বিকল্পধারার হেডমাস্টার

আধুনিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে ‘শুধু জাতীয় দলেরই কোচিং করিয়ে যাওয়া বিদেশি কোচ’ ধারণায় বিশ্বাসীদের সংখ্যাটা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। সেই গুটিকয়েকের একজন হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে জন্ম নেওয়া মিকি আর্থার। সময়ের পরিচিত কোচদের একজন তিনি।

নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি ক্রিকেটের অনেক বড় বড় দল অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানের কোচ ছিলেন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তাছাড়াও আন্তর্জাতিক কোচিং ক্যারিয়ারের বাইরেও বিভিন্ন ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে দলের হেড কোচের দায়িত্ব পালন করেছে। প্রায় ১৪ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ ও ছিলেন তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রিকুয়াল্যান্ড ওয়েস্ট, অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের হয়ে মিকি আর্থার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১১০ ম্যাচ খেলে ৬৫৫৭ রান করেন। আবার ১৫০ টি লিস্ট এ ম্যাচ খেলে ৩৭৭৪ রান করেন। তাছাড়া ও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের হয়েও খেলেছেন। ক্রিকেট খেলে নাম করার মতো সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও ক্রিকেট খেলা অবস্থাতেই নিজের কোচিং করানোর বৈশিষ্ট্য ও উদ্দীপনা সমসময় ফুটে ওঠতো।

তার মধ্যে একজন ভালো কোচ হওয়ার আলাদা ব্যাপারটা সবসমই ছিলো। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ২০০১ সালে ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই কোচিং পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা দুইটি দল গ্রিকুয়া এবং ২০০৩ সালে ইস্টার্ন ক্যাপের কোচের দায়িত্ব পালন করেন।

ইস্টার্ন ক্যাপকে পরপর ২ বছর অনেক ঘরোয়া টুর্নামেন্টে সাফল্য এনে দেয় মিকি আর্থার। ২০০৫ সালে রেয় জেনিংসকে বাদ দিয়ে সাউথ আফ্রিকার হেড কোচ হিসেবে আচমকা ডাক পড়ে মিকি আর্থারের। সেই সময় মাত্র ৩৭ বছর বয়স থেকে তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচিং ক্যারিয়ার শুরু।

সেই সময় ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডে সিরিজ হারালেও তাদের সাথে ঘরের মাটি ও অস্ট্রেলিয়ার মাটি দুই জায়গাতেই টেস্ট সিরিজ হেরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু আস্তে আস্তে সাফল্য ধরা দেয় মিকি আর্থারের। সেই সময় টানা টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ জিতে অস্ট্রেলিয়ার সাথে, ২০০৭ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলে, ৪৩ বছরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জিতে ইংল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের মাটিতে।

আবার তার অধীনে সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ দেয়। কিন্তু আবার কিছু ব্যার্থতার পর ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। এই পাঁচ বছর প্রোটিয়ারা তার অধীনে ৪৫ টা টেস্ট খেলে ২২ টা জিতে ১৬ টা হারে। ৯৮ টা ওয়ানডে খেলে ৬৩ টা জিতে ৩২ টা হারে। ২৬ টা টি টোয়েন্টি খেলে ১৭ টা জিতে নয়টাতে হারে।

সেই বছরই ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মূল কোচের দায়িত্ব পান মিকি আর্থার। আবার পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার কোচ হয়ে আন্তর্জাতিক কোচিং এ ফেরেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সাথে মাত্র দুই বছর ছিলেন তিনি। প্রথম বছরটা দারুন কাটলেও ২য় বছরে পরপর টানা কিছু সিরিজ হারলে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাকে হেড কোচের পদ থেকে ছাটাই করে। সেই সময় অস্ট্রেলিয়া তার অধীনে ১৯ টি টেস্ট খেলে ১০ টা জিতে ছয়টা হারে। ওয়ানডে ৩৮ টা খেলে ১৮ টা জিতে, ১৬ টাতে হারে। টি টোয়েন্টি ১৬ টা খেলে সাতটা জিতে আটটায় হারে।

শেষটা হয় ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম বিরাট এক বিতর্ক দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়দের ‘হোমওয়ার্ক’ দিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। তখন ২০১৩ সাল। ভারত সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া দল। প্রথম দুই টেস্টই হারে বাজেভাবে। সেই দুই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ৪০ উইকেটের মধ্যে ৩৪ টিই নেন স্পিনাররা।

দ্বিতীয় টেস্টের পর খেলোয়াড়দের একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেন কোচ মিকি আর্থার। পারফরম্যান্স ভাল করার জন্য কি কি করা যেতে পারে? – এমন কিছু আইডিয়া লিখতে বলেন কোচ। শেন ওয়াটসন, জেমস প্যাটিনসন, উসমান খাজা ও মিশেল জনসন সময়মত ‘হোমওয়ার্ক’ জমা দিতে ব্যর্থ হন। আর এর শাস্তি হিসেবে পরের টেস্টে তাঁরা একাদশ থেকে জায়গা হারান।

এটা ‘ব্যাকফায়ার’ করে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের ইতিহাতে অন্যতম কুখ্যাত বিতর্কের জন্ম দেয়। ফলে, কোচিং মেথড নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দ্রুতই চাকরি হারান মিকি আর্থার। তখন অ্যাশেজ শুরু হতে মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি!

তারপর মিকি আর্থার ২০১৬ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘরোয়া লিগে বিভিন্ন দলের হয়ে হেড কোচের দায়িত্ব পালন করার পর সেই বছরই পাকিস্তানের হেড কোচ হওয়ার প্রস্তাব পান। ২০১৬ থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

পাকিস্তান তিন বছর মিকি আর্থারের আমলে অনেক সাফল্য অর্জন করে। সেই সময় পাকিস্তান টেস্ট ও টি টোয়েন্টিতে এক নম্বর হয়। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও পাকিস্তান মিকি আর্থারের অধীনেই অর্জন করে। যদিও ২০১৯ সালে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার জের ধরে তিনি চাকরি হারান।

তিনি শ্রীলঙ্কার কান্ডারি বনে যান এরপর। বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়েই তিনি এসেছিলেন লঙ্কায়। নিজের কোচিং বিদ্যা, দর্শন, মন্ত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষা তাঁর হবে এখানেই। সেটা শেষ করে ফিরেছেন ইংলিশ কাউন্টিতে।

এর মধ্যেই আবার পাকিস্তান থেকে ডাক আসেন। দলটির ‘অনলাইন কোচ’-এর অদ্ভুত দায়িত্বও পালন করেন। সব মিলিয়ে তিনি যে একটু অন্যরকম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link