ওয়ানডে ক্রিকেটের যাত্রা ১৯৭১ সালে। এরপর থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একের পর এক বিপ্লব এসেছে। সময়ের সাথে সাথে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য বাড়তে শুরু করেছে। এর ফলেই ওয়ানডে আগে যেসব কল্পনাতেও ভাবা যেত না, সেই সব রেকর্ড হয়েছে।
ওয়ানডে ক্রিকেট শুরু হবার পর থেকে দশকের পর দশক ধরে ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য বাড়তে শুরু করে। টি-টোয়েন্টির এই যুগে এসে তো ক্রিকেটটাই ব্যাটসম্যানময় হয়ে উঠেছে।
তবে, দেশের বাইরে রান করা সব সময়ই কঠিন। তবে, কেউ কেউ সেই কঠিন কাজটাকেও বেশ সহজ করে ফেলেছেন। দেশের বাইরে বিরুদ্ধ পরিবেশে ওয়ানডেতে তাঁরা খেলতে পেরেছেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস।
- ক্রিস গেইল – ২১৫ (প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, ক্যানবেরা)
‘ইউনিভার্স বস’ নামে খ্যাত ক্রিস গেইল। তিনি সারা বিশ্বের সকল ফ্রাঞ্চাইজি লিগে খেলে বেড়ান। এরপরেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের নামের পাশে অনেক রেকর্ড রেখেছেন তিনি।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিশতক হাঁকানো প্রথম ক্রিকেটার তিনি। এই রেকর্ড তিনি করেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে। ঘরের মাঠের বাইরে যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস এটি। এই ইনিংস খেলার জন্য মারলন স্যামুয়েলসের সাথে গড়ে তোলেন ৩৭২ রানের জুটি। এই ইনিংসে ১০ টি চার এবং ১৬ টি ছক্কা হাঁকান তিনি।
- ফখর জামান – ২১০ (প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, বুলাওয়ে)
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা ২১০ রান, ঘরের বাইরে যে কোনো ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান। ফখর জামান ক্যারিয়ার সেরা এই ইনিংস খেলেন জিম্বাবুয়ের বুলাওয়েতে। এই ম্যাচের আগেই সিরিজ নিশ্চিত করে রেখেছিলো পাকিস্তান।
আনুষ্ঠানিকতার এই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে দলে ছিল না কোনো মানসম্পন্ন বোলার, তবুও ওয়ানডে ক্রিকেটের এই দ্বিশতক এক বিশেষ ইনিংস। সেঞ্চুরি করার পর ফখর তাঁর খেলার ধরনে পরিবর্তন আনেন। এই সময়ে তিনি বেশ মারকুটে ভঙ্গিতে খেলা শুরু করেন। তবে তিনি বাজে কোনো শট খেলেননি। ৪২ তম ওভারে হ্যামিল্টন মাসাকাদজার বলে ইমাম উল হকের আউট হবার আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেট জুটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান যোগ করেন তাঁরা।
সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ রানের ইনিংসকে টপকে পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড নিজের করে নেন ফখর জামান। এখানে ফখর জামান এবং সাঈদ আনোয়ার এই দুই জনের দুই ইনিংসের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো দুই জনই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান।
- সাঈদ আনোয়ার – ১৯৪ (প্রতিপক্ষ ভারত, চেন্নাই)
সীমিত ওভারে ক্রিকেটের পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ফখর জামান। তিনি তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ১৯৪ রান করেন ভারতের বিপক্ষে চেন্নাইয়ে। এই ম্যাচে তিনি ভাঙ্গেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডসের রেকর্ড।
সাঈদ আনোয়ারের আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান ছিল ১৮৯। যা এসেছিলো ভিভ রিচার্ডসের ব্যাট থেকে।
এই ম্যাচে ১৯ তম ওভারে ইনজুরির শিকার হন সাঈদ আনোয়ার। এই সময়ে তাঁর রানার হিসেবে মাঠে আসেন শহীদ আফ্রিদি। ম্যাচের বাকি অংশে রানার হিসেবে মাঠে ছিলেন শহীদ আফ্রিদি। এই ম্যাচে সাঈদ আনোয়ার ২২ টি চার এবং ছয়টি ছক্কা হাঁকান। এই ম্যাচে ১১৮ রান করেছিলেন শহীদ আফ্রিদির মাধ্যমে। এই ম্যাচে তাঁর সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছিলেন অনিল কুম্বলে। কুম্বলের ওভারের টানা তিন বলে তিনটা ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন।
- ফখর জামান – ১৯৩ (প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গ)
অন্যসব ইনিংসের থেকে এই ইনিংসটি একটু ব্যতিক্রম কারণ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে এই ইনিংস খেলা হয়েছে।
বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়েছিল ফখর জামান। কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রম হয়ে ক্রিজে টিকে ছিলেন ফখর জামান। তিনি এই ম্যাচে খেলেন ১৯৩ রানের এক বিশাল ইনিংস। কিন্তু দলকে জেতাতে পারেননি। যদিও তাঁর আউট হওয়া বিশাল বিতর্ক আছে।
দক্ষিণ দূর্দান্ত পেস আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম অর্ধশতক করতে খেলে ফেলেন ৭০ বল। এর পর মাত্র ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করেন তিনি। এরপর তিনি বেশ মারকুটে ব্যাটিং করে আগাতে থাকেন। এক সময় মনে হয়েছিল রান তাড়া করতে নেমে প্রথম দ্বিশতক টা সম্ভবত করেই ফেলবেন।
কিন্তু ভাগ্য দেবতা সম্ভবত তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। কুইন্টন ডি ককের এক চাতুরতার শিকার হয়ে ১৯৩ রানে রান আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন তিনি। আর ফলাফল হিসেবে পাকিস্তানও ম্যাচ থেকে ছিটকে যায়।
- ভিভ রিচার্ডস – ১৮৯* (প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ম্যানচেস্টার)
ভিভ রিচার্ডসের এই ইনিংস ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এই ম্যাচটি ছিলো ৫৫ ওভারে একটি ম্যাচ। রান করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর জন্য এই ইনিংসকে ছোট করে দেখার কোনো বিষয় নেই।
কারণ বর্তমান যুগের ছোট বাউন্ডারির বদলে এই ইনিংস ছিল বড় বাউন্ডারির মাঠে। এছাড়াও তিনি যখন মাঠে ছিলেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল দুই উইকেটে ১১ রান।
এদিন ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এক প্রান্ত আগলে রেখে মাঠে ছিলেন তিনি। এক সময় ১৬৬ রানে নবম উইকেটের পতন ঘটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। এ অবস্থা থেকে দলের স্কোর বোর্ডে ১০০ রান যোগ করেন তিনি।
- মার্টিন গাপটিল – ১৮৯* (প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, সাউদহ্যাম্পটন)
২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে ইংল্যান্ড সফরে আসে নিউজিল্যান্ড। এই সিরিজের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮৯ রানের এই ইনিংস খেলেন তিনি। এই ম্যাচের শুরু থেকেই বেশ বিধ্বংসী-ভাবে খেলতে শুরু করেন মার্টিন গাপটিল। কিন্তু খারাপ বলগুলোকে বেশ ভালো ভাবেই খেলেছিলেন তিনি।
১১১ বলে নিজের সেঞ্চুরি পূরণ করেন তিনি। এই ম্যাচে গাপটিল দুর্দান্ত সব শট খেলেন। পুরো মাঠ জুড়ে গ্যাপ বের করে খেলেন তিনি। জেড ডার্নব্যাচকে টানা চার বলে চারটি চার মেরে ইনিংস শেষ করেন তিনি।
- সনাথ জয়াসুরিয়া – ১৮৯ (প্রতিপক্ষ ভারত, শারজাহ)
কোকাকোলা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলো ভারত এবং শ্রীলংকা। এই ম্যাচে ১৮৯ রানের বিশাল ইনিংস খেলেছিলেন সনাথ জয়াসুরিয়া।
এই ম্যাচের শুরু থেকেই নিজের স্বরুপে খেলতে শুরু করেন তিনি। ইনিংসের ৪৮ তম ওভারে সৌরভ গাঙ্গুলির বলে আউট হবার আগে ১৬১ বলে খেলেন ১৮৯ রানের ইনিংস। এই ইনিংস খেলার পথে তিনি ২৫ বার বল সীমানার বাইরে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে ২১ টি চার এবং ৪ টি ছক্কা ছিল।
- গ্যারি কার্স্টেন – ১৮৮* (প্রতিপক্ষ সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাওয়ালপিন্ডি)
১৯৯৬ সালে বিশকাপের ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে আরব আমিরাতের বোলারদেরকে পাড়ার বোলার বানান গ্যারি কার্স্টেন।
এই ম্যাচে নিজের ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা ইনিংস খেলেন তিনি। এই ম্যাচে ১৫৯ বলে ১৮৮ রানের ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন কার্স্টেন। এই ম্যাচে ১৩ টি চার এবং ৪ টি ছক্কা হাঁকান তিনি।
- শেন ওয়াটসন – ১৮৫* (প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ, ঢাকা)
২০১১ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া। এই সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে আসে বাংলাদেশ। প্রথম দুই ম্যাচ জিতে সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
আনুষ্ঠানিকতার তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় মাত্র ২৩০ রান। এই ম্যাচে ছোট লক্ষ্য পেয়ে নিজের মত খেলতে শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার শেন ওয়াটসন। ব্যাটিংয়ে নেমে বাঁ-হাতি আর্ম স্পিনার সোহরাওয়ার্দী শুভকে টানা চার বলে চারটি ছক্কা হাঁকান তিনি। এছাড়াও তিনি অভিজ্ঞ স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকের ওভারেও একটি তিনটি ছক্কা এবং একটি চার মারেন।
এই ম্যাচে শেন ওয়াটসন মোট ১৫ টি ছয় হাঁকান। যা তখনকার সময়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড ছিল।
- সৌরভ গাঙ্গুলি – ১৮৩ (প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, টওন্টন)
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের মুখোমুখি হয়েছিলো ভারত এবং শ্রীলঙ্কা। এই ম্যাচে ক্যারিয়ার সেরা এই ইনিংস খেলেন তিনি। এই ম্যাচে ১৫৮ বলে ১৮৮ রানের এই ইনিংস খেলেন তিনি।
এই ইনিংস খেলার সময় তিনি ১৭ টি চার এবং সাত টি ছক্কা হাঁকান তিনি। এই ম্যাচে তারই সতীর্থ রাহুল দ্রাবিড়ও ১৪৫ রানের একটি ইনিংস খেলেন।
- বিরাট কোহলি – ১৮৩ (প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, ঢাকা)
২০১২ সাল। একে তো এশিয়া কাপের ম্যাচ তার ওপর সামনে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। রান তাড়া করতে নেমে ১৮৩ রানের ইনিংস খেলেন বিরাট কোহলি। জিতে যায় ভারত। ইনিংসে ছিল ২২ টি চার ও একটি ছক্কা।