গলায় স্বর্ণপদক, লাল-সবুজের পতাকা গায়ে জড়িয়ে স্যালুট ঠুকছেন রোমান সানা। বাংলাদেশের এসএ গেমস ইতিহাসের ‘হল অফ ফেমে’ জায়গা করে নিয়েছে দৃশ্যটা। দেশসেরা এ আর্চার অবশ্য এর আগেও কীর্তি গড়েছেন। প্রথম দেশীয় আর্চার হিসেবে ঠাই করে নিয়েছিলেন অলিম্পিক গেমসে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এখন অলিম্পিকে শেষ সময়ের প্রস্তুতি নেয়ার কথা তার। সে পথ আগলে দাঁড়িয়েছে কোভিড-১৯।
তবে এ পর্যন্ত আসার রাস্তাটা মোটেও মসৃণ ছিলো না তার জন্যে। খেলা ৭১ কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে সে বন্ধুর পথচলার গল্পটাই শোনালেন রোমান সানা।
খেলা ৭১: আর্চারিতে আসা হলো কী করে?
রোমান: ছেলেবেলা থেকেই গ্রামীণ খেলাগুলো আমাকে বেশ টানতো। সমানভাবে টানতো বিদেশী খেলাগুলোও। তবে মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে একটা পরামর্শেই জীবনটা বদলে গেলো। আমার অব্যর্থ নিশানা দেখে হাসান স্যার আমাকে আর্চারির বাছাইতে যোগ দিতে বললেন। হাসান স্যার বলেছিলেন, ‘কত খেলাই তো খেলিস! আর্চারির বাছাই হচ্ছে। চল সেখানে যাই।’ প্রথম দিকে খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। স্যার আমাদের কয়েকজনকে ফরম পূরণ করিয়ে আর্চারির হাতেখড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, এরপর কিছুদিন অনুশীলন করলাম। নিশানার দারুণ উন্নতি হলো এ সময়ে। বাছাই পর্বেও সেটা ধরে রাখলাম, টিকেও গেলাম এরপর।
খেলা ৭১: এর আগে ছোটবেলাটা কেটেছে কেমন?
রোমান: জন্মের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষার শেষ পর্যন্ত কয়রাতেই ছিলাম। সে সময়টায় খুবই দুষ্টুমি করে কেটেছে, দল বেঁধে ঘুরতাম। সুযোগ পেলেই গুলতি নিয়ে ছুটতাম এপাড়া-ওপাড়ায়, পাখি শিকার করতাম আমরা। পরিবারের ছোট ছিলাম, সে সুবাদে কিছুটা বাড়তি স্বাধীনতা মিলতোই। সেটার সুবিধা নিতাম। অব্যর্থ নিশানার হাতেখড়িটাও এসেছে সে গুলতি ছোড়াছুড়ি থেকেই।
খেলা ৭১: পরিবার থেকে কি কখনো বাঁধা এসেছে?
রোমান: তা তো আসবেই। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে তিরন্দাজিতে এসে পড়ার কারণে পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছিলো। এসএসসির ফলাফল হলো খারাপ। এরপর তো বাবা-মা রীতিমতো অগ্নিশর্মা! সাফ বলে দিলেন, আর্চারিতে আর পা না বাড়াতে! উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম সুন্দরবন আদর্শ কলেজে। আবারও আর্চারি অঙ্গনে ফেরার ফন্দি-ফিকির চালাতে লাগছিলাম। যোগাযোগ করতাম আর্চারির লোকজনের সঙ্গে। এসব করেছিলাম বাবা-মাকে না জানিয়েই, জানলে হয়তো আরও বাঁধার মুখে পড়তে হতো।
খেলা ৭১: এরচেয়েও বড় কোনো বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছে কি?
রোমান: হ্যাঁ, ২০১২ তেই তো! সে বিভীষিকা ভোলা আমার পক্ষে অসম্ভব। সেবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভাঙার পরে তো মনে হচ্ছিলো, আমার বোধহয় আর খেলা হবে না! ঠিকঠাক দাঁড়াতেই পারতাম না! ফিরতে সময় নিলাম আট মাসের মতো। এ সময়ই বাংলাদেশ আনসারের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। তারা পাশে এসে না দাঁড়ালে ফেরা হতো কিনা কে জানে!
খেলা ৭১: এরপর থেকেই তো স্বর্ণসময়ের শুরু!
রোমান: একটা বিশ্বাস আছে আমার যে, স্রষ্টা বড় পরীক্ষার পরই বড় পুরস্কার তুলে রাখেন। আমার সঙ্গেও সেটাই হয়েছিলো সম্ভবত। পরের বছর থেকেই আর্চারিতে সাফল্য আসতে থাকলো নিয়মিত বিরতিতে। ২০১৩ বাংলাদেশ গেমসে একক ও দলগত সোনা জিতলাম আনসারের হয়ে। বৈশ্বিক আসরেও (এশিয়ান গ্রাঁ প্রিঁ) স্বর্ণপদক এলো পরের বছর।
খেলা ৭১: এমন ছন্দে থেকেও খেলতে পারেননি ২০১৬ এসএ গেমসে। আফসোস হচ্ছিলো নিশ্চয়ই?
রোমান: আফসোসের চেয়ে রাগ হচ্ছিলো খুব। চোটের কারণে সেবার গোহাটি যাওয়া হলো না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে পরবর্তী লড়াইয়ের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছি ধীরে ধীরে।
খেলা ৭১: গত বছর এত্তোএতো অর্জন এসে লুটিয়ে পড়লো পায়ে। একে জীবনেরই সেরা বছর বলবেন কিনা?
রোমান: বছরটা দারুণ কেটেছিলো। ২০১৯ নেদারল্যান্ডসে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতলাম, এশিয়া কাপ, এসএ গেমসে জিতলাম সোনা। তবে ভবিষ্যতে একেও ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য আমার। এখানেই থামতে চাই না।
খেলা ৭১: বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে মাউরো নেসপলি, খাইরুল আনওয়ার মুহাম্মদদের মতো খেলোয়াড়দের মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্নায়ুচাপ কি কাজ করেছে কখনো?
রোমান: নাহ, স্নায়ুচাপ ব্যাপারটা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বৈশ্বিক আসরগুলোয় কাজ করতো। এখন আর তেমন হয় না। আগে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব তিরন্দাজের বিপক্ষে খেলার রোমাঞ্চেই মূলত কিছুটা ঘাবড়ে যেতাম। সম্ভবত প্রতিপক্ষকেও কিছুটা বেশি শ্রদ্ধা করতাম, কে জানে! তবে ব্যাপারটা বদলাতে শুরু করেছে নিজের শক্তি-সামর্থ্যের আন্দাজটা যখন পেতে শুরু করেছি তখন থেকে। এখন বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দাঁড়ালে দারুণ আত্মবিশ্বাস কাজ করে, মনে হয় সেরাটা দিতে পারলেই তো কেল্লাফতে!
খেলা ৭১: গেলো বছরে এই সাফল্যের পেছনে কোচ মার্টিন ফ্রেডেরিখ কেমন অবদান রেখেছেন? ফেডারেশনের সহযোগিতা কেমন ছিলো?
রোমান: আমার বদলে যাওয়ার পেছনে অনেক বড় অবদান মার্টিন ফ্রেডরিখের। তার আসার পর থেকে দলের মানসিকতাটাই বদলে গেছে আমূলে। এ বদলে যাওয়া মানসিকতার সুবাদেই অলিম্পিকে উত্তরণটা সম্ভব হয়েছিলো! তার সবচেয়ে ভালো গুণ হলো, খেলোয়াড়দের দ্রুত বুঝার ক্ষমতা। দারুণ পরিকল্পনাও তার আরেকটা দিক। অনুপ্রেরণা দারুণ দেন তিনি! ফেডারেশনও যথেষ্ট হেল্পফুল। সব ধরণের সহযোগিতা সব সময়েই করে এসেছে আমাদের।
খেলা ৭১: নেদারল্যান্ডসে মাউরো নেসপলিকে হারিয়ে, অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত করে যখন দেশে ফিরলেন, বিমানবন্দরে লোকারণ্যের মধ্যমণি ছিলেন আপনি। অনুভূতিটা কেমন ছিলো?
রোমান: দেশে ফিরে আবিষ্কার করলাম, রীতিমতো তারকা হয়ে গিয়েছি! এয়ারপোর্টে জনারণ্য দেখে হতভম্বই হয়ে গিয়েছিলাম প্রথমে, সামলে নিয়েছি পরে। স্রষ্টাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, আমার লেগে থাকার পুরস্কারটা দেয়ার জন্যে।
খেলা ৭১: করোনার কারণে অলিম্পিক পিছিয়ে গেছে এক বছর। অলিম্পিক নিশ্চিত করার পরে বলেছিলেন বেশি বেশি ম্যাচ প্র্যাকটিসের কথা। আগামী এক বছরে এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপসহ আরও অনেক টুর্নামেন্ট আছে। একে কি সুযোগ হিসেবে দেখছেন?
রোমান: সব কিছু নির্ভর করছে করোনা কখন বিদায় নেয় তার উপর। পরিস্থিতি ঠিক না হলে কিন্তু বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ এমনকি আগামী বছরের অলিম্পিকও পিছিয়ে যেতে পারে। আর যদি সবকিছু শীঘ্রই যদি ঠিক হয় তাহলে আগামী বছরের শুরুতে টুর্নামেন্টগুলো বাড়তি ম্যাচ প্র্যাকটিসের সুযোগই করে দেবে।
খেলা ৭১: ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
রোমান: আর্চারিতে এসেছি আজ দশ-এগারো বছর হতে চললো। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। বিশ্বসেরাদের একজন হয়েই অবসরে যেতে চাই।