়।’

  • ব্যতিক্রমী দুই-একজন

আন্তর্জাতিক বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার শুধু সাকিব ও মুস্তাফিজ। তাঁরা দুজনই এবার আইপিএলে খেলছেন। সাকিব এই টুর্নামেন্টে খেলছেন ২০১১ সাল থেকে। কলকাতার হয়ে দুইবার শিরোপাও জিতেছেন তিনি। এছাড়া সব ধরনের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মিলিয়ে তিনি এখন বিশ্বে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এবং ঝুলিতে ৫ হাজারের বেশি রান ও ৩৫০ উইকেট আছে এমন দুইজন ক্রিকেটারের একজন তিনি।

মুস্তাফিজ ও ২০১৬ আইপিএলে শিরোপা জিতেছেন সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে। ওই আসরে তিনি ইমার্জিং প্লেয়ারের পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। এবছর তিনি খেলছেন রাজস্থান রয়েলস এর হয়ে।

এছাড়া আইপিএলে আব্দুর রাজ্জাক, মোহম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মর্তুজারাও খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০১২ সালে পুনে তামিমকে কিনলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর।

  • আঁধার শেষে আলোর দেখা

সবমিলিয়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের অবস্থা বেশ করুণ। আশা জাগানীয়া কোনো পারফর্মারও নেই দলে। তবে পাইপলাইনের কিছু ক্রিকেটারকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে বাংলাদেশ দল। গতবছর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে পারভেজ ইমনের ব্যাটিং ছিল প্রশংসনীয়।

ইমন বাদেও যুব বিশ্বকাপ জয়ী দলের শরিফুল ইসলাম, মকিদুল ইসলামরাও হতে পারেন ভবিষ্যতের কান্ডারি। শরিফুল নিউজিল্যান্ডেও বেশ ভালো বোলিং করেছেন। যুব বিশ্বকাপ জয়ী দলের আরেক ব্যাটসম্যান শামীম পাটোয়ারি হতে পারেন দেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিগ থিং। ৬-৭ নম্বর পজিশনে আমরা যেই বিগ হিটার খুজছি সেই জায়গায় আসতে পারেন এই পাওয়ার হিটার।

ফলে এই তরুণ ক্রিকেটারকে নিয়ে আলাদা করে টি-টোয়েন্টির জন্য পরিকল্পনা করা দরকার খুব দ্রত। সর্বোপরি যাদের পরিকল্পনায় রাখা হবে তাঁদেরকে নিজের মত করে খেলার স্বাধীনতাও দিতে হবে। কেননা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রয়োজন একটি ভয়-ডরহীর ,তরুণ দল।

– ইএসপিএন ক্রিকইনফো ছায়া অবলম্বনে

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link