স্লো ডেথ বাকনার!

‘ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া’ – এই ব্যাপারটা কারো মধ্যে থাকাটা খুব ইতিবাচক। ক’জনই বা নিজের আত্মসমালোচনা করে! আর ক’জনই বা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চায়। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তা কাজে লাগিয়ে সফলতা অর্জন করার যেই মাহাত্ম্য সেটা মনে হয় আর কোনো কিছুতে নেই।

আর যখন ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে আমার মনে পড়ে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির দীর্ঘদেহী এক ক্যারিবিয়ান আম্পায়ারের কথা। যিনি ক্রিকেট মাঠে নেওয়া প্রতিটা সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে পুনরায় টিভিতে দেখতেন এবং সেখানে কোনো ভুল থাকলে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সেটিকে পরবর্তীতে কাজে লাগাতেন।

ছেলেবেলায় কষ্ট আর অভাবে জর্জরিত পরিবারে বেড়ে ওঠা সেই কিংবদন্তি আম্পায়ারের নাম স্টিভ বাকনার। আইসিসির এলিট প্যানেলের অন্যতম সেরা এই আম্পায়ার তার ২০ বছরের ক্যারিয়ারে আম্পায়ার হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন রেকর্ড সংখ্যাকবার। তবে ক্রিকেট মাঠে আউটের সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সময় নেওয়ায় তিনি ‘স্লো ডেথ বাকনার’ হিসেবেই সুপরিচিত।

ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা এই আম্পায়ার ১৯৪৬ সালের ৩১ মে জ্যামাইকার মন্টিগো বে তে জন্মগ্রহণ করেন। এক জোড়ে জুতো পরেই সব কাজ করতেন তিনি। স্কুল চার্চ কিংবা যেকোনো জায়গায় সেই জুতো জোড়াই ছিলো তার অন্যতম সম্ভব। বেশ অভাবে জর্জরিত সংসারেই তিনি মানুষ হন। ফুটবল আর রেফারি আর ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে কাজ করার আগে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন বাকনার। মূলত ক্রিকেট আম্পায়ার হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত হলেও ফুটবলের সাথে ছিলো তার নিবিড় সম্পর্ক।

তিনি যে শুধু ফুটবল খেলেছেন এমনটাই নন। ফুটবল বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের মতো বড় ইভেন্টে তিনি রেফারির দায়িত্বও পালন করেছেন। ৬০ এর দশকে জ্যামাইকান পারিশ লিগে গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন বাকনার। ১৯৬৪ সালে তিনি স্কুলভিত্তিক আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে গোলরক্ষক হিসেবে জ্যামাইকার হয়ে খেলেছিলেন। সেই ম্যাচ জ্যামাইকা ১-১ গোলে ড্র করে। ১৯৮৮ ফিফা বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে এল সালভাদর এবং নেদারল্যান্ডসের ম্যাচে তিনি রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৮ মার্চ, ১৯৮৯।

অ্যান্টিগায় ভার‍ত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে অভিষিক্ত হন স্টিভ বাকনার। একই বছর ২৮ এপ্রিল ভার‍ত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ দিয়ে সাদা পোশাকে আম্পায়ার হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি। তার ২০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি বেশ সফল একজন আম্পায়ার ছিলেন। ক্যারিয়ার শুরু হতে না হতেই ১৯৯২ বিশ্বকাপে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি! সেবার বিশ্বকাপের ফাইনালে অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও আম্পায়ার হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এরপর ১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০০৩ এবং ২০০৭ বিশ্বকাপ – টানা পাঁচ বিশ্বকাপে তিনি সফলতার সাথে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পুরো ক্যারিয়ারে তিনি ৪৫ টি বিশ্বকাপ ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যখন থেকেই আইসিসির আম্পায়ারস এলিট প্যানেল গঠন করা স্টিভ বাকনার তখন থেকেই তার ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত এই প্যানেলের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। তখনকার আইসিসির জেনারেল ম্যানেজার ডেভ রিচার্ডসন বলেছিলেন এলিট প্যানেলের আম্পায়ার হিসেবে অ্যাক্যুরিসি রেট ৯৪.০৮% হওয়া দরকার ছিলো কিন্তু ২০০৫-০৬ সালে স্টিভ বাকনারের এক্যুরিসি রেট ছিলো ৯৬% ! ২০০৭ সালে বাকনার বর্ষসেরা আম্পায়ারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকলেও সেবার বর্ষসেরা আম্পায়ারের পুরষ্কার জেতেন সায়মন টফেল।

স্টিভ বাকনারের সাথে শচিন

টেস্টে স্টিভ বাকনার ১২৮ ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যা তার সময়ে ছিলো সর্বোচ্চ! তবে বর্তমানে সেই তালিকায় সবার উপরে আছেন আলিম দার (১৩২) ম্যাচ। ২০১৯ সালে স্টিভ বাকনারের সেই রেকর্ড ভেঙ্গে সবার উপরে অবস্থান করছেন আলিম দার। ওয়ানডেতে অবশ্য এই তালিকায় চার নম্বরে আছেন স্টিভ।

২০৯ ম্যাচে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করে সবার উপরে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার রুডি কোয়ের্টজেন। এরপর ২০৮ ম্যাচে দায়িত্ব পালন করে দুইয়ে আছেন পাকিস্তানের আলিম দার। ২০০ ম্যাচে দায়িত্ব পালন করা বিলি বাউডেন অবস্থান করছেন তিনে। এবং ১৮১ ম্যাচে আম্পায়ারিং করা স্টিভ বাকনার বর্তমানে চারে আছেন।

তবে ক্যারিয়ারে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে টি-টোয়েন্টি দায়িত্ব পালন করেননি বাকনার। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ আম্পায়ারিং করার তালিকায় সবার উপরে আছেন আলিম দার (৩৮৬), দুইয়ে আছেন রুডি কোয়ের্টজেন (৩৩১) এবং তিনে আছেন ৩০৯ ম্যাচে আম্পায়ারিং করা স্টিভ বাকনার।

ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারে যেমন বিতর্ক থাকে তেমনি আম্পায়ারদের ক্যারিয়ারে সেটা আরো বেশিই দেখা যায়। বেশ বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত দিলেও অনেক ক্ষেত্রেই আম্পারদের সিদ্ধান্তও ভুল প্রমাণিত হয়। যদিও বর্তমানে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য ডিআরএস বা ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম আছে। তবে আগে এই সিস্টেম না থাকায় ফিল্ড আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তই ছিলো চূড়ান্ত।

তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না। তেমনি আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন স্টিভ বাকনার! তবে তার বেশিরভাগই ছিলো ভারতের বিপক্ষে। যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বলা হয় ভারতীয়রা স্টিভ বাকনারকে দেখতে পারতেন না। এমনকি তাকে আম্পায়ার হিসেবেও চাইতেন না তাদের ম্যাচে।

২০০৮ সালে সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় ভারত। আর সেই টেস্টে আম্পায়ার হিসেবে ভুল সিদ্ধান্ত দেন স্টিভ বাকনার। রাহুল দ্রাবিড় ক্যাচ আউট হন যেখানে সেই বলটি তার প্যাডে লাগে! বাকনার বোলারদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আউট দেন। অপরাদিকে, অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু সায়মন্ডস আউট হওয়া সত্ত্বেও সেই ম্যাচে তাকে নট আউট দেন। মূলত এই দুই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভারত ক্ষোভ ঝারে এবং পরবর্তীতে তৃতীয় টেস্টে আইসিসি স্টিভ বাকনারকে বাদ দেয়।

২০০৫ সালে ইডেন গার্ডেনে পাকিস্তানের বিপক্ষে শচিন টেন্ডুলকার ব্যক্তিগত ৫২ রানে আউট হন। শচিন পরিষ্কারভাবেই নট আউট ছিলেন তবুও বাকনারের ভুল সিদ্ধান্তে তাকে ফিরতে হয়। আরেকটি ভিন্ন ঘটনায় ১৯৯৮-৯৯ সালে ইডেন গার্ডেনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে শোয়েব আক্তারের সাথে বাক-বিতন্ডায় জড়ানোতে শচিন টেন্ডুলকারকে আউট ঘোষণা করে বিতর্কের জন্ম দেন স্টিভ বাকনার।

অবশ্য এছাড়াও আরেকটি হাস্যকর বিতর্কিত আউট দেন তিনি! ১৯৯২-৯৩ সালে জোহানেসবার্গে এক টেস্টে জন্টি রোডসকে তিনি নট আউট ঘোষণা করেন। যেখানে রিপ্লে তে দেখা যাচ্ছিলো তিনি পরিষ্কার আউট!

তবে এই বিতর্ক পাশ কাটিয়ে যদি স্টিভ বাকনারের ২০ বছরের দীর্ঘ আম্পায়ারিংয়ের ক্যারিয়ার পর্যালোচনা করেন তাহলে আপনি বলতে বাধ্য যে তিনি সর্বকালের সেরা আম্পায়ারদের একজন। ফুটবলের গোলরক্ষক থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা আম্পায়ার বনে যাওয়া ক্যারিবিয়ান এই স্টিভ বাকনার এখন মাঠে নেই একেবারেই, তবে ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি বরাবরই আলোচিত হয়েই থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link