দ্য সুপার লিগ: ফুটবল বিশ্ব ভেঙে যাচ্ছে যেভাবে

এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া সকল ক্লাবের নিজেদের লিগে খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। এবং খেলোয়াড়েরা কখনও নিজদের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিয়ে ফিফা স্বীকৃত টুর্নামেন্ট অর্থাৎ বিশ্বকাপেও খেলতে পারবে না। যেহেতু এটা আগামী মৌসুম থেকে চালু হবার পরিকল্পনা, তাই এই মৌসুমের ইউরো এবং কোপা আমেরিকার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবার কথা না।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গিয়েছে কথা, আগামী মৌসুম থেকেই আয়োজন হতে চলছে দ্য সুপার লিগের। ইউরোপের হেভিওয়েট ক্লাবেরা মিলে লিগ পদ্ধতিতে মুখোমুখি হবে জমাজমাট আয়োজনের। এরমধ্যে উয়েফা, ফিফা, লিগ কমিটি থেকেও প্রশ্ন উঠেছে এই ক্লাব ফরমেটের টুর্নামেন্ট নিয়ে। যে টুর্নামেন্ট নিয়ে এতো কানাঘুষা, তার ভেতর-বাহির ঘুরে আসা যাক।

‘দ্য সুপার লিগ’ কী?

দ্যা সুপার লিগ হলো ইউরোপের হেভিওয়েট দলগুলোকে নিয়ে প্রস্তাবিত একটি সুপার লিগ। যেখানে খেলবে বর্তমান ইউরোপের সেরা ও হেভিওয়েট দলগুলো। এখন প্রশ্ন হতেই পারে, সে জন্য তো চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ইউরোপা লিগ আছেই। তবে এই লিগের প্রস্তাবনা কেন? কারণ চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপা লিগে সুযোগ পাওয়ার জন্য বেশ কিছু ক্রাইটেরিয়া পূরণ করতে হয় ক্লাবগুলোকে। চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার জন্য প্রতি মৌসুমে ক্লাবগুলোকে নিজেদের নিজস্ব লিগে শীর্ষস্থানে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে সেই বাঁধা নেই। ক্লাবের অবস্থা যাই হোক না কেন প্রতি মৌসুমেই এদের নাম স্থায়ী থাকবে।

ভাবুন তো রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, জুভেন্টাস, দুই মিলান, সিটি, ইউনাইটেড,লিভারপুলের মতন দল মুখোমুখি হচ্ছে একে অপরের। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, তাই না? একেকজনের ম্যাচ পেতে কখনও কখনও মৌসুমের পর মৌসুম অপেক্ষা করা লাগে দর্শকদের। সেখানে প্রতি মৌসুমেই তাদের দেখা পাওয়া, কম বড় নিষয় নয়। সে সব চিন্তা মাথায় রেখেই লিগের কথা এগিয়েছে ফুটবল ক্লাবগুলো।

  • ‘দ্য সুপার লিগ’-এর দল ও ফরম্যাট

আপাতত এই ফরমেটে রাজি হয়েছে মোট ১২ দল। প্রাথমিকভাবে- রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, অ্যাটলেতিকো মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল, টটেনহাম এই ১২ দল সুপার লিগের জন্য চূড়ান্ত সম্মতি জানিয়েছে। আরো তিনটি বড় নাম যুক্ত হওয়ার সম্ভাওনা দেখা দিয়েছে শেষ মুহূর্তে। রিউমার অন্যযাতী তারা হলো বায়ার্ন মিউনিখ, লাইপজিগ ও এফসি পোর্তো। সে অনুযায়ী একমাত্র ফ্রান্স থেকেই কোনো বড় দল সম্মতি জানায়নি। বলা বাহুল্য ফ্রান্স থেকেই মূলত চ্যাম্পিয়নস লিগের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

টুর্নামেন্টের ডিজাইন করা হয়েছে ২০ দলকে মাথায় নিয়ে। এর মধ্যে ১৫ টি দল হবে ‘পার্মানেন্ট মেম্বার’ অর্থাৎ এরা লিগের আজীবন সদস্য। এরা যতই খারাপ খেলুক না কেন, লিগ থেকে বাদ পরবে না। বাকি পাঁচটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে ইউরোপের বিভিন্ন লিগ থেকে। এরা অনির্দিষ্ট দল হিসেবে এই লিগে প্রবেশ করবে। প্রতি মৌসুম শেষে তাদের বদল করা হবে।

২০ দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গ্রুপের প্রতিটি দলের সাথে হোম-অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে খেলবে। অনেকটা ঘরোয়া লিগের মতন। দুই গ্রুপের সেরা চার দল মিলে আতজন সুযোগ পাবে কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখান থেকে দুই লেগের সেমি-ফাইনাল ও এক ম্যাচের ফাইনাল দিয়ে নির্ধারিত হবে টুর্নামেন্টের জয়ী দল।

  • ‘দ্য সুপার লিগ’-এর ইতিহাস

দ্যা সুপার লিগের মতন আইডিয়া নিয়ে সর্বপ্রথম কথা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে ইতালিয়ান মিডিয়া থেকে বড় বড় ক্লাবদের একত্রিত করে নতুন একটি টুর্নামেন্ট করার শোরগোল শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইউয়েফার তড়িৎ সিদ্ধান্ত আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগকে আরো ভালোভাবে ব্র্যান্ডিং করার কারণে তা চাপা পরে যায় অচিরেই। কিন্তু সেই প্রজেক্টের কথা আবার উঠে আসে ২০০৯ সালে, ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ দ্বিতীয়বারের মতন রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পর।

প্রথমবার রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব নিয়েই ফুটবলে তোলপাড় তুলেছিলেন গ্যালাক্টিকোস নিয়ে। দ্বিতীয়বার এমন আইডিয়া মাথা থেকে বের করা নতুন কিছু ছিল না। তার প্রস্তাব ছিল- ইউরোপের এলিট ক্লাবগুলো মিলে একত্রে একটা টুর্নামেন্ট খেলা, যেখানে প্রতিটা ম্যাচই হবে উত্তেজনায় ঠাঁসা। চ্যাম্পিয়নস লিগ বা নিজেদের লিগে অনেক ম্যাচের উত্তেজনা থাকে না, পানসে হয়ে যায় সেসব ম্যাচ। কিন্তু এই টুর্নামেন্টে প্রতিটি ম্যাচেই দর্শকদের আলাদা উত্তেজনা থাকবে। সাথে পয়সার ব্যাপারটা তো আছেই।

টুর্নামেন্টের প্রতি সেসময় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন অনেকেই। আর্সেন ওয়েঙ্গার, সিদর্ফের মতন লিজেন্ডরাও পক্ষে কথা বলেছিলেন। কিন্তু পেরেজের অনেক কথার চাপে পিষ্ট হয়ে যায় এই আইডিয়া। ফলে আস্তে আস্তে মানুষ ভুলেও যেতে থাকে। শেষমেশ ২০১৭ সালে রিয়ালের প্রেসিডেন্সি নির্বাচনে আবার জেতার পর কথা তুলেন পেরেজ।

কিন্তু, সেসময় ইউয়েফা থেকে তার সাথে বেশ কয়েক দফা মিটিং করা তাকে বলা হয় এ বিষয়ে আর না আগাতে। সেসময় পেরেজ কোন ডিসিশন না দিলেও ভেতরে ভেতরে ক্লাব মালিকদের সাথে আলোচনা করতে থাকেন এই টুর্নামেন্টের ব্যাপারে। ফলে কয়েকদিন আগে টানা চতুর্থবারের মতন রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই পাশার দান চালেন পেরেজ। ঘোষণা দেন দ্য সুপার কাপের।

  • ‘দ্য সুপার লিগ’-এর উদ্দেশ্য?  

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, টুর্নামেন্টের মূল উদ্দেশ্য তবে কী? কারণ চ্যাম্পিতনস লিগে নিয়মিতই বড় দলগুলোর দেখা সাক্ষাত হচ্ছে, হেভিওয়েট ম্যাচও হচ্ছে। দিনশেষে লাভের মুখ তো দেখতছে সকলেই। তবে আবার এই টুর্নামেন্টের প্রয়োজনীয়তা কী?

একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে বিষয়টা। আর্সেনাল, প্রিমিয়ার লিগের হেভিওয়েট দল। গত চার মৌসুম ধরে তাদের দেখা নেই ইউরোপের সেরা কম্পিটিশনে। কারণ? কারণ প্রিমিয়ার লিগ থেকে মাত্র চার দল সরাসরি খেলতে পারে চ্যাম্পিয়নস লিগে। অর্থাৎ যদি চার দলে না থাকো, তবেই বিশাল একটা টাকার অংক তোমাদের পকেটে ঢুকছে না। একই অবস্থা ইতালির দুই হেভিওয়েট ইন্টার আর এসি মিলানেরও।

সময়ের সাথে সাথে ইউয়েফা নিজেদের পরিধি ঠিকই বাড়িয়েছে, কিন্তু লভ্যাংশ বাড়েনি। প্রায় ১০ বছর ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রাইজমানি একই। ফলে খেলতে পারলেও পকেটে ঠিক সমান অংকের টাকা নিতে পারছে না তারা। ফলে তারা ঝুঁকে পড়ছে দ্য সুপার লিগের দিকে।

আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে বড় ক্লাবগুলোর বিশাল ফ্যানবেজ। মিলান, আর্সেনাল, ইউনাইটেড, চ্যাম্পিয়নস লিগের অনিয়মিত ক্লাবগুলোর দর্শকের অভাব নেই। ২০০৭ মিলান-ইউনাইটেড সেমিফাইনালের পর আর কখনও দেখাই হয়নি তাদের দু’দলের। সেই সুযোগ নিয়মিত করে দিবে দ্য সুপার লিগ। এর সেও ম্যাচ দেখার জন্য টিভি ব্রডকাস্টাররাও নিশ্চয় পরে থাকবে না, লুফিয়ে নিবে সেই ম্যাচগুলোড় সত্ত্ব। যে যত বেশি দিতে পারবে, তার কাছেই পৌঁছুবে সত্ত্ব। ফলে এখান থেকেও আয় বৃহদাকার।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পত্রিকার মতে শুধু মাত্র এই টুর্নামেন্টে যোগ দেওয়ার জন্যই ক্লাবেরা পাবে প্রায় ৪২৫ মিলিয়ন ডলার। প্যান্ডেমিকের পর বিভিন্ন দলের এমন অবস্থায় এই টাকা যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য করবে দলগুলোকে। শুধু তাই নয়, এই প্রজেক্ট সফল করার জন্য আমেরিকান কোম্পানি জে.পি. মরগ্যান প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেছে বলেও শোনা গিয়েছে। প্রতিটি ক্লাব শুধু টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েই পকেটে পুরতে পারবে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ইউরো। এই টুর্নামেন্ট নিশ্চিত হওয়ার আগেই আমেরিকান এক কোম্পানি ইতোমধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ইউরোর টিভি সত্ত্ব মৌখিকভাবে কিনে রেখেছে। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, খেলা হবে সর্বোপরি আর টাকার ছড়াছড়ি সব জায়গাতে।

‘দ্যা সুপার লিগ’ নিয়ে ফিফা এবং ইউয়েফার অবস্থান:

প্রথম থেকেই এই বিষয়ে ইউয়েফা ও ফিফা সম্মত হয়। কারণ এই টুর্নামেন্টের চিন্তাভাবনা এবং বাকি সকল কিছুই এসেছে ক্লাব মালিকদের মস্তিষ্ক থেকে। বিশেষত রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের মাথা থেকে। ফলে কেউই এই টুর্নামেন্টের পক্ষে নন। বরং তাদের কাছে মতে এই টুর্নামেন্ট ফুটবলের টেম্পারমেন্ট নষ্ট করবে। ফুটবলে যে অন্যরকম একটা সৌন্দর্য্য  বিদ্যমান, তাও গুঁড়িয়ে যাবে এই টুর্নামেন্টের ফলে। শুধু তাই নয়, আগ্রহী দলগুলোর দেশীয় ক্লাব, ইংলিশ এফএ, লা লিগা ও সিরি আ কমিটিও আবেদন করেছে ক্লাবগুলোকে এই টুর্নামেন্টে না যাওয়ার জন্য।

টুর্নামেন্ট বন্ধ করতে ফিফা এবং ইউয়েফা বিভিন্নরকম হুমকিও দিয়েছিল। তাতে লাভ হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত তারা মিলিত ঘোষণা দিয়েছে খেলোয়াড় ও ক্লাবগুলোর বিতুদ্ধে,

এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া দলগুলো তাদের নিজস্ব ঘরোয়া লিগ এবং কোনরকম দ্যা ও ফিফার ক্লাবকেন্দ্রিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারবে না। এই দলগুলোয় খেলা খেলোয়াররা উয়েফা এবং ফিফার কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারবে না। অর্থাৎ খেলোয়াড়দের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর হবে, সে যে অঞ্চলেরই হক না কেন!

সুতরাং এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া সকল ক্লাবেরর নিজেদের লিগে খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। এবং খেলোয়াড়েরা কখনও নিজদের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিয়ে ফিফা স্বীকৃত টুর্নামেন্ট অর্থাৎ বিশ্বকাপেও খেলতে পারবে না। যেহেতু এটা আগামী সিজন থেকে চালু হবার পরিকল্পনা, তাই এই মৌসুমের ইউরো এবং কোপা আমেরিকার ক্ষেত্রে এই ব্যান কার্যকর হবার কথা না। ২০২২ এর বিশ্বকাপ তো বটেই, সুপার লিগ শুরু হবার পর থেকে খেলোয়াড়রা আর এই সব দলের খেলোয়াড়েরা আর জাতীয় দলের জন্যে বিবেচ্য হবে না।

‘দ্যা সুপার লিগ’ ম্যানেজমেন্ট:

যদি ইউয়েফা আর ফিফা কেউই ম্যানেজমেন্ট না করে তবে লিগের দায়িত্ব নিবে কে? সে প্রশ্নের সমাধানও দিয়ে দিয়েছে তারা। এই পুরো লিগের চেয়ারপার্সন হবেন রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ, আর তার সহকারী চেয়ারপার্সন হিসেবে থাকবেন জুভেন্টাস সভাপতি আন্দ্রেয়া অ্যাগনেল্লি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সভাপতি জোয়েল গ্ল্যাজার।

দ্য সুপার লিগের মাস্টারমাইন্ড
  • শেষ কথা

যেভাবেই দেখুন না কেন, এই টুর্নামেন্টে পর থেকে ফুটবল আর আগের মরন থাকতে যাচ্ছে না। এই টুর্নামেন্ট হোক কিংবা না হোক, ফুটবলে বিশাল এক পরিবর্তন এনে দিয়ে যাবে এই জোয়ার। যেমনটা হয়েছিল আইসিএলের ক্ষেত্রে। আইসিএল ধোপে টেকেনি, কিন্তু খেলাটাকে বদলে দিয়ে গিয়েছিল। সুপার লিগ প্রেসিডেন্টের ইচ্ছে এই আগস্টেই খেলা শুরু করার। সেক্ষেত্রে আমাদের দেখা ফুটবল আর আগের মতন থাকছে না তা নিশ্চিত।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...