পরিসংখ্যান তাঁকে সেরা মানে

১.

১৪ আগস্ট, ১৮৮৬।

লন্ডনের পড়ন্ত বিকেল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি ইংল্যান্ড।

ডব্লিউ জি গ্রেস আর ওয়াল্টার রিডের ইনিংসের সুবাদে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস শেষ হয় ৪৩৪ রানে। মাঠে খুব বেশি দর্শক নেই, মেরেকেটে হাজার পাঁচেক হবে। যাই হোক প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামল অজিরা। নতুন বলে জনি ব্রিগসের সঙ্গী সেই সিরিজেই অভিষিক্ত জর্জ লোহম্যান।

প্রথম ওভারেই ওপেনার স্যামি জোন্সকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে লোহম্যান বুঝিয়ে দিলেন কেন তার উপর ভরসা করেন ডব্লিউ জি গ্রেস। কিছুক্ষণ পর অজি দলপতি টাপ স্কটকে বোকা বানালেন খাটো লেংথের এক বলে। দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে উপড়ে ফেললেন জন ট্রাম্বলের স্ট্যাম্প। ওপাশ থেকে জনি ব্রিগসও চালাচ্ছিলেন তান্ডব। ফলশ্রুতিতে অজিরা অলআউট ৬৮ রানে! ইংল্যান্ডের বোলিং স্কোরকার্ড ছিল এমন:

  • জর্জ লোহম্যান: ৩০.২-১৭-৩৬-৭-১.৭৭
  • জনি ব্রিগস: ৩০-১৭-২৮-৩-১.৪০

এ দুজনের তাণ্ডববলীলা দেখে ইংলিশ দলপতি ডব্লিউ জি গ্রেস আর কাউকে বোলিংয়েই আনেননি। ফলোঅনে পড়ে অজিরা ব্যাটিংয়ে নামলে পুনরায় এ দুজনের বোলিং তোপে পড়ে অলআউট ১৪৯ রানে। লোহম্যান নেন ৫ উইকেটে এবং ব্রিগস তিনটি।

ইংল্যান্ড ম্যাচ জেতে ইনিংস এবং ২১৭ রানে।

২.

জর্জ লোহম্যান ছিলেন লম্বা, কমনীয়, সোনালী চুল, সুদর্শন এককথায় নারীদের কাছে অপ্রতিরোধ্য। সারের লোকজন তাকে আদর করে ডাকত ‘আমাদের জর্জি’। ২৬ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়া সফরের পরে ইংলিশ অধিনায়ক জি গ্রেস বলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত নারীই যেন লোহম্যানের প্রেমে পড়ে গিয়েছে।

তার কৌতুকবোধও অসামান্য। একবার খেলার মাঠের পাশেই মেলা চলছিল। ম্যাচ তখন প্রায় শেষের দিকে, শেষ জুটির খেলা চলছে। লোহম্যান তখন ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ফিল্ডিং করছেন, তার ঠিক পেছনেই নারিকেলের দোকান। হঠাৎ বল তার দিকে আসলে তিনি উইকেটরক্ষকের দিকে থ্রো করেন এবং ব্যাটসম্যান রানআউট হন। মজার ব্যাপার হলো লোহম্যান বল দেখেনই নি, তিনি সবার চিৎকার শুনে হাতে থাকা নারকেলই থ্রো করেন এবং উইকেটকিপার সেটা দিয়েই স্ট্যাম্প ভাঙেন। মাঠে থাকা কেউ ব্যাপারটা বুঝতেই পারেননি।

নিজের সময়ে লোহম্যান ইংল্যান্ডের সম্ভবত পুরো বিশ্বের সেরা বোলার ছিলেন। মাত্র ১৮ টেস্টে তিনি ১১২ উইকেট শিকার করেন। তার গড় ১০.৭৫ এবং প্রতি ৩৪ বলে একটি করে উইকেট নিয়েছেন – দুটোই কমপক্ষে ১৫ উইকেট নিয়েছেন এদের মাঝে সেরা। যারা তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সবাই একবাক্যে সেরা বলে মেনে নিয়েছেন। জনি ব্রিগসকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক জুটি।

মিডিয়াম পেসে টানা এক জায়গায় বল করে যাওয়া এবং দুদিকে সুইং করাতে পারার ক্ষমতা তখনকার স্টিকি পিচে তাকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য। এছাড়াও তিনি ছিলেন সে সময়ের সেরা স্লিপ ফিল্ডারদের একজন। নিচের দিকে নেমে ব্যাটিংয়ে ঝড় তুলতেও তার জুড়ি মেলা ভার।

৩.

জর্জ লোহম্যানের জন্ম ১৮৬৫ সালের ২ জুন, কেনসিংটনের ক্যাম্পডেন হিল রোডে। ক্রিকেটের সাথে তার পরিচয় খুব আকস্মিকভাবে। ছোটবেলার তার এক বন্ধু স্থানীয় ক্রিকেট ম্যাচে সুযোগ পেলে তিনি তার বন্ধুকে সঙ্গ দিতে মাঠে যান। সেখানে নেটে শখের বশে কিছুক্ষণ ব্যাট করার দলের কোচ তাকে ম্যাচ খেলতে আবদার করে বসেন। মূলত সেখান থেকেই তার ক্রিকেট যাত্রা শুরু। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই বোলারের কিনা যাত্রা শুরু হয়েছিল পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবে।

১৮৮৪ সালে কাউন্টিতে সারের হয়ে অভিষেক হয় তাঁর। নিজের প্রথম মৌসুমে তেমন নজরকাড়া পারফরমেন্স দেখাতে পারেননি তিনি। তবে পরের মৌসুমেই জ্বলে উঠেন তিনি, ১৪২ উইকেট নিয়ে হন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। পাশাপাশি ব্যাট হাতেও করেন ৫৭১ রান। নিজের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে এসসিজিতে লোহম্যান প্রথম বোলার হিসেবে এক ইনিংসে আট উইকেট নেন।

অস্ট্রেলিয়ায় সেই সফরে তিনি মাত্র ১১ গড়ে শিকার করেন ৪১উইকেট। ১৮৮৭ মৌসুমে তিনি নেন ১৫৪ উইকেট যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল ১১৪ উইকেট। এমনকি ব্যাট হাতেও দুই সেঞ্চুরিতে করেন ৮৪৩রান। ১৮৮৮ সালে লোহম্যান ছিলেন আরো বিধ্বংসী, সে মৌসুমে মাত্র ১০.৯০ গড়ে নেন ২০৯ উইকেট!

১৮৯১ মৌসুম শেষে তার সংগ্রহ ছিল ১৪ টেস্টে ১২.৮৩ গড়ে ৭৪উইকেট। তার বয়স তখন মাত্র ২৬ এবং ক্যারিয়ার শেষে তার উইকেটসংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ ছিল নাহ।

৪.

১৮৮৬ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে তিনি প্রায় ১৫০০ ওভার বল করেন। একজন পেসারের জন্য যা কিনা অকল্পনীয় এক সংখ্যা। ডব্লিউ জি গ্রেস তাকেঁ একবার বিরতি দিতে চাইলে তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আমাকে অপরপ্রান্ত থেকে বল করাতে চাইছো?’ লোহম্যানের কাছে বিরতির মানে ছিল বোলিংয়ের প্রান্তবদল করা। ক্রিকেটের প্রতি এমনই ছিল তার আগ্রহ-ভালোবাসা।

এমনকি টেস্ট এবং প্রথম শ্রেণির খেলা না থাকলে তিনি গ্রামের খেলা কিংবা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে বেড়াতেন। এই টানা খেলার ধকল প্রথম প্রকাশ পায় ১৮৯২ সালে নটিংহ্যামশায়ার বনাম অক্সফোর্ডের ম্যাচে বোলিং করার সময়, যখন তিনি প্লুরেসিতে আক্রান্ত হন। এরপরই তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে ডাক্তাররা তাকে তিন-চার বছর ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে বলেন। তিনি এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যান।

অবশেষে ১৮৯৬ সালে লোহম্যান পুনরায় সারের হয়ে খেলা শুরু করেন। সে মৌসুমে তিনি ৯৩ উইকেট নেন। কিন্তু মৌসুমের শেষের দিকে পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। টেস্ট ক্রিকেটে ১০০ উইকেট পাওয়া দ্রুততম বোলার তিনি, মাত্র ১৬ টেস্টেই এই কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। এছাড়াও ১৮৮৯ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার ছিলেন তিনি।

অবসর নেয়ার পর তিনি পুনরায় দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেলেও ১৯০১ সালে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দলের ম্যানেজারও ছিলেন তিনি। তবে তার স্বাস্থ্য কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠেনি, এমনকি কেপটাউনে আসার পর তার শারীরিক অবস্থা আরো জটিল হয়ে পড়ে। ১৯০১ সালের ১ ডিসেম্বর নয় বছর যক্ষ্মার সাথে লড়াই করে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান এই ক্রিকেটার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link