‘মিয়াঁকে কাপ্তান বান‘তে বলার সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন হায়দ্রাবাদের শৈল্পিক ব্যাটসম্যান। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম কিংবা ওয়াকার ইউনস সমৃদ্ধ বোলিং লাইন আপের সামনে তৎকালীন পাকিস্তানের সবুজ পিচে দাঁড়িয়ে টেস্ট সিরিজ ড্র করে ফেরার পরেও কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তকে সরিয়ে তড়িঘড়ি মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনকে অধিনায়ক বানানোর কারনটা হয়তো রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গেই উপরে চলে গেছে, থেকে গেছেন অধিনায়ক আজহারউদ্দিন।
আজকের অধিকাংশ ক্রিকেটপ্রেমীই হয়তো জানে না, যে আজহারকে আপাত ভাবে ‘সাদামাটা’ অধিনায়ক হিসেবে ধরা হয়, ভারতের হয়ে অধিনায়ক হিসেবে সেই আজহার (৫১%) একদিনের অন্তর্জাতিকে অতি সফল মহেন্দ্র সিং ধোনির (৫৫%) থেকে মাত্র চার শতাংশ ম্যাচ কম জিতেছেন, তাও সেটা নব্বইয়ের দশকে যখন খাতায় কলমে ভারত শেষ দশ বারো বছরের মতো শক্তিশালী দল ছিল না।
তাঁর অধিনায়কত্বের সময়কালে দলে শচীন টেন্ডুলকার ও অনিল কুম্বলে ছাড়া সেই অর্থের ম্যাচ উইনার না থাকা সত্বেও এই সাফল্য যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবি করে। শচীন-কুম্বলের বাইরে কাউকে ধরলাম না কারণ অধিনায়ক হিসেবে তিনি একদম শেষ বয়সের কপিলকে পেয়েছেন যার তখন ধার অনেকটাই কমে গেছে আর সৌরভ মাত্র দেড় বছর তার অধিনায়কত্বে খেলেছেন। তা সত্বেও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বেশ কিছু বহুদলীয় ট্রফি তিনি অধিনায়ক হিসেবে তাঁর পকেটে ঢুকিয়েছেন। কিন্তু এগুলো সবই শুকনো পরিসংখ্যান।
অধিনায়ক আজহারের সব থেকে বড় সফল্য তিনি প্রথম ভারতীয় দলকে দেশের মাটিতে প্ৰকৃত অর্থে অপ্রতিরোধ্য করে তোলেন ঘূর্ণি পিচ বানিয়ে আর তাতে তিন স্পিনার লেলিয়ে দিয়ে। ফলস্বরূপ নব্বইয়ের দশকে ভারত দেশের মাটিতে একটিও টেস্ট সিরিজ হারেনি যেটা সম্ভবত: বিগত প্রায় নব্বই বছরে এই একটা দশকেই হয়েছে।
আজ যখন প্রতিযোগিতার মাঝে হঠাৎ করে নিয়ম বদলের ফলে আর সিরিজের প্রথম টেস্ট হেরে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে যাওয়া বড়সড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল তখন শাস্ত্রীর হুবুহু আজহারের নীতি প্রয়োগ করে ফাইনালের রাস্তা পরিষ্কার করার মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে যায় আজহার-ওয়াদেকার জুটি কতটা সফলনীতি প্রয়োগ করেছিলেন আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে।
এহেন অধিনায়কের জীবনে ব্যর্থতা এবং বিতর্কের ঝাঁপিও একবারে টইটম্বুর। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পরে দলে থাকা সিনিয়রদের একের পর এক বাদ দিতে থাকেন, কখনও সঙ্গত এবং কখনও অসঙ্গত কারনে। লাজুক শৈল্পিক ব্যাটসম্যানের চরিত্রে আসতে শুরু করে অহমিকার বিষবাষ্প। শুরু হয় অবজ্ঞা; নিজের পছন্দের চৌহদ্দির বাইরের যে কাউকে, হ্যাঁ সেটা মিস্টার সুনীল গাভাস্কার হলেও।
দেশের মাটিতে বিজয়রথ গড়গড়িয়ে চললেও মুখ থুবড়ে পড়ে বিদেশের মাটিতে, এমনকি তৎকালীন দূর্বল শ্রীলঙ্কার (১৯৯৩, যদিও টেস্ট সিরিজ যেতেন) কাছেও হারতে হয় তাদের মাঠে। স্বজনপোষন বা লবিবাজিকে নিজের ব্যাটিংয়ের মতই একপ্রকার শিল্পের পর্যায় নিয়ে যান; সুব্রত ব্যানার্জি, উৎপল চ্যাটার্জিরা যার প্রত্যক্ষ ভুক্তভুগী। নিজেকে সমস্ত কিছুর এতটাই উপরে ভাবতে শুরু করেন যে ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগের প্র্যাকটিস সেশনের সময় নির্ধারিত হয় তার বান্ধবীর ফ্লাইট কলকাতায় নামার সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
এই মহান খেলাটার প্রতি দেখানো এই চরম ঔদ্ধত্যর মাশুলও তাকে কড়ায় গণ্ডায় দিতে হয়। ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে ম্যাচ গড়াপেটা কাণ্ড, বিশ্বাস হারান তাঁর খুব কাছের খেলোয়াড়দের থেকেও। এক প্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েন দলের ভেতরে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিকই তাঁর বিরুদ্ধে চরম অসহযোগিতার অভিযোগ তোলেন।
পরিণতি? ভারতের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হয়ে থাকার সমস্ত মশলা থাকা সত্বেও থেকে গেলেন ম্যাচ ফিক্সিং আর চরম ঔদ্ধত্বের পাঁকে ডুবে থাকা এক সেনাপতি হয়ে। হিরো কাপ, এশিয়া কাপ, উইলস ট্রফি, ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ (ঢাকা), শরাজায় অনুষ্ঠিত একাধিক বহুদলীয় প্রতিযোগিতা এবং দেশের মাঠে টেস্টে অপরাজেয় দল তৈরির পরেও ইতিহাসে তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম কলঙ্কিত অধিনায়ক।