ভদ্রলোকের ভিড়েও অনন্য যে ভদ্রলোক

অতঃপর ক্রিকেটে চোখ আটকে থাকার মত একটা মায়াময় দুর্দান্ত দিন, শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পাবার লড়াইয়ে দুই দলের সমানে সমান টক্করে টাইয়ে নিষ্পত্তি। অবিশ্বাস্য ক্রিকেট থেকে হাস্যকর সমাপ্তি, ইংল্যান্ডের কাছে এলো লাভের গুড়, কারণ বল সীমানা ছাড়া করেছে তাঁরা একটা বেশি। এই অপ্রতুল সম্ভাবনাটুকুও সহস্র পাতার নিয়মের পুঁথিতে অন্যভাবে লেখা গেলে আমরা পেতাম এক নতুন চ্যাম্পিয়ন!

কেন উইলিয়ামসনের মিষ্টি হাসিটা মিলিয়ে গেছে যেন! না না, আমরা বেশি আবেগ দেখাতে যাচ্ছি না তাঁর জন্য, কিন্তু তাঁর দাঁড়িয়ে থাকাটা ম্রিয়মাণ লাগছিল না? মায়া লাগছিল না দেখতে?

ক্রিকেটের অভিজাত ভক্তরা অবশ্য কিউইদের এমন দশায় কষ্টই পাচ্ছিলেন। ইংল্যান্ড ওয়ানডেতে যোগ্যতম দলই ছিল, কিন্তু নিউজিল্যান্ডও যে সেদিন আরেকটু বেশি প্রাপ্য ছিল।

কেন রানার্সআপের মেডেলটা হাসিমুখেই নিলেন। সেই হাসিমুখের আড়ালে কি নিদারুণ চাপা কষ্ট লুকাচ্ছিলেন না?

‘তাঁরা বাউন্ডারির হিসেবে জিতে গেল?’ – প্রথমে ব্যাপারটা হজম করতে কষ্টই হচ্ছিল। দুদলই যে যথেষ্ট খেটেছে এ পর্যায় আসতে, একটা বাউন্ডারি কিভাবে তাদের পরিশ্রমের মূল্য দিতে পারে! আমরা তো দুবারে চেষ্টা করলাম দুই দলের মধ্যে একে অপরকে ছাপিয়ে উঠার, কিন্তু পারা গেল না। কিন্তু যাইহোক, নিয়মটা তো শুরু থেকেই ছিল, হয়ত কেউ ভাবেইনি এটা এভাবে এখানে ব্যবহার করা লাগবে!’ – বলার পর কেনের স্মিথ হাসি সবাইকে তাড়িত করল। কিন্তু তিনি স্পষ্ট বললেন, রুলস ইজ রুলস! জানুক আর নাই জানুক, সবাই সেটা টুর্নামেন্টের শুরুতেই মানার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।

কেনের ম্যাচ পরবর্তী সেই সম্মেলন সাংবাদিকদের হৃদয় বাষ্পীভূত করে দিচ্ছিল। একজন তো বলেই উঠল – ‘সবাইকেই আপনার মত ভদ্রলোক হতে হবে নাকি!’

বছরের সেরা উদ্ধৃতি দেবার আগে কেনের ট্রেডমার্ক হাসি আরেকবার দিলেন – ‘সবাইকে সবার মতই থাকতে দেয়া হচ্ছে। এই জগতের এই এক মহত্ব। তবে সবারই মৌলিক কিছু গুণও থাকা উচিত।’

এক মুহুর্ত থেমে বললেন,  ‘এটি সম্ভবত আমার সেরা উত্তর। আপনি নিজের মতই হন এবং যা ভালবাসেন তাই করুন।’

এই বিশ্বকাপ থেকে ইংল্যান্ড নিয়ে গেল কাপ, আর নিউজিল্যান্ড নিয়ে গেল পুরো হৃদয়টা।

_______________

  • লন্ডন থেকে, মুম্বাই ফিরে দেখা, ২০১১

তখন অফিসের লাঞ্চব্রেকে দক্ষিণ মুম্বাইয়ের লোয়ার পারেলের প্যালেডিয়াম মলে নিত্যদিন ঘুরে বেড়াতাম। তখন মলে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের বেশ কয়েকজন সদস্যও ঘুরাফেরা করছিলেন, বিশ্বকাপের যাদের কানাডা এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মুম্বাইতে খেলা ছিল।

আমি আর আমার বন্ধু সুরাজ তখন নিউজিল্যান্ডের পাঁড় সমর্থক। তখন আমি এক বছর আগে নিউজিল্যান্ড থেকেই ফিরেছিলাম, আর সুরাজও পাঁচ বছর পর সেই মূলকের অভিবাসী হবে।

আমরা সেদিন তাঁদের দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। ভাই নাথানের সাথে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ভিড়ের মধ্যেই হাত নাড়ছিলেন, যা সবাইকে উচ্ছ্বসিত করেছিল।  সেখানে ছিলেন শেন বন্ডও, সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে। আমি ভাবছিলাম, বন্ডের ক্যারিয়ার অমন ছোট না হলে কিউই দল তখন কতটা শক্তিশালী হত!

তারপর রস টেলর ছিলেন, যিনি ক্রমে কিউইদের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠছিলেন।

প্রায় আধা ঘন্টা পরে, কিউই ক্রিকেটাররা বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন। আমরা মলের প্রথম তলায় দাঁড়িয়ে চলন্ত সিঁড়িটাতে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমরা আমাদের হিরোদের দিকে তাকালাম। ‘মাফ করবেন’, আমরা একটি হতাশ ভারী-উচ্চারণ শুনেছিলাম।

আমার পিঠে হালকা চাপড় পড়ার আগে বুঝিনি ওটা আমাকেই বলা হচ্ছিল। ৫ফুট বা তাঁর চেয়ে কিছু বেশি উচ্চতার এক ককেশিয়ান তরুণ, মনে হচ্ছিল সদ্য কৈশোর পার করেছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে নামতে হবে নয়ত বাস মিস করবো।’

আমরা সপ্রতিভ হয়ে ক্ষমা চেয়েছি এবং পথ ছেড়ে দিলাম। তিনি কিউই দলের সাথে যোগ দেবার আগে আলাদা হয়ে পড়েছিলেন।

‘টিম বাস? এই বাচ্চাছেলেটা কিউই দলের সাথে আছে?’, সুরজ জিজ্ঞেস করল।

‘হতে পারে’, আমি বলার পর হঠাত থমকে উঠলাম, ‘ওহো সে তো কেন উইলিয়ামসন!’

আমি কি জানতাম যে কয়েক বছর পর এই খেলাটা ভালবাসার অন্যতম কারণ হবেন।

উইলিয়ামসনের তখন ২০ বছর, জাতীয় দলে ৬মাস ধরে আছেনআধা বছর ছিল। তাকে সহজেই ১৫ বছরের বালক বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। বিশ্বকাপে চার ম্যাচ খেলেছিলেন, সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হারা ম্যাচেও করেছেন ১০২ রান। অন্যদিকে তাঁর শৈশবনায়ক টেন্ডুলকার ২২ বছরের স্বপ্ন পূরণ করলেন, জিতে নিলেন অধুনা বিশ্বকাপ।

ছয় মাস পিছিয়ে গেলে এই ভারতের বিপক্ষেই উইলিয়ামসন পেয়েছিলেন অভিষেকে টেস্ট সেঞ্চুরি, এক কিশোরের জন্য এরচেয়ে ভাল শুরু আর হতে পারেনা।

_______________

বছর দু’বছর আগে, ২০০৯ সালে, আমার তেরাঙ্গা ভ্রমণে, সেখানকার এক স্কুল ক্রিকেট কোচ আমাকে বলেছিলেন যে আমাদের টেন্ডুলকার তৈরি হচ্ছে বড় মঞ্চের জন্য। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটের লোকজন জানত উইলিয়ামসন দেশের সেরা ব্যাটসম্যান হতে যাচ্ছেন।

তাঁর আলাদা হতেই হতো।

২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের নেতৃত্ব দিলেন ১৭ বছরের উইলিয়ামসন। সেমিফাইনালে হারতে হয়েছিল। কিন্তু কেনের জন্য দারুণ একটি টুর্নামেন্ট ছিল। দাড়িবিহীন বিরাট কোহলি এবং কেন উইলিয়ামসনকে ভাবা আজকে কঠিন। তবে সে ম্যাচে একে অন্যের হাতে উইকেট হারানোটা সেরা স্মৃতি হয়েই রয়ে যাবে। কিউই বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত ছিলেন, উইলিয়ামসন ক্রোকেও ছাড়িয়ে যাবে।

আমার সন্দেহ ছিল। টি-টোয়েন্টি পাওয়ার প্লেয়ারদের উত্থান ঘটাচ্ছিল। ম্যাককালাম ছিলেন তাঁদের পুরোধা। টেলর ছিলেন সেরা ফর্মে। ২১ বছরের রোহিত শর্মা স্টেডিয়ামের বাইরে বল আছড়ে ফেলেন। এরকম অনেক প্লেয়ার উঠে আসছিল।

আমি দুর্ভাবনায় ছিলাম, উইলিয়ামসন আদৌ তিন ফরম্যাটেই জায়গা পাবেন কিনা। ব্ল্যাক ক্যাপ পড়লেন, তাঁর ২০ তম জন্মদিনের দু’দিন পরে। ভারতের বিপক্ষে অভিষেকে ৯ বলে করলেন ০। ঠিক তাঁর নায়ক টেন্ডুলকারের মত, পরপর দুই শূন্য দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু।

  • ব্যাটিং দানব

উইলিয়ামসনের ধরণটা আর দশটা নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানের মতই ছিল, তবে ২০১৪ থেকে শুরু হলো তাঁর নবউত্থান, হয়ে উঠতে লাগলেন এক ব্যাটিং দানব!

সে বছর, ওয়ানডেতে ৮৭ স্ট্রাইক রেটে, ৭০ এর উপর গড় রেখে রান করেছিলেন তিনি। ১২ ইনিংস ব্যাট করে ৮ ইনিংসেই করেছিলেন ফিফটি। সেবছরই প্রথম টেস্টে ৫০ এর উপর গড় তুলেছিলেন তিনি। টি-২০তেও উইলিয়ামসন নিয়মিত জায়গা পেতে শুরু করেছিলেন সে বছর থেকেই।

আমিরাতে পাকিস্তানকে সামলানো তখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হিসেবে ধরা হচ্ছিল উপমহাদেশের বাইরের দেশগুলোর জন্য। তবে পাকিস্তান সিরিজে কেনের সাবলীল ব্যাটিং সমালোচকদের প্রশংসার তুবড়ি ছোটাল, সবাই বলতে লাগল এই বান্দা অনেক পথ পাড়ি দিতে এসেছে।

তবে আমার কাছে ভারতের কিউই সফরটা চমকপ্রদ ছিল। ওয়ানডেতে সবার চোখ ছিল কোহলি, ধোনি, গাপটিল, রোহিত, টেলরদের উপর। অথচ এদিকে উইলিয়ামসন এসে টানা পাঁচ ম্যাচে পাঁচ ফিফটি করে নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ তে সিরিজ জিতিয়ে দিল!

এটা যথেষ্ট বড় ব্যাপার ছিল কারণ এর ক’মাস আগেই ভারত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে এসেছিল। তবে উইলিয়ামসন আমার হৃদয়ে জায়গা নিয়ে নেন ২০১৪ এর শেষদিকের পাকিস্তান সিরিজে। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের ভারত, ইংল্যান্ডের মত অত মোটা বেতন নেই জাহির করে বেড়াবার।

তবু উইলিয়ামসন পেশোয়ারের মর্মান্তিক ও ভয়াবহ স্কুলে জঙ্গি আক্রমণের পর সেখানে বেশ ভাল অনুদান দেন।

স্কুল আবারো গড়ে তুলা, বইখাতা ইত্যাদি জিনিসপত্র গুছিয়ে দেয়ায় উইলিয়ামসন অবদান রাখেন। সেবারে ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর আচরণ, কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব সবাইকে মুগ্ধ করে।

  • উত্তরাধিকার তাঁকে ঘিরেই গড়ছিল

সেই মৌসুমের পরে, উইলিয়ামসন ওয়েলিংটন টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খাদ থেকে উঠে আসা দারুণ এক জয়ের ভিত্তি গড়েছিলেন। যা তাঁর সবচেয়ে সুন্দর টেস্ট ইনিংসগুলির একটা ধরা হয়। প্রথম ইনিংসে দল ১৫৬ রানে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ২৪২ রানের ইনিংসে নিউজিল্যান্ড ১৯৩ রানের স্মরণীয় জয় পায়।

এর একমাস পর অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের অন্যতম স্মরণীয় লোস্কোরিং ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হচ্ছে। উইলিয়ামসনের ছক্কা দিয়ে সে ম্যাচ শেষ করা ছিল আইকনিক মুহূর্ত। তাঁর নিজের কাছেও সেই ম্যাচজয়ী অপরাজিত ৪৫ রান খুব প্রিয়।

সেমিফাইনালে আটকে পড়ার বাঁধন খুলে কিউইরা প্রথম ফাইনালে উঠে। তীরে প্রায় উঠে আসার আগেই জয়তরী ডুবে গেল। কিন্তু সেই মৌসুম শেষে উইলিয়ামসন আমার মত এক ফ্যান পেয়েছিলেন। কোচের কথামত তিনি দ্বিতীয় টেন্ডুলকার না হয়ে উঠেননি বটে, তিনি হয়ে উঠলেন উইলিয়ামসন।

  • অধিনায়ক কেন

কেন স্কুল রাগবিতে একজন দারুণ ফ্লাই হাফ আর অন্যতম সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁকে আপনি যেমন দেখে এসেছেন, তাঁর সাথে রাগবি, বাস্কেটবল মেলাতে চাইবেন না বোধহয়। টি-টোয়েন্টিতেও একই কথা! কিন্তু এখানে মানসিক দৃঢ়তার প্রভাব আছে। আপনার আত্মবিশ্বাস আপনাকে যেকোন অজুহাত থেকে দূরে রাখবে।

তরুণ কেন উইলিয়ামস তাঁর স্কুলে অন্যতম মূল ক্রীড়ানায়ক ছিলেন। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে তার কোচ জোশ সিমস বলেছিলেন, ‘তাঁর জয়ের তৃষ্ণা ছিল প্রকট। সে যা ভালবাসত তাই করত। আমি ঠিক যা পছন্দ করতাম সে তাই ছিল। সে ক্যালকুলেটিভ ছিল। সে আবেগকে সরিয়ে ভাবত, আমি যদি এটা করি তবে ফল কি আসবে। সে সমস্যা বের করে নিজে সমাধান করত।’

একজন জেনুইন প্রবলেম সলভার। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উইলিয়ামসন সেরা ব্যক্তি সন্দেহ নেই। ম্যাককালামের কাছ থেকে নেতৃত্ব তুলে নেবার সময় এসেছিল। কিন্তু শঙ্কা ছিল, এত তাড়াতাড়ি তিনি পারবেন কিনা।

আসলে কিছু মানুষ বড়মঞ্চের জন্যই তৈরি হন, যাদের আবেগ সহজে স্পর্শ করেনা। ঠিক এই বালকের মত। কোন কিছুই যেন তাঁকে প্রভাবিত বা আলোড়িত করেনা। অভাবনীয় ভদ্রলোক। ভালভাবে জিতলে সর্বোচ্চ ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি।

হারলেও হাসি লেগেই থাকে, তবু কোথায় যেন এক বেদনা খেলা করে। খেলার জয়পরাজয় তাঁকে সতীর্থদের সাথে মজা করা কিংবা ঘুরে বেড়ানোর সময় প্রভাবিত করেনা।

তিনি মিডিয়াম্যান নন। জনহিতকর সব কাজ ক্যামেরার আড়ালে করতে ভালবাসেন। জনকোলাহল থেকে আড়ালে থাকতে ভালবাসেন। ভালবাসেন সার্ফিং। মাউন্ট মুনগনুইতে সতীর্থদের সাথে কফি খাচ্ছেন, সার্ফিং করছেন, সবকিছুই ঠিক চলছে। অধিনায়কত্বের পালাবদলটা যেন মসৃণই ছিল। তবু ম্যাককালাম এর শূন্যতা ওই দলে ছিল।

কখনো মনে হত, উইলিয়ামসন দলকে নিয়ন্তণ করতে পারছেন না, নেতৃত্বে পিছিয়ে আছেন। তবে তিনি ফলাফল আনছিলেন। ২০১২ বিশ্বকাপ, কিংবা নিউজিল্যান্ডের ভারত সফর আপনাকে বিশ্বাস করাবে তিনিই যোগ্য লোক।

পাঁচ মিলিয়নের চেয়েও কম লোকের দেশে রাগবির প্রভাবটা বেশী, ক্রিকেটের প্রতিভা সীমিত, তবু তাঁরা সারাবিশ্বে নন্দিত ক্রিকেট দিয়ে। জয়ের চেয়েও মোমেন্টাম দিয়ে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ভক্তদের আনন্দ দেয়। ভক্তদের জয় করে।

তাঁরা অন্যতম সম্মানিত দলও বলা চলে। সেই সময়টা কেনের হাত দিয়ে শুরু হয়। তাঁর নেতৃত্ব যেন পুরো দলের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে।

নিউজিল্যান্ড ২০১৯ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ভারতকে হারায়। এমন পরাজয় ভারতীয় ভক্তদের মনে দগদগে ক্ষত তৈরি করে। এই বছরের শুরুতে ভারত যখন কিউই সফরে আসে, কোহলিকে জিজ্ঞেস করা হলো, ভারত সেই হারের বোঝাপড়া করতে এল নাকি, কোহলির স্মিত হাসিতে উত্তর, ‘আপনি প্রতিশোধের কথা ভাবতে চাইলেও পারবেন না। তাঁরা ভাল মানুষ। তাঁরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দল হিসেবে আদর্শ সৃষ্টি করেছে। তাঁরা দল হিসেবেও দুর্দান্ত। আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা করি, তাঁদের বিপক্ষে ভাল খেলতে আমাদের সর্বোচ্চ দিতে হবে।’

বিরাট কোহলি এমন সফরে অধিনায়কদের উপর চাপ দিতে ভাল বাসেন, উত্তপ্ত বাক্যবাণে দুই অধিনায়ক নিয়মিত পত্রিকার শিরোনাম হন। আর এখানে এসে শিরোনাম হন, দুই অধিনায়ক অন্তরঙ্গ আড্ডা দিয়ে! কোহলি আর উইলিয়ামসন মানকে সম্মান দিতে জানেন বলেই হয়ত পারেন।

উইলিয়ামসন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) অন্যতম সেরা তারকা। ২০১৮-তে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের নেতৃত্ব ঘাড়ে এলো নিয়মিত অধিনায়ক ওয়ারনারের নিষেধাজ্ঞায়। উইলিয়ামসন দায়িত্ব নিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করেন। ছিলেন সেই আসরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। ১৪২ এরও বেশি স্ট্রাইক রেটে ৭৪২ রান করে দলকে ফাইনালে তুলেন তিনি।

ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস ট্রফি জিতেছিল, উইলিয়ামসন রিক্তহস্তে ফিরলেন কিন্তু জিতলেন কোটি কোটি ভারতীয় ভক্তের হৃদয়। ফিরি ২০১৯ এর ১৪ জুলাইয়ে। উইলিয়ামসনকে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। তিনি অবাক হচ্ছিলেন, যেন আশাই করেননি।

তিনি টেন্ডুলকারের কাছ থেকে পুরস্কার নেন। তাঁর শৈশবের নায়ক আর এমন একজন যিনি তাঁর যথার্থ সমব্যথী। তিনিও যে ২০০৩ এ এমন অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন। কেন আর শচীনের এই মিল দেখে কিউই ভক্তরা আশা করতে পারেন, একদিন তিনিও ভারতীয় মহীরুহের মত কিউইদের গর্ব হবেন।

পুরস্কার দিতে গিয়ে খোদ টেন্ডুলকার বলছিলেন,  ‘উইলিয়ামসনের সবচেয়ে ভাল দিক তাঁর শান্ত থাকার ক্ষমতা। তিনি কোনও পরিস্থিতিতে তাঁর মেজাজ হারাবেন না। বিশ্বকাপ না জেতার দুঃখও তার চেহারায় ফুটে উঠেনি।’

‘হাসির অর্থ সবসময় শুধু সুখ না, মাঝেমাঝে আপনার শক্তিমত্তাও প্রকাশ করে’ – এলজে স্মিথের এই উক্তি  উইলিয়ামসনের সাথে মানিয়ে যায়।

সত্যই পৃথিবীর রঙ্গ বহুবৈচিত্র্যে ভরা, আমরা একেকজন একেক ক্ষমতার অধিকারী। সবাই সবার মত কাজ করলে পৃথিবীটা এমনি সুন্দর থাকবে। আমাদের সৌভাগ্য আমরা এক উইলিয়ামসনকে পেয়েছিলাম।

লর্ডস থেকে খুব বেশি দূরে নয়, সেদিন অল ইংল্যান্ড লন টেনিস ও ক্রোয়েট ক্লাবে সেখানে আরও একজন লোক লড়ছিলেন। ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে জোকোভিচের কাছে ট্রফি হারলেও তিনি বিজিত নন। চরম করতালিতে মাঠ ছাড়েন রজার ফেদেরার।

দুজনই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ছাড়া মাঠ ছাড়েন কিন্তু খেলার আনন্দে তাঁরাই চ্যাম্পিয়ন। দুজনকে এভাবে মেলানো যাচ্ছে কিনা মাথা চুলকালেও প্রকৃতি তাঁদের সাদৃশ্য দেখতে পছন্দ করছে। দুজনেরই যে আট আগস্ট এক বছর করে বয়সের অঙ্কে যোগ হচ্ছে।

_______________

মূল লেখা: If cricket is a gentleman’s game, then it belongs to Kane Williamson। অনুবাদ করেছেন দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link