‘আমি সবসময় দ্বিধার মধ্যে থাকি’

এক সময় বাংলাদেশের উঠতি ক্রিকেটার হিসেবে আরোচনায় ছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে কখনোই সেই আলোচনাটা বাস্তব করতে পারেননি। বরং বারবারই প্রশ্ন উঠেছে তার দলে থাকা নিয়ে। এতোগুলো বছর পার করেও এখনও দলে জায়গা পাকা করতে পারেননি মোহাম্মদ মিঠুন।

এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান এখন টিকে থাকার জন্য বোলিংও করছেন। ক্রিকেটের জন্য তার কমিটমেন্টের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তাকে ইদানিং সহ্য করতে হয় অসহ্য ট্রল।

জীবনের নানা দিক নিয়ে মোহাম্মদ মিঠুনের মুখোমুখি হয়েছিলো খেলা ৭১। কেনো এখনও নিজেকে সব ফরম্যাটে স্থায়ী করতে পারলেন না, কি সংশয় তাঁর নিজেকে নিয়ে, ট্রল নিয়ে কী ভাবেন, সমালোচনায় কতোটা ভেঙে পড়েন এবং জীবনের স্বপ্নটা কী। এইসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন মোহাম্মদ মিঠুন।

ঈদ কেমন কাটলো? বাড়ি যেতে পেরেছিলেন?

হ্যাঁ। ঈদের জন্য গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় গিয়েছিলাম। তবে আবার চলে এসেছি। এবার খুব বেশি সময় পরিবারের সাথে কাটাতে পারিনি।

আপনাদের কুষ্টিয়ায় তো তিনজন জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটার আছেন। কুষ্টিয়ায় থাকতে কি সুমন (হাবিবুল বাশার সুমন) ভাইকে চিনতেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই চিনতাম। ওনাকে দেখেই তো বড় হয়েছি। আমাদের ছোটবেলায় লক্ষ্যই ছিলো যে, আমরা একদিন সুমন ভাইয়ের মত হবো।

বিজয়ের (এনামুল হক বিজয়) সঙ্গে কি বিকেএসপি আসার আগে পরিচয় ছিল?

হ্যাঁ, ছিলো। আমি ক্লাস সেভেন থেকেই বিকেএসপিতে ছিলাম। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার আগ থেকেই বিজয়কে চিনতাম। ওকে আমি অনেক ছোট বেলা থেকেই চিনি। সম্ভবত বিকেএসপিতে ও আমার তিন ব্যাচ জুনিয়র।

আপনার বিকেএসপি জীবন থেকে শুরু করা যাক। আপনাকে প্রডিজি মনে করা হতো। অনুর্ধ্ব-১৭ দলে থাকা অবস্থায় জাতীয় লিগে অভিষেক হয়েছে। সেই সময় আপনাকে নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিলো, তা কী ঠিকঠাক মত পূরণ হয়েছে?

না, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তো আর আমার ক্যারিয়ারটা এমন হতো না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমি এখনও ইন আউটের মধ্যে থাকি না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জাতীয় দলে আমার অভিষেক হয়। ঠিক নাই বলেই তো এখনও জাতীয় দলে ইন আউটের মধ্যে আছি। এখনও আমি জাতীয় দলে কোনো ফরম্যাটে নিয়মিত হতে পারছি না। সব ঠিক থাকলে আমার ক্যারিয়ারের বয়স ১০ বছর হয়ে যেত।

এই যে এতো বছর পরও নিয়মিত হতে পারছেন না, স্থায়ী নাম হয়ে ওঠেননি। এ জন্য কাকে দোষ দেবেন? নিজেকে না অন্য কাউকে?

অবশ্যই নিজেকেই দোষ দেব। আমার কাছে যেটা মনে হয়, ওই সময়ে (শুরুতে) আমার যতটুকু ম্যাচিউরিটি থাকা প্রয়োজন ছিল, তা ছিলো না। ম্যাচিউরিটি বলতে শুধু ক্রিকেটে না, ওভারল লাইফ বা খেলার প্রতি সিরিয়াসনেস বলেন; এগুলোর কথা বলছি। বলছি না যে, সিরিয়াসনেসে সমস্যা ছিলো। আমি সব সময়ই সিরিয়াস ছিলাম।  হয়তো আমার জানার পরিমানটা অনেক লিমিটেড ছিল।

মানে, আরও বেটার গাইডেন্স দরকার ছিলো মনে হয়?

আরো বেটার প্লেয়ার হতে হলে কিভাবে চলতে হয় বা  লাইফ স্টাইলটা কিভাবে মেনটেন করতে হয়; এগুলো জানা দরকার ছিলো। কিভাবে প্রাকটিস করলে আরো বেটার প্লেয়ার হওয়া যায়। এই ছোটখাটো জিনিসগুলো লাইফে অনেক ইমপ্যাক্ট পরে। এই জিনিসগুলো আমি অনেক পরে বুঝেছি। আমাকে নিয়ে যখন টার্গেট করা হয়েছে, যে পরবর্তীতে জাতীয় দলে খেলব, বা এর মধ্যে সম্ভাবনা দেখছি. ওই টাইমটাতে আমার মনে হয় আমার এই ল্যাকিংসগুলো ছিল।  এই বিষয়গুলোতে আমার জানাশোনা কম ছিল।

এখন কী আরও পরিণত হয়ে উঠেছেন বলে মনে হয়?

দেখেন একটা জিনিস কি, মানুষ দুইভাবে শেখে। এক. খেলতে খেলতে শিখে এবং আরেকটা হলো ঠেকে ঠেকে শেখে। (হাসি) তো আমি হলো ঠেকে ঠেকে শিখেছি। আমার কারণে আমার লাইফে এতবার আপ এন্ড ডাউন এসেছে। আমি কিন্তু সব সময় এই কথাটা বলি, আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার কিন্তু স্মুথ না।  সব সময়ই একটা স্ট্রাগলিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আরকি।  সব সময়ই নিজের মধ্যে একটা দ্বিধা দ্বন্ধ কাজ করে।  ভালো খেললেও অনেক সময় দ্বিধা দ্বন্ধে থাকি। তবে আমি চেষ্টা করছি এই জিনিসগুলো থেকে বের হয়ে আসতে।  কারণ এটা আমাকে হেল্প করে না। বরং আমার পারফরম্যান্সটাকে আরো খারাপ করে দেয়।

সমালোচনা ব্যাপারটাকে কিভাবে নেন?

সমালোচনায় তো খারাপ কিছু নেই। সমালোচনা থেকে বরং শেখার সুযোগ থাকে। আমি এটা পজেটিভলিই নেই। তবে কিছু ব্যাপার আমাকে আরও কনফিউজ করে দেয়। এটা কাটানোর চেষ্টা করছি। ভালো খেলার পরও অনেক সময় দেখি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমার খেলা নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন হতাশ হই। ধরেন শেষ সিরিজে ভালো খেললাম তারপরও প্রশ্ন উঠছে মিঠুন কেন দলে আছে? (হাসি) মানুষ হিসেবে এই জিনিসগুলো দেখা খুবই দু:খজনক। যদিও আমার এই বিষয়গুলো দেখা উচিত না বা একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আমার এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।  চেষ্টা করছি এই জিনিসগুলো থেকে দূরে থাকতে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনাকে নিয়ে যা হয়, নানান রকম বিশেষন বসানো হয়, এগুলো দেখেন বা শোনেন?

আমি আসলে ফেসবুক ব্যবহার করি না। আমার নিজের দেখার কোনো অপশন নেই। তবে আমার শুভাকাঙ্খি যারা আছে তারা তো বিষয়গুলো দেখে। তারা চায় না যে আপনাকে নিয়ে এমন বাজে কিছু হোক। এই জিনিসগুলো হয়তো তারা ইমোশন থেকেই আমার কাছে শেয়ার করে। আসলে জিনিসটা যখন আমার কাছে আসে তখন খারাপ লাগে।

আপনার নামের আগে ‘লর্ড’, ‘স্যার’ এসব বসানো হয়। এগুলো যখন কানে আসে তখন কী হেসে উড়িয়ে দেন? নাকি আপনাকে আহত করে?

আমিতো চাই হাসতে। কারণ হলো এগুলো তো আসলে যুক্তিহীন। যাদের কাজ নাই তারাই এসব করে বেড়ায় বলে আমার মনে হয়। আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের তার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকা উচিত।  আর আমরা যারা ক্রিকেটটাকে ভালোবাসি, চেষ্টা করব খেলোয়াড়দের সাপোর্ট করার। আমি কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে বেটার করার জন্য, বাংলাদেশ টিমকে সার্ভিস দেওয়ার জন্যই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি।  দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আপনিও কিন্তু লিখছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরেকটু কিভাবে বেটার করা যায় সে জন্য।  কিন্তু আপনি যদি এটা না করে, তার উল্টোটা করেন, চিন্তা করেন বাংলাদেশ টিম কিভাবে খারাপ করে, কিভাবে ক্রিকেটটাকে নিচে নামানো যায় তাহলে তো আপনি দেশের সুনাগরিক না।

ওয়ানডেতে আপনার যে পারফরম্যান্স তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে টি-টোয়েন্টি এবং টেস্টে নিজেকে মানিয়ে নিতে এখনও কি আপনার সমস্যা হয়?

জিনিসটা দেখেন, যেকোনো ফরম্যাটে আপনার কিন্তু জানতে হবে আপনি খেলবেন কিনা।  একমাত্র ওয়ানডেতে শেষ কয়েক বছর আমি ধারাবাহিক ভাবে খেলছি। তারপরও টিম কম্বিনেশনের কারণে কিছু ম্যাচে আমি বাদ পড়েছি। কিন্তু ওয়ানডেতে আমি জানি যে আমি খেলব। টি-টোয়েন্টিতে অনেক বছর ধরেই আমি দলে নেই।  ঘরে এবং বাইরে যে সিরিজগুলো হয়েছে সেইগুলোতে ছিলাম না। নিউজিল্যান্ড সফরেও যে আমি টি-টোয়েন্টি খেলব, এমন সম্ভাবনা কম ছিল। ফলে আমার মানসিক প্রস্তুতিও ছিলো না। মুশফিক ভাই ইনজুরিতে পড়ার কারণেই আমি দুইটা ম্যাচের জন্য দলে সুযোগ পেলাম। মুশফিক ভাই ফিট থাকলে হয়তো আমি সুযোগ পেতাম না। এখানে মানসিক প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার আছে।

টেস্টেও কী এরকম হচ্ছে?

আর টেস্ট ম্যাচ আমি কখন খেলব বা খেলব না; জানি না। বা কোন পজিশনে খেলব, এটা নিয়ে আমার কোনো পরিস্কার আইডিয়া নেই। আমি জানি না। হঠাৎ করে অনেক সময় হয়ে যায়। তবে টি-টোয়েন্টি এবং টেস্টে সফল হতে না পারাটা অবশ্যই আমার ব্যর্থতা। তবে আগে থেকে আইডিয়া থাকলে এমন হতো না। যেমন শান্ত (নাজমুল হোসেন শান্ত); ও জানে ও টেস্ট খেলবে। ওকে টেস্টের জন্য প্ল্যান করা আছে বা কোন পজিশনে খেলবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত আছে। আমি জাস্ট উদাহরন হিসেবে বলছি। ও জানে ও টেস্টে খেললে তিন নম্বর পজিশনে খেলবে। ও ওভাবেই নিজেকে তৈরি করেছে। আমার তো ধরেন এই জিনিসটা ক্লিয়ার নাই, খেলব কিনা তাও নিশ্চিত  না, আবার খেললেও কোন পজিশনে খেলব তা স্পষ্ট না।

কিপার হিসেবেই আপনাকে নিয়ে পরিকল্পনা ছিল, জাতীয় দলে তো সেই সুযোগটা ওইভাবে পেলেন না।

দেখেন বাস্তবতা আপনাকে মেনে নিতে হবে।ওয়ানডেতে মুশফিক (মুশফিকুর রহিম) ভাই কিপিং করে। আর টেস্টে লিটন (লিটন কুমার দাস) কিপিং করে। কিপিংটা আমার থার্ড স্কিল হয়ে গেছে। যেটা আমার সেকেন্ড স্কিল ছিল, সেটা এখন থার্ড স্কিল হয়ে গেছে।

শ্রীলংকায় ‘এ’ দলের সফরে বোলিং শুরু করলেন। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই বোলিং করেছেন। তাহলে বোলিংটা কি আপনার সেকেন্ড স্কিল হয়ে গেল?

আমি সেকেন্ড স্কিল হিসেবে বলছি বোলিং এবং ফিল্ডিংটাকে। আমি শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্টে নিজেকে বোলিংয়ের জন্যও তৈরি করেছিলাম। টেস্টে স্পিন বোলিং নিয়ে অনেক কাজ করেছি। কিভাবে ইফেক্টিভ হওয়া যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি। আমার বোলিংয়ের একটা জিনিস ভালো আছে, আমার বলটা জায়গা মতো পড়ে। হয়তো স্পিন সম্পর্কে আমার অতো ধারণা নেই। কারণ আমিতো আর ওইভাবে বোলিং করি নাই। নেটে প্রাকটিসে হয়তো হেল্প করেছি। তবে ম্যাচে বোলিং করে অভ্যস্ত না।

স্কুল ক্রিকেটে কখনও বোলিং করার অভিজ্ঞতা আছে?

সে তো অনেক আগের কথা। আমি যখন ইন্টার স্কুলে খেলতাম, তখন আমি ২৫ ওভার কিপিং করতাম আবার গ্লাভস খুলে ২৫ ওভার বোলিং করতাম। তার পরে বিকেএসপিতে যখন যাই তখন ব্যাটিংয়ের পর কিপিংয়েই মনোযোগ দেই। তারপরও নেটে অনেক সময় হেল্প করার জন্য বোলিং করতাম। ওই হিসেবে বোলিং করার স্কিলটা আমার আছে। তবে অনেক কিছুতো জানার আছে, শেখার আছে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একাদশে থাকলে কী বল করার জন্য তৈরী ছিলেন?

শ্রীলঙ্কা সফরে সৌরভ (মুমিনুল হক সৌরভ) আমাকে যেভাবে ইনফর্ম করেছে, যদি আপনি টেস্টে খেলেন তাহলে আপনাকে ১০-১২ ওভার বোলিং করতে হতে পারে। দলের প্রয়োজনে আমি বোলিং করতেও প্রস্তুত আছি। ১০- ১৫ ওভার যদি সাপোর্ট দেয়া লাগে তাহলে দেব। তবে আমি মেইন স্পিনার হতে কখনই পারব না। আমার পক্ষে সম্ভবও না (হাসি)। তবে একজন বোলার যখন ক্লান্ত হয়ে যান তখন মাঝখানে কয়েক ওভার বোলিং করে হেল্প করতে হয়। ওই রকম সময়ে আমি মনে করি বল করার মতো ক্যাপাবেলিটি আমার আছে।

আপনি এখন কোনটা স্বপ্ন দেখেন, জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়া? নাকি জাতীয় দলে খেলে ভালো কিছু অর্জন করা?

জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়াটা কোনো স্বপ্ন হতে পারে না। যদি আমি জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়ার চিন্তা করি তাহলে আমি নিজের চিন্তাই করলাম। আমি যদি কালকে দল থেকে বাদও পড়ে যাই তাহলেও আমার কোনো দুঃখ নেই। তবে আমি যখন জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নামব সেদিন জাতীয় দল কিভাবে জিতবে, আমি কিভাবে বাংলাদেশ দলকে জিতাতে পারব, সেই মানসিকতা নিয়েই মাঠে নামব।  কোনো রকম ৩০-৪০ রান করে পরের ম্যাচ খেলার জন্য নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে চাই না।

নিজেকে নিয়ে স্বপ্নটা…

হয়তো তরুণ ক্রিকেটারদের মতো আমি আগামী ১০- ১২ বছর বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দিতে পারব না। তবে আগামী ৫-৬ বছর দলকে সার্ভিস দেয়ার মতো যথেষ্ট ফিটনেস এবং বয়স আমার আছে। আমি মনে করি আগামী পাঁচ বছর যদি বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দেই, তাহলে আমি এমনভাবে সার্ভিস দিতে চাই যেন আমার পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ অনেকগুলো ম্যাচ জেতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link