প্রথম দিন সাক্ষাৎকার দিতে এসেছিলেন নিজের আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় থেকে।
ইউরোপিয়ান ফুটবলের বিপ্লব করে হিরোরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। কিন্তু ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই পাশার দান উল্টে গিয়েছে, হিরো হওয়া পেরেজ এখন রাতারাতি পরিণত হয়েছেন ভিলেনে। ১২ ক্লাবের মধ্যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে নয় ক্লাবই। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ এখন সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর সেটিকে সামনে রেখেই স্প্যানিশ টিভি এল লার্গুয়েরোর মুখোমুখি হয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি।
আরো পড়ুন
- ৭২ ঘন্টায় শেষ ফুটবল বিপ্লব!
- বদলে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগও!
- ‘ফুটবল ম্যাচ ছোট করার কথাও ভাবতে পারি’
- ফুটবলের চূড়ান্ত পতন নাকি নতুন উত্থান!
- দ্য সুপার লিগ: ফুটবল বিশ্ব ভেঙে যাচ্ছে যেভাবে
- সুপার লিগের ভিশন
সত্যি বলতে, আমার খুবই খারাপ লাছে। এই প্রজেক্টের পেছনে গত ৩ বছর ধরে প্রতিটা দিন নিরলস কাজ করেছি। লিগ ফরমেটে প্রভাব ফেলার প্রশ্নই আসে না। এখান থেকে প্রতি উইকএন্ডের টাকা আসে। এটা থাকতেই হবে। আমার প্রশ্ন ছিল মিড-উইক নিয়ে, চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে।
চ্যাম্পিয়নস লিগ অনেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন চ্যাম্পিয়নস লিগের আনন্দটা শুরু হয় এই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। তার আগে পর্যন্ত এর উত্তেজনাটা ঠিক আসে না। আমরা সেই উত্তেজনাটাই আনার চেষ্টা করছিলাম সুপার লিগ দিয়ে। এমন একটা ফরমেট, যে ফরমেটে ইউরোপের সব সেরা দলগুলো একে অপরের মুখোমুখি হবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, উত্তেজনাটা থাকবেই। যেখানে কোনো দলই অন্যের জন্য নিজের প্রাপ্য টাকা হারাবে না।
- ইউয়েফার বিরোধিতা
শুরু থেকে কম্পিটিশনকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে ফুটবলের ধ্বংস হিসেবে। এভাবে যখন করা হবে, তখন সত্যি বলতে জিনিসটা চলতে পারে না। যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, তারা চাইলেই এখন যেকোনোভাবে জিনিসটাকে ছড়াতে পারে এবং সেটা করেছে। তারা তাদের বড় অংকের টাকা হারাতে চায়নি। আর সেজন্য যেভাবেই পেরেছে আমাদের আবার ফেরত নিতে চেয়েছে।
সত্যি বলতে আমি এর আগে এত আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখিনি কোনো ইউয়েফা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে, পুরোটাই তাদের পরিকল্পনামতো হয়েছে। থ্রেট, ইনসাল্ট; সবকিছু আমাদেরকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছে। এমনটা যেন আমরা কাউকে মেরে ফেলেছি, ফুটবলকে গলা টিপে হত্যা করেছি যেন। ব্যাপারটা তেমন নয়।
আমরা ফুটবলে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছিলাম, ফুটবলকে নতুন করে জীবন প্রদান করার চেষ্টা করেছিলাম। সবকিছু যখন আগের মতন হয়ে রিয়েলিটিতে ফেরত আসবে, তখন মানুষজন বুঝবে কতবড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। নতুন চ্যাম্পিয়নস লিগ ক্লাবদের ধনী করবে না। এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্লাবেদের ক্ষতির পরিমাণ ২ বিলিয়নের কাছাকাছি হবে।
- সুপার লিগের বর্তমান অবস্থা
বারোজনের মধ্যে এখনও একটা চুক্তি সাক্ষরিত রয়েছে। সেই চুক্তি চাইলেই এত সহজে ভেঙে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা চাইলে আরো কয়েকটি দলকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি। তারা এখন পিছু হটছে কারণ উয়েফা তামাশা শুরু করেছে। যে জিনিসটা এখনো ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারেনি, সেটা সকলের বোধগম্য করাটাও এত সহজ কাজ নয়। আমরা যারা উপরের সারিতে আছি, তারা যদি এভাবে টাকা হারাতে থাকে, সেটা কোনোভাবেই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বরং এটা অন্য একপক্ষকে ধনী করবে যারা ফুটবল ক্লাবের সাথে যুক্তই না।
আমাদের করতে হলে এখনই কিছু করতে হবে। নইলে হবে না। তিনবছর অপেক্ষা করা অবস্থা আমাদের নেই। বড় ম্যাচ হাতে বড় পরিমান অর্থ এনে দিবে।
ফেদেরার-নাদাল ম্যাচ হলে পুরো ম্যাচ থমকে যায়, সকলে সবকিছু বন্ধ করে দেখে, টাকাও আসে। কিন্তু নাদালের সাথে র্যাংকিংয়ের ৮০ তে থাকা কারো ম্যাচ তাদের নির্দিষ্ট দর্শক বাদে কেউ দেখে না। আমরা চাইছি ফেদেরার-নাদালের মতন সব ম্যাচ সবাইকে দেখাতে।
সবাইকে মিলেই প্রজেক্ট আগাতে হবে। কেউ এখনও পেনাল্টি দেয়নি। প্রজেক্ট থেকে চলে যেতে বললেই চলে যাওয়া যায় না। দুই একজনের আগ্রহ হয়তো কম ছিল কিন্তু তারা চুক্তিপত্রে ঠিকই সাক্ষর করেছে। এখন ভয়ে পিছু হটতে চাচ্ছে।
সত্যি বলতে একটা বুদ্ধিমান ইউয়েফা প্রেসিডেন্ট চাই, যে অন্যকে অপমান করবে না। সোজা-সাপ্টা কথা এটাই। আমরা তর্ক-বিতর্ক করবো, কিন্তু একে অপরের প্রতি পারস্পরিক সম্মানটা বজায় থাকবে। অপমানজনক কথাবার্তা তো মেনে নেওয়া যায় না। অন্তত একজনকে সরাসরি অপমান করা (অ্যাগনেল্লিকে সাপ বলার বিষয়টা) একজন প্রেসিডেন্টের কোনোভাবেই শোভা পায় না।
আমি ২০ বছর ধরে এই জায়গায়তে আছি, এখন পর্যন্ত কাউকে অপমান করিনি, ভবিষ্যতে করবোও না। পারস্পরিক সম্মান দিতে না পারলে ফুটবলের মূল বিষয়টাই হারিয়ে যায়। ফুটবলের যে ইমেজ আমরা তৈরি করার চেষ্টা করেছি এত বছর ধরে, সেটা এভাবে হুট করে ধ্বসিয়ে দেওয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে কে জানে, এটাই হয়তো উদাহরণ হয়ে যাবে।
সুপার লিগের আশা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখনও তা আছে। রিয়াল, বার্সা, জুভেন্টাস আর এসি মিলান এখনও প্রজেক্টের সাথে যুক্ত। এখনও সবটা শেষ হয়ে যায়নি। আমরা অন্য কোনো ফরমেটের কথা ভাববো, নতুন কিছু আনার চেষ্টা করবো। কিন্তু সুপার লিগের আশা এখনও শেষ হয়নি।
বার্সেলোনা ছেড়ে যাবে না। আমি হোয়ান লাপোর্তাকে চিনি, তার সোশিওদেরও চিনি। তারা কোনোভাবেই এই নতুন চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য সুপার লিগ ছেড়ে দিবে না। তাদের ক্লাবের বর্তমান অবস্থায় খুব বেশি করে দরকার সুপার লিগ।
শেষদিনেও সকলে কথা বলার জন্য আগ্রহী ছিল, সকলে কথা বলার জন্য উৎসুক ছিল। কিন্তু সকলেই যেন কেমন ভয়ে ছিল, চাপে ছিল। এরকমটা এর আগে কেউ ছিল না। তারা আমাদের ভেতর থেকে ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছে। এবং পুরো পরিস্থিতি যখন ঠাণ্ডা হবে, তখনই বোঝা যাবে কে আসলে ঠিক ছিল!
- সুপার লিগ বন্ধের পেছনে
একটা ইংলিশ দল সুপার লিগ ঘোষণা করার পর থেকেই দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিল। শুরুর পরই তারা নিজেরা পিছু হটতে থাকে। পিছু হটার সময় শুধু নিজেরা নয়, বরং অন্যান্য ইংলিশ দলদের মধ্যেও ভয় ঢুকিয়ে দেয় যাতে করে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। (এ সময় দলের নাম জিজ্ঞাসা করলেও বলতে রাজি হননি তিনি)
সুপার লিগ মেগা প্রজেক্ট শুধু এক টুর্নামেন্টে সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল না। আস্তে আস্তে আমরা দল বাড়াতাম, খেলার পরিবেশ তৈরি করতাম, টুর্নামেন্টও বাড়াতাম। কিন্তু ইউয়েফা তো আমাদের কোনো কথাই শুনতে রাজি নয়। তারা তাদের অবস্থা যেরকম রয়েছে, সেরকমই রাখলে চায়। নিজেরা মনোপলি চালাতে চায়।
সুপার লিগ স্থগিত হয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে সমর্থক কিংবা বরিস জনসন নয়, বরং সংঘবদ্ধ কিছু লোক দায়ী। চেলসির মাঠের বাইরে ৪০ জনের মতন মানুষ ছিল। সেখানে কারা তাদের নিয়ে গিয়েছে সেটা আমি চাইলে দেখিয়ে দিতে পারি (লিগ কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে)। এরা ঠিক একই লোক যারা কী না কার্দিজকে বলেছে ম্যাচ শুরুর আগে এই জার্সি পরে নামতে।
সুপার লিগ বন্ধের প্রভাব:
এই সুপার লিগ আপাতত স্থগিত হয়ে যাওয়া সকলের উপর প্রভাব ফেলবে, সকলের উপর। এটা না হলে কেউই বড় কোনো খেলোয়াড় কেনার অবস্থায় থাকবে না। আমরা না, জুভেন্টাস না, ইউনাইটেড না; কেউই না। সুপার লিগ না হলে টাকার ফ্লো আসবে না, আর তাতে করে বিগ সাইনিং সব দলের জন্যই অসম্ভব হয়ে পরবে।
রিয়ালের বর্তমান অবস্থা
আমাদের দলের সার্বিক অবস্থা আগের মতই আছে। সবাইকে নিজেদের জায়গা থেকে একটা স্ট্যান্ড নিতে হবে। নইলে দল চালানো সম্ভব। সার্জিও রামোস আমার সন্তানের মতন। তাকে আমি নিজে রিয়ালের জার্সি গায়ে তুলে দিয়েছি। ২০১৫ সালে তার সাথে কন্ট্রাক্ট এতদূর এগিয়েও এনেছি। কিন্ত বর্তমান অবস্থায় কিছুটা ছাড় তো দিতেই হবে। ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে না, তবে আশা করি সে রিয়ালে থাকবে। বল এখন তার কোর্টে।
মদ্রিচের সাথে অবশ্য অনেক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল কন্ত্রাক্টের ব্যাপারে, সে স্যালারি কাট নিয়ে থাকতে চেয়েছে। আর সে কারণে মদ্রিচ-বেঞ্জেমা দুজনেই রিনিউ করেছে।
রোনালদোর রিয়ালে আসার সম্ভাবনা নেই। এখন যা শুনতে পাচ্ছেন তা সব উড়ো খবর।
মরিনহো রিয়ালের বেস তৈরি করে দিয়ে হিয়েছিল। তার সময় থেকেই নিয়মিত চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি-ফাইনালিস্ট আমরা। কিন্তু জিদান তাতে এসে শেষ প্রলেপ দিয়েছে। জিদান যতদিন চায়, রিয়ালে সে ততদিন থাকতে পারবে। তাকে কখনও সকালবেলা উঠে ভাবতে হবে না, আজকে রাত শেষে আমার চাকরিটা থাকবে তো?
২০ বছর ধরে রিয়ালে আছি, কখনও কোনোদিনও ফুটবলের বিরুদ্ধে কাজ করিনি। বরং কাজ করেছি রিয়ালের জন্য। রিয়ালে থাকা প্রত্যেকে জানে, আমি কী করেছি। রিয়ালে যখন আসি তখন রিয়াল দেনায় জর্জরিত। সেখান থেকে গ্যালাক্টিকোস বানিয়ে এখানে এসেছি। অবশ্যই ক্রেডিবিলিটি আছে। ফুটবলে পরিবর্তন হওয়া দরকার, সেটা এতদিন কাছে থেকে কাজ করি বলেই জানি। আর সেটাই করতে চলেছি আমি।