ডিসগ্রেস অফ গিওন, কলঙ্কের আড়ালে লুকনো এক স্বপ্ন সমাধি

রাজার নীতি কিংবা রাজনীতি। কে বলতে পারে, ম্যাচে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা অন্য কিছু হলে, সৃষ্টি হতেই পারত অন্য কাহিনী! অথচ কার্যত নোংরামির মাধ্যমে অঙ্কিত হল কাহিনীর শেষাংশ, যা কখনওই কাম্য ছিল না। ১৯৮২-র আলজেরিয়ার তাই ১৯৫৪-র জার্মানি হওয়া হয়নি, সম্ভবপর হয়নি ১৯৩৮-র অস্ট্রিয়াও। পাঁকে ভরা দুর্নীতি তাদের কবিতা লিখতে দেয়নি। ডিসগ্রেস অফ গিওন, ফুটবল ইতিহাসের দস্তাবেজে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই গাঁথা - যার গহীনে লুকিয়ে ছিল হাজারও মরুজনতার এক না পাওয়া স্বপ্নকে ছোঁয়ার জিওনকাঠি!

১.

১৯৮২। সদ্য টিভি এসেছে বাংলায়। পরের বছর গোটা ভারত জুড়ে উঠবে তুফান, বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম এশিয়ান কান্ট্রি হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে নেবে ভারত। তবে সে এক বছর পরে। ’৮২ সালে ভারতের ফুটবল অন্দরমহলে ঘটছে দুরন্ত রদবদল। তবে সে অন্য কথা।

আপাতত চোখ বাঁদিকে ঘুরিয়ে কালাপানি পেরিয়ে সোজা পশ্চিমে। সেখানে গনগনে মেজাজ প্রত্যেকের। বিশেষত স্পেনে। উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে কাঁপছে গোটা এসপানা। বেজে উঠছে দ্বাদশ বিশ্বকাপ ফুটবলের দামামা।

২.

চনমনে ফুটবলারটিকে সাইডলাইনে রাখার কথা শুরু থেকে কখনওই ভাবেননি আলজেরিয়ান কোচ। এ নিয়ে পরে একটি ইন্টারভিউতে বলেওছিলেন, ‘ওর ভিশন ছিল খুব ভাল। বয়সটা ফ্যাক্টর ছিল না, মনে হয়েছিল এ পারবে।’

নাম, রাবহ্ মাদজের। বছর ২৩-য়ের ফরোয়ার্ডটি যে এন.এ. হুসেন দে-তে খেলত, সে ক্লাবটা ১৯৮১-৮২ পর্যন্ত কখনও কোনও শিরোপা জেতেনি। জেতেনি কোনও লিগ, কোনও ডোমেস্টিক কাপ। অথচ ঐ ক্লাবেই নিজের প্রতিভার জাত চিনিয়েছিল এই মাদজের। পারফেক্ট জহুরির মতো স্কাউটের চোখ চিনতে ভুল করেনি হীরেটা। কোচিং ম্যানেজমেন্ট খুব তীব্র বুঝেছিল, এর ঘষামাজা দরকার। তাহলেই শাইন করবে। তাই-ই হয়েছিল ভবিষ্যতে।

৩.

গ্রুপ পর্বে তাবড় তাবড় নামের পাশে ইদানিং খবরের কাগজের আট নম্বর পাতার শেষে একটুখানি জায়গা যেমন বরাদ্দ থাকে মোহামেডানের আই লিগ পারফরমেন্সের জন্য, কার্যত সেভাবেই জায়গা হয়েছিল আলজেরিয়ায়। গ্রুপে আলজেরিয়ার সঙ্গে সহাবস্থানে ছিল চিলি, অস্ট্রিয়া এবং অদম্য জার্মানি। যারা বছর দুই আগেই ১৯৮০ তে ইউরো কাপ জিতে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে বিরাজ করছে।

অন্যদিকে আলজেরিয়া দল স্পেনে এসেছে শুধুই তিনটে ম্যাচ খেলতে। যাদের না আছে কোনও উচ্চাশা, না আছে কোনও মানসিক চাপ এবং ভাঁড়ারে নেই কোনও অভিজ্ঞতা। নেহায়েৎই ছোট টিম, বরাবর যা মানা হয় – ছোট টিমের দৌড় গ্রুপ পর্ব অবধিই।

তার বেশি আশা করা মানে, দুর্নিবার স্বপ্ন দেখা যা বাস্তবে সম্ভব হলেও হতে পারে। এই ‘হলেও হতে পারে’ ধারণাটা একবিংশ শতাব্দীতে ও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তৈরি হয়েছিল পাকাপাকি ভাবে, কিন্তু এই জার্নির সোনালী শুরুটা যারা করেছিল তাদের কপালে জুটেছিল দগদগে, পোড়া ঘা। আজও হয়তো একেবারে মিলিয়ে যায়নি সে দাগ।

৪.

গ্রুপ ২। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চিলি এবং আলজেরিয়া। সে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে স্পোর্টিং গিওনের হোম গ্রাউন্ডে মুখোমুখি জার্মানি-আলজিরিয়া। এককথায়, একপেশে ম্যাচ এবং পাল্লার ভারী দিকটা প্রচণ্ডভাবে জার্মানির। অভিজ্ঞ পল ব্রাইটনার, রুমেনিগে, হিংস্র কিপার টনি শ্যুমাখার এবং তরুণ লোথার ম্যাথাউস সমৃদ্ধ এ হেন জার্মানি দলের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসটাই কাল হয়ে দাঁড়াল, যখন বিশ্বকাপের একেবারে প্রথম ম্যাচে দুর্বলতম আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ এর পরাজয় বরণ করতে হল!

তৈরি হল এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস! বিশ্বকাপের প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে কোনও ইউরোপিয়ান জায়ান্ট দলকে হারাল আলজেরিয়ানরা। সৌজন্যে? বছর ২৩-য়ের চনমনে যুবক রাবহ্ মাদজের!

হতচকিত জার্মানির ঘুরে দাঁড়াতে যদিও বেশি সময় লাগেনি। পরের ম্যাচেই রুমেনিগের হ্যাটট্রিকে চিলিকে ৪-১ গোলে হারায় তারা। ওদিকে অস্ট্রিয়ার কাছে পরের ম্যাচে ২-০ তে আলজেরিয়া হারলেও, তৃতীয় এবং শেষ ম্যাচে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী চিলির বিরুদ্ধে ৩-০ তে এগিয়ে যায় তারা।

ম্যাচটা যদিও শেষ হয় ৩-২ তে, তবু তিন ম্যাচে দুটো জিতে একটা রিল্যাক্সড জায়গাতেই তারা থাকে। এবং তাকিয়ে থাকে গ্রুপের শেষ জার্মানি-অস্ট্রিয়া ম্যাচের দিকে। যে ম্যাচে অস্ট্রিয়া কোনওভাবে জার্মানিকে হারাতে পারলেই প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে আলজিরিয়া চলে যাবে পরের রাউন্ডে, তিন দলের গ্রুপে। টুইস্টের শুরু।

শেষ ম্যাচ, গিওনে। মুখোমুখি জার্মানি-অস্ট্রিয়া। খেলা শুরুর পর দেখা গেল, অস্ট্রিয়ার ডিফেন্সকে প্রায় হেলায় ছিন্নভিন্ন করে জার্মানি হর্স্ট হুরবেকের গোলে এগিয়ে গেল। সেটা ছিল ম্যাচের দশ মিনিট। বাকি ৮০ মিনিটে এত ধীরগতির খেলা হল, তাছাড়া অসংখ্য মিসপাস, শুধুই বল দেওয়া-নেওয়া এবং সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি লক্ষণীয় – কেউই গোল করতে উৎসুক নয়।

সেকেন্ড হাফে দু’প্রান্তের গোলে গিয়েছিল তিনটে শট, তার মধ্যে কোনওটাই ফুটবলের পরিভাষায় ‘অন টার্গেট’ নয় অর্থাৎ গোলমুখী শট নয়। এইভাবে বাকি সময় কাটাতে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া চলে গেল পরের রাউন্ডে, শত শত আলজিরিয়ানের চোখে ঘুরতে থাকা এক স্বপ্নের নিপাট সলিলসমাধি।

বিশ্ব ফুটবলে এই ঘটনা কলঙ্কিত হয়ে রয়েছে ‘দ্য ডিসগ্রেস অফ গিওন’ বা ‘গিওনের অপমান’ হিসেবে। এর জন্য কটাক্ষে বিদ্ধ হতে হয়েছিল ঐ ম্যাচের রেফারি বব ভ্যালেন্টাইনকেও। তিনি কোনও রকম হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা দেখাননি, সৌজন্যমূলক খেলা খেলার জন্য কোনও রকম ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। এ নিয়ে পরে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে, কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে। লোথার ম্যাথাউজ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গেছেন বিষয়টা।

রুমেনিগের অধর থেকেও কোনও শব্দ আসেনি। আলজিরিয়া প্রেসিডেন্ট ফিফার দপ্তরে অভিযোগ জানানোর পর। পরের ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ থেকে গ্রুপ পর্বের শেষ রাউন্ডের সমস্ত ম্যাচ একসাথে খেলার নিয়ম ঘোষণা করে ফিফা। সে নিয়ম আজও ক্রমবর্ধমান।

এই বিশ্বকাপেই জার্মানি আরও একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায়। বলা ভাল, জার্মানির গোলকিপারের বদান্যতায় ঘটেছিল। সেমিফাইনালে ফরাসি ফরোয়ার্ড বাতিস্তঁ একটা বল তাড়া করে জার্মান গোলের দিকে ছুঁটলে, কিপার শ্যুমাখার এসে সোজা বাতিস্তঁর বুকে হাঁটু তুলে দেন। মাঠেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন বাতিস্তঁ।

ম্যাচটা পেনাল্টিতে গড়ায়, ফ্রান্সকে হারিয়েছি ফাইনালে মাদ্রিদে জার্মানি মুখোমুখি হয় ইতালির। কিন্তু এই ভয়ানক ঘটনায় রেফারি না কার্ড দেখিয়েছিলেন শ্যুমাখারকে, কোনও ভ্রূক্ষেপ ছিল না জার্মান দলের। লোথার ম্যাথাউজের কথায় – আমরা ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলাম। এটা নিয়েই কথা হওয়া উচিত!

তার অনেক বছর, ২০১৬ ইউরো কাপ সেমিফাইনালে এর বদলা নিয়েছিল ফ্রান্স। এই যে ছোট দল, ছোট টিম টার্মগুলো— প্রচণ্ড আক্ষেপের সুরে বলা উচিত যে এই টার্মগুলো মনে বড় আঘাত সৃষ্টি করে। দুনিয়ায় কেউ ছোট নয়। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী এবং দুর্জয় শক্তিতে ভরা ইতালিকে হারিয়ে জার্মানির সাথে সেমিফাইনালে চলে গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।

সেই দক্ষিণ কোরিয়াই রাশিয়ায় ইতিহাস সৃষ্টি করবে জার্মানিকে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় জানিয়ে। ১৯৮২-র আলজিরিয়া সেই স্বপ্নের কারিগর। শক্তিহীন দল এবং ভরসাহীন খেলোয়াড় ছাড়া এতটা পথ পেরিয়ে এসে জয়গান লিখতে বসা আলজিরিয়ার স্বপ্নকে পিষে মেরে ফেলা হল গিওনে।

রাজার নীতি কিংবা রাজনীতি। কে বলতে পারে, ম্যাচে খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা অন্য কিছু হলে, সৃষ্টি হতেই পারত অন্য কাহিনী! অথচ কার্যত নোংরামির মাধ্যমে অঙ্কিত হল কাহিনীর শেষাংশ, যা কখনওই কাম্য ছিল না।

১৯৮২-র আলজেরিয়ার তাই ১৯৫৪-র জার্মানি হওয়া হয়নি, সম্ভবপর হয়নি ১৯৩৮-র অস্ট্রিয়াও। পাঁকে ভরা দুর্নীতি তাদের কবিতা লিখতে দেয়নি। ডিসগ্রেস অফ গিওন, ফুটবল ইতিহাসের দস্তাবেজে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই গাঁথা – যার গহীনে লুকিয়ে ছিল হাজারও মরুজনতার এক না পাওয়া স্বপ্নকে ছোঁয়ার জিওনকাঠি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...