আশাজাগানিয়া আক্ষেপনামা

বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক ক্রিকেটার এসেছেন যারা অনেক প্রতিভা ও সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু, যে মুহূর্তে ক্রিকেটে তাঁদের সেরা ছন্দে থাকার কথা সেই সময়ে ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন। অনেক আশা জাগিয়ে জাতীয় দলে এসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নীরবে বিদায় নেওয়া ক্রিকেটারের সংখ্যা নেহায়েৎই কম নয় বাংলাদেশের ইতিহাসে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক ক্রিকেটার আছেন যারা পারফর্ম করতে না পেরে এবং ইনজুরি জনিত সমস্যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বেশ আগেই বিদায় নিয়েছেন। যদিও, তাঁদের স্কিল বা সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিল না।  বেশিরভাগ ক্রিকেটারেরে ক্ষেত্রে দেখা গেছে দলে পারফর্ম করতে না পেরে দল থেকে বাদ পড়েছেন। পরবর্তীতে জাতীয় দলে ফেরেননি। তেমন আশাজাগানিয়া আক্ষেপদের নিয়ে খেলা ৭১-এর বিশেষ এই আয়োজন।

  • আফতাব আহমেদ

আফতাব আহমেদকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হবেন বলে বিবেচনা করা হত। কিন্তু তিনি তাঁর এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারেননি।

খেলোয়াড়ি জীবনে মোহাম্মদ আশরাফুলের সাথে ভালো জুটি গড়েছিলেন তিনি। তাই তখন সবার মুখে মুখে শোনা যেত আফতাব-আশরাফুল জুটির নাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ ভয়ডর ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও মাঝে মধ্যেও মিডিয়াম পেস বোলিংও করতেন তিনি। এমনকি, বল হাতে পাঁচ উইকেট নেবারও রেকর্ড আছে তাঁর।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল ২০০৪ সালে। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১০ সালে। এই সময়ের মধ্যে এক বার আইসিএল খেলার জন্য নিষিদ্ধও হয়েছিলেন তিনি। সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে ২০১০ সালে একবার জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এরপর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান তিনি।

বাংলাদেশের জার্সিতে ১৬ টেস্ট, ৮৫ ওয়ানডে এবং ১১ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিলেন আফতাব।

  • তালহা জুবায়ের

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময়ী একজন পেসার হিসেবে বিবেচনা করা হত তাঁকে। এই জন্য মাত্র ১৬ বছর ২২৩ দিন বয়সে টেস্ট অভিষেক হয় তালহা জুবায়েরের। অভিষেক টেস্টে প্রথম স্পেলে মারভান আতাপাত্তু এবং মাহেলা জয়াবর্ধনেকে ফিরিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর আর কখনো নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি।

২০০৩ সালের বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ার প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর ২০০৪ সালে জাতীয় দলে ফিরে ছিলেন কিন্তু পারফর্ম করতে না পারায় জাতীয় দল থেকে বিদায় নিতে হয় তাঁকে।

এরপর দীর্ঘদিন ঘরোয়া লিগ খেললেও আর কখনো জাতীয় দলে ফেরা হয়নি তাঁর। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।

বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন ৬ টেস্ট এবং ৭ ওয়ানডেতে। আর শিকার করেন যথাক্রমে ১৪ এবং ৬ উইকেট।

  • হাসিবুল হোসেন শান্ত

আইসিসি ট্রফির ফাইনাল! বাংলাদেশের জয়ের জন্য দরকার এক বলে এক রান। শেষ বলে এক রান নিয়ে বাংলাদেশকে জয় এনে দিলেন একজন। তিনি হলেন, হাসিবুল হোসেন শান্ত। বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়ের নায়ক।

মাশরাফি বিন মুর্তজার অভিষেকের আগে বাংলাদেশের পেস বোলিং আক্রমণের নেতা ছিলেন হাসিবুল হোসেন শান্ত। তিনিও ইনজুরির কবলে পড়ে ক্রিকেটকে বিদায় জানান মাত্র ৩১ বছর বয়সে।

অভিষেক ম্যাচে রোশান মহানামাকে আউট করে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। এরপর আইসিসি ট্রফিতেও শিকার করেন ১১ উইকেট। এরপর জাতীয় দলে তাঁর জায়গা পাকাই ছিল। কিন্তু এক দূর্ঘটনা তাঁর ক্যারিয়ার শেষ করে দেয়।

২০০০ সালে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী ক্রিকেটার জহুর এলাহীর সাথে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে জহুর এলাহী ব্যাট দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করেন। এই ঘটনার সাথে সাথে ক্যারিয়ারে প্রভাব না পড়লেও এই ইনজুরির কারণেই মূলত ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন তিনি।

২০০৪ সালে ভারতে বিপক্ষে মাত্র ২৮ বছরে বয়সে ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি। এরপর ২০০৭ সালে এসে ৩১ বছর বয়সে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ইতি টানেন হাসিবুল হোসেন শান্ত।

তিনি জাতীয় দলের খেলেছেন ৫ টেস্ট এবং ৩২ ওয়ানডে। এই সময়ে যথাক্রমে ৬ এবং ২৯ উইকেট শিকার করেন তিনি।

  • নাফিস ইকবাল

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আফসোসের নাম নাফিস ইকবাল। অনেক সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এলেও তিন বছরের বেশি স্থায়ী হতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে বোর্ড (বিসিবি) সর্বপ্রথম যে ক্রিকেটারকে নিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি হলেন নাফিস ইকবাল। কিন্তু বিসিবির আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি তিনি।

২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক তাঁর। আর ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল নাফিস ইকবালের।

এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেশ নিয়মিতই জাতীয় দলে খেলেছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর চোখের এক ইনজুরির কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। এরপর আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি। জাতীয় দলে তাঁর জায়গা নিয়ে নেন তারই ছোটো ভাই তামিম ইকবাল।

নাফিস ইকবাল এরপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গেছেন। ২০১৮ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।

নাফিস ইকবাল জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন ১১ টেস্ট এবং ১৬ ওয়ানডে। এখানে রান করেছিলেন যথাক্রমে ৫১৮ এবং ৩০৯।

  • হান্নান সরকার

হান্নান সরকার ছিলেন টেকনিক্যাল দিক থেকে বেশি শক্তিশালী একজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ব্যাটিংয়ের ধরন না বদলানোর কারণে অনেক দ্রুতই ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যান।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করা পাঁচ হাফ সেঞ্চুরির তিনটি তিনি  করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এতেই বোঝা যায়, তিনি ব্যাটসম্যান হিসেবে কতটুকু ভালো ছিলেন। তিনি সময়ের সাথে সাথে নিজের ব্যাটিংকে পরিবর্তন করতে না পারায় নিজের ক্যারিয়ারকে দীর্ঘ করতে পারেননি তিনি।

তিনি বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ১৭ টেস্ট এবং ২০ ওয়ানডে খেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ২০০৪ সালে। এরপরেও বেশ কিছু দিন ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।

  • শাহরিয়ার নাফিস

ঘরোয়া ক্রিকেটে দূর্দান্ত পারফর্ম করে জাতীয় দলে এসেছিলেন শাহরিয়ার নাফিস। প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে এক বছরে এক হাজার রান করেন তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রথম ধারাবাহিক পারফর্ম করা শুরু করেন হাবিবুল বাশার সুমন। আর সেটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান শাহরিয়ার নাফিস।

তিনি বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নেমেছেন ২৪ টেস্ট, ৭৫ ওয়ানডে এবং এক টি-টোয়েন্টিতে। বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক তিনি। সর্বশেষ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে ২৮ বছর বয়সে। এরপর আর কখনো জাতীয় দলে দেখা যায় নাই তাঁকে। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেও ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া পরিস্থিতি তৈরি করেন। তবে আর জাতীয় দলের হয়ে আর খেলা হয়নি।

ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ২০২০ সালে। এরপর আর ঘরোয়া ক্রিকেটেও দেখা যায়নি তাঁকে। ২০২১ সালে ৩৫ বছর বয়সে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। বর্তমানে বিসিবিতে ক্রিকেট অপারেশন্স ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

  • নাজমুল হোসেন

নাজমুল হোসেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক দূর্ভাগা ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন তাঁকে। ঘরোয়া লিগে নিয়মিত পারফর্ম করার পরও জাতীয় দলে নিয়মিত সুযোগ পেতেন না তিনি।

ক্যারিয়ারে দুই টেস্ট খেলেছিলেন প্রায় সাত বছরের ব্যবধানে। পরবর্তী সাত বছরের ব্যবধানে তৃতীয় টেস্ট খেলা হয়ে ওঠেনি তাঁর। জাতীয় দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে বিবেচনা করা হত সীমিত ওভারের বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে।

বাংলাদেশের হয়ে ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় নাজমুল হোসেনের। এরপর ৮ বছরে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দুটি টেস্ট, ৩৮ ওয়ানডে এবং চার টি-টোয়েন্টি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ ম্যাচ খেলেন তিনি।  এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে খেললেও আর জাতীয় দলে ফেরা হয়নি তাঁর।

২০১৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন নাজমুল হোসেন।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link