এক তলোয়ারের তিন অধ্যায়

ভারি ব্যাটটা আসলেই দেখতে তলোয়ারের মত মনে হল জন গাইয়ের চোখে। তিনি বলে উঠলেন, ‘হোয়াট অ্যাবাউট কিং আর্থার, এক্সক্যালিবার?’ বলাই বাহুল্য, কিংবদন্তিতুল্য ব্রিটিশ রাজা আর্থারের তলোয়ারের নাম ছিল এক্সক্যালিবার।

‘ইয়াশ, তালওয়ার নিকাল!’ – এর বাকিটা স্রেফ ইতিহাস।

সেই ইতিহাসের নাম ১৭৫, কিংবা ১৯৮৩ বিশ্বকাপ। সংক্ষেপে কপিল দেব। ‘৮৩’-এর পর্দায় কপিল দেবের সাথে মঙ্গুজ ব্যাটের এমন সিনেম্যাটিক দৃশ্যায়ন কমবেশি তো সবাই দেখেছি। এতটা না হলেও কপিলের সেই ইনিংসে সত্যিই বড় অবদান ছিল মঙ্গুজ ব্যাটের।

রুপালি পর্দায় তাঁকে যতই মঙ্গুজ ব্যাট বলে দাবি করা হোক না কেন, আধুনিক মঙ্গুজ ব্যাট ওটা নয়। ওটার সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মঙ্গুজ ব্যাটের বেশ পার্থক্য। আদতে ওই জমানায় মঙ্গুজ ব্যাটের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তবে, যেটা কপিল দেব ব্যবহার করেছিলেন তাঁর সাথে মঙ্গুজের বেশ মিল আছে।

১৭৫ রানের সেই ইনিংস খেলা পথে কপিল দেব।

ব্যাপার হল, ওই সময় ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা হত। বেসবলের ব্যাটকে নানা ভাবে পরিবর্তন করে আজকের ক্রিকেটের ব্যাট হয়েছে। সে অবশ্য অন্য গল্প। আজকের গল্পের মূল কয়েকটি চরিত্রের একটা এক্সক্যালিবার ব্যাট। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিউবেরি।

মূলত এরকম দেখতে একটা ব্যাট দিয়েই কপিল দেব ১৭৫ রানের ইনিংসটা খেলেছিলেন। তবে, কপিলের ব্যাটটা আবার এক্সক্যালিবার নয়। সেই গল্পটা একটু পরে বলি।

প্রথমে আসি এক্সক্যালিবারে। নিউবেরির আনা এই ব্যাটটা আসে আশির দশকে। প্রথম ব্যবহারকারী ছিলেন ল্যান্স কেয়ার্ন্স। মিডিয়াম পেসার আর মারকুটে এই ব্ল্যাক ক্যাপ ব্যাটারের আরেকটি পরিচয় হল তিনি খ্যাতনামা অলরাউন্ডার ক্রিস কেয়ার্ন্সের বাবা।

ল্যান্স ও তাঁর তলোয়ার, মানে এক্সক্যালিবার

ল্যান্স ৭০ কিংবা ৮০’র দশকের ক্রিকেটার। ওই সময়ে ওয়ানডে আর টেস্ট ব্যাটিংকে পার্থক্য করতে পারতো – এমন ব্যাটার ছিল বিরল। সেই সময়েও ল্যান্স ওয়ানডেতে ব্যাট করেছেন ১০৪.৮৮ স্ট্রাইক রেটে। মানে, যে অল্প কদিন ওয়ানডে খেলেছেন, বলটার জন্ম যে পেটানোর জন্যই হয়েছে – তাতে সেটা সাফ সাফ বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

ক্যারিয়ারে দু’টো ওয়ানডে হাফ সেঞ্চুরি। দু’টোতেই ছিলেন ভীষণ মারকুটে। ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ৪৩ বলে ৬০ রান। চারটি চার ও চারটি ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি ছিল প্রায় ১৪০ স্ট্রাইক রেটে খেলা। সেবার না হলেও দ্বিতীয় ও ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ফিফটিতে তাঁর সঙ্গী হয়েছিল এক্স ক্যালিবার ব্যাট।

এবার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন ২৫ বলে ৫২ রান। স্ট্রাইক রেট ২০০’র ওপরে। ছয়টা ছক্কা হাঁকান একাই। এর মধ্যে একটা ছক্কা নাকি ছিল স্রেফ এক হাতে!

এমসিজিতে ল্যান্সের সেই বিখ্যাত ইনিংস

সেদিন নিউজিল্যান্ড বেশ বাজে ভাবে হারলেও তখনকার দিনে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে গিয়েছিলেন কেয়ার্ন্স সিনিয়র। ২১ বলে পান ফিফটির দেখা। এক্সক্যালিবার ব্যাটটা বেশ আলোড়ন তোলে।

প্রশ্ন হল, সেই এক্সক্যালিবার ব্যাটটা এখন কোথায়? ল্যান্স ব্যাটটা উপহার দিয়েছিলেন এর আবিষ্কারককেই। মানুষটা হলেন নিউবেরির প্রতিনিধি ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার জন উইলিয়াম গাই। গাই থাকেন সেই মেলবোর্নেই।

কাঁধহীন এমন ব্যাটের ধারণাটা ১২ টেস্টের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গাই-ই প্রথম দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে। আর তা দিয়ে কি করা সম্ভব সেটা ল্যান্স কেয়ার্ন্স করে দেখিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল এই গাইয়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ঢাকার নামও। কারণ, ১৯৫৫ সালের নভেম্বরে এই ঢাকার মাটিতেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তাঁর।

জন গাইয়ের হাতে তাঁরই আবিষ্কৃত সেই এক্সক্যালিবার ব্যাট।

তো গাই একবার কি একটা কারণে আলাপ করছিলেন নিউবেরির প্রতিষ্ঠাতা জন নিউবেরির সাথে। ড্রাই নট ব্যাটটা তখন নতুন নতুন এসেছে। এর কাঁধটা ছিল বেশ ঠুনকো। তো, গাই বললেন, ‘এই কাঁধটা ফেলে দিলে কেমন হয়!’

জন নিউবেরির কথাটা বেশ মনে ধরল। তিনি কাঁধটা ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এটার নাম কি হতে পারে? এটা তো দেখতে অনেকটা তলোয়ারের মত হয়েছে।’

ভারি ব্যাটটা আসলেই দেখতে তলোয়ারের মত মনে হল জন গাইয়ের চোখে। তিনি বলে উঠলেন, ‘হোয়াট অ্যাবাউট কিং আর্থার, এক্সক্যালিবার?’ বলাই বাহুল্য, কিংবদন্তিতুল্য ব্রিটিশ রাজা আর্থারের তলোয়ারের নাম ছিল এক্সক্যালিবার।

খাঁটি ব্রিটিশ জন নিউবেরির নামটা বেশ মনে ধরল। মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘তা যা বলেছো, শুনতে দারুণ লাগছে!’

ব্যাস! এভাবেই জন্ম হল এক্সক্যালিবারের।

স্ল্যাজিঙ্গার পাল্টে স্ল্যাজিঙ্গার ডব্লিউ নিচ্ছেন কপিল দেব, বাকি ইতিহাসটা তো সবারই জানা।

এবার শুরু গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়। আবারও সেই কপিল দেব। বলছি সেই আশির দশকেরই কথা। ওই সময় অনেকটা এক্সক্যালিবারের মতই দেখতে একটা ব্যাট আনে স্ল্যাজিঙ্গার, খেলাধুলার জগতে খ্যাতনামা এক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তবে, এক্সক্যালিবারের চেয়ে স্ল্যাজিঙ্গার ডব্লিউ জি’র আকার একটু বড়, খালি চোখে।

১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে বেশ কয়েকজন পাওয়ার হিটার নিয়ে এসেছিল ভারত। ইয়াশপাল শর্মা, সন্দীপ পাতিল তো ছিলেনই। ছিলেন স্বয়ং কপিল দেবও। এমনকি কীর্তি আজাদও ভাল পেটাতে জানতেন। তাই, ভারত সাথে করে স্ল্যাজিঙ্গার ডব্লিউ জি নিয়ে এসেছিল। এটারও যথারীতি ওই এক্সক্যালিবারের মত কোনো কাঁধ নেই।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচটায় ভারত যখন মোটে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট হারায় তখন ক্রিজে নামেন কপিল। শুরুতে তিনি স্ল্যাজিঙ্গারের সাধারণ ব্যাটটা দিয়েই খেলছিলেন। পরে ওটা পাল্টে ফেলেন স্ল্যাজিঙ্গার ডব্লিউ জি দিয়ে। বাকিটা তো সবারই জানা।

১৩৮ বলে ১৭৫ রান করে অপরাজিত থাকা কপিল একাই ১৬ টি চার ও ছয়টি ছক্কা হাঁকান। টার্নব্রিজ ওয়েলসের নেভিল গ্রাউন্ডের সেই ম্যাচটাই যেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপের হাইলাইটস হয়ে টিকে গেছে। সেই ইনিংসের ছোঁয়াতেই শেষ অবধি বিশ্বকাপটাও প্রথম বারের মত ঘরে তোলে ভারত।

এবারে আসা যাক মঙ্গুজ ব্যাটের প্রসঙ্গে। মানে গল্পের তৃতীয় অধ্যায়ে। আর এটা একদমই আধুনিক কালের ঘটনা।

২০১০ সালের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) এই ব্যাট নিয়ে হাজির হন অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেন। মারকুটে এই ওপেনারের হাতে যে বিচিত্র একটা ব্যাটের দেখা মেলে সেটা আদতে দেখতে ওই এক্সক্যালিবার বা স্ল্যাজিঙ্গার ডব্লিউ জি’র মত হলেও, পার্থক্য বিস্তর।

২০০৯ সালে প্রথম স্টুয়ার্ট ল মঙ্গুজ ব্যাট নিয়ে খেলতে নামেন

যদিও, এটা সত্যি যে, নির্মাতারা কপিলের ব্যাট থেকে প্রভাবিত হয়েই মঙ্গুজ বানিয়েছিলেন। হেইডেনের আগে এই ব্যাট ব্যবহার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্টুয়ার্ট ল কিংবা ইংল্যান্ডের মার্কাস ট্রেসকোথিক। প্রথম এই ব্যাট ব্যবহার করা ল-এর মতে এই ব্যাট হল ‘হাফ ব্রিক অন আ স্টিক’। সাধারণ ব্যাটের চেয়ে এটা ২০ শতাংশ বেশি শক্তি ও ১৫ শতাংশ বেশি গতি জেনারেট করে।

মঙ্গুজটা ঠিক শোল্ডারলেস নয়। সামান্য হলেও এর কাঁধ আছে। আর বড় পার্থক্য হল – উইলোর থেকে এর হাতলটা বড়। যার কারণে পাওয়ার হিটিংটা বেশ সহজে করা যায়। সহজ ভাষায় এটা শর্ট ব্লেড, লঙ হ্যান্ডেল ব্যাট। সাধারণ ব্যাটের ব্লেডের চেয়ে এরটা ৩৩ শতাংশ ছোট, আর ব্লেড স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বড়।

এই ব্যাটের নিচের দিকে প্রচলিত ব্যাটের চেয়ে তিনগুন বেশি কাঠ থাকে, যার কারণে ইয়র্কারের বিপক্ষে কিংবা ফুলটসে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে খেলা যায়। তবে, স্বাভাবিকের চেয়ে এই ব্যাট হালকা।

মঙ্গুজ ব্যাটের নানা ধরণ

এই ব্যাট এমনভাবেই বানানো হয়েছে যাতে করে কনভেনশনাল ব্যাটের চেয়ে এটা সহজে সুইট স্পটগুলো ধরতে পারে। কনিষ্ঠতম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদ আশরাফুল বলেছিলেন, ‘মঙ্গুজ ব্যাটের ব্লেডের পুরোটাই সুইট স্পট। আপনাকে শুধু বলটাকে কানেক্ট করতে হবে।’

মঙ্গুজ দিয়ে হেইডেন ৪৩ বলে ৯৩ রানের এক ইনিংসও খেলেন। তবে মঙ্গুজের বড় সমস্যা ছিল, এটা রক্ষণের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত। সুরেশ রায়না তো বলেই দিয়েছিলেন, এই ব্যাটে ডিফেন্সের কোনো বালাই নেই। ফলে, রক্ষণাত্মক শট খেলতে গেলেই স্লিপে কিংবা বোলারের হাতে ক্যাচ তুলে দিতে হবে। আনইভেন বাউন্সের সামনেও এই তলোয়াড় ঠুনকো। হয় মারো না হয় মরো। মধ্যম কোনো পথই নেই মঙ্গুজে।

যার কারণে ব্যাটারদের ইনজুরিতে পড়ার প্রবণতাও বেড়ে যেতে পারে। ফলে এরপর হেইডেন বা অন্য কাউকে পরে এই ব্যাট আর ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। আর বড় কথা হল, খোদ বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) ও আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল এমন ‘আনকনভেনশনাল’ ব্যাট ব্যবহার একদম নিষিদ্ধ করে দেয়।

মঙ্গুজ ব্যাটের সেরা প্রহারক ম্যাথু হেইডেন

মঙ্গুজ অর্থ হল বেজি বা নেউল। ক্রিকেটের সাথে আক্ষরিক অর্থেই সাপ-নেউলে সম্পর্ক দিয়েই ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যায় মঙ্গুজ ব্যাট।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...