অধিনায়ক হেসে বলেছিল — এই রসগোল্লা, তুই শুধু জল বয়ে বেড়াবি! লোকটা মাথা তুলেছিল, একটু রাগ, একটু অবাক। ঘাড়ের রগটা বেকে গিয়েছিল তখনই। একটা সুযোগ পেয়ে তিন রানে আউট, বাদ পড়ল।
কিন্তু, এই ছেলে অন্য ধাতুর গড়া। তাঁকে চ্যালেঞ্জ দিলে সেটা ছায়ার মতো অনুসরণ করে—আর শেষে জিতে আসে। তাই চার বছর পর যখন লর্ডসের সিঁড়ি বেয়ে নামছিল সে, ফিসফাসে ভরে উঠেছিল চারপাশ, বলছিল, ‘বাংলার কোটা’।
বিষাক্ত সুইং, স্যাঁতস্যাঁতে পিচ—সব সাজানো ছিল। কিন্তু যারা তাঁকে শেষ করতে চেয়েছিল, তারা জানত না—বাঙালি রসগোল্লার ভেতরে ইস্পাত ধরে রাখতে পারে। ব্যাট যখন সিল্কের মতো ঝলকে উঠল, আর কভার বাউন্ডারি একের পর এক আলোয় ভেসে গেল—সব ফিসফাস থেমে গেল। শতরান ছুঁতেই জন্ম নিল প্রিন্স অব ক্যালকাটা। জন্ম হল বাংলার অবিসংবাদিত মহারাজের – সৌরভ গাঙ্গুলি। ঘাড়ের রগটা তাঁর চিরকালই বাঁকা। ওটাই তাঁর ইউএসপি।
তারপর এল অভিশপ্ত ১৯৯৯। ভারতীয় ক্রিকেট উঠল ভেঙে-চুরে। শচীন টেন্ডুলকার সরে গেলেন নেতৃত্ব থেকে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ডুবে গেলেন কেলেঙ্কারিতে। আর এলো আবার সেই সংশয়। ‘কোটা’র মহারাজের কোর্টেই তখন বল, জবাব দিলেন, ‘পারব’। তিনি পেরেছিলেন। তিনি বদলে দিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেট মানচিত্র। গাঙ্গুলির সৌরভে ভরে গিয়েছিল ভারতের ক্রিকেট।

এভাবেই জন্ম নিল ভারতের নতুন যুগ। ৪৯ টেস্টে ২১ জয় — তার মধ্যে ১৩ টাই বিদেশে। পাকিস্তানকে পাকিস্তানেই হারানো, স্টিভ ওয়াহর চোখে চোখ রেখে ফলো-অন ফিরিয়ে নেওয়া, আর লর্ডসের ব্যালকনিতে সেই কিংবদন্তি জামা ওড়ানো—সবই সেই লোকটার কাজ।
তারপর আবার অন্ধকার। গ্রেগ চ্যাপেলের ছুরিকাঘাত, রাজনীতি, বিদ্বেষ—সব মিলিয়ে আবার তাকে ছুঁড়ে দেওয়া হলো মাঠের বাইরে। ঘাড়ের রগটা তখনও বেইমানী করেনি। তিনি রঞ্জি খেলেছেন, অধিনায়কত্ব হারিয়েও লড়াই করার শক্তি তাঁর চিরকালই ছিল।
অনেকেই এমন সময়ে মাথা নিচু করে চলে যায়। কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলির রসায়ন আলাদা। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে, ধুলোবালি খেয়ে, মাটির ঘ্রাণে ভিজে রঞ্জিতে লড়ে গেল—শুধু এটা প্রমাণ করতে যে আগুন এখনো নেভেনি।
আগুন জ্বলে উঠল দাও দাও করে। তিনি ফিরে আসলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রিনটপে অপরাজিত অর্ধশতরান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরি—সবই তার প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা। তবু, আবার চোখ রাঙানি। আবার বাদ।

শেষ পর্যন্ত অধিনায়ককে বললেন, ‘এটাই শেষ সিরিজ। অস্ট্রেলিয়ার পর আর খেলবা না। শুধু এই সিরিজটা খেলতে দাও।’
চ্যালেঞ্জ এল। এবং কি আশ্চর্য—তিনি আবার জিতলেন। নাগপুরের শেষ টেস্টে ৮৫ রান। তারপর আলো নিভে গেল। শেষ মঞ্চের আলো নিভে এল।
রবি শাস্ত্রী এক সময় সরাসরিই বলেছিলেন, ‘কোটার মাল’। অন্দরমহলে ক্যারিয়ারের বড় একটা সময় শুনেছেন ‘কলকাতার রসগোল্লা’ নামের তাচ্ছিল্য। তারাও হয়ত জানতেন না, এই ছেলেটার ভেতর আগুন আছে, যা সময়মতো জ্বলে উঠলে সবার মসনদ উড়ে যাবে। শোয়েব আখতার নিজের আত্মজীবনীতে সত্যিই বলেছেন, ‘শরীরটা মানুষের, কিন্তু ভেতরের খাঁচাটা দানবের।’
সম্বরণ ব্যানার্জি সেই আগুনটাই চিনেছিলেন। নিজের বঞ্চনার বদলা তিনি সুদে-আসলে শোধ করেছিলেন সৌরভকে ভারতীয় দলে ঢুকিয়ে। ২০০০ থেকে ২০০৮—ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা অধ্যায়। কারণ একটাই—সৌরভ গাঙ্গুুলি, তিনি ভারতকে সাহসী করে রেখে গেছেন, যে সাহস আজও গুলে খাচ্ছেন বিরাট কোহলি কিংবা অভিষেক শর্মারা।

শেবাগকে সুযোগ দেওয়া, ধোনিকে ওপরে তুলে আনা, ভাজ্জি–কুম্বলেকে বিদেশে খেলাতে আঁটসাঁট নেতৃত্ব—সবকিছুতেই তার সাহস, তার দূরদৃষ্টি। আর রাজনীতি তো তাঁর সাথে মিশেই ছিল। তার বিরুদ্ধে থেকেছে সবসময়ই—চ্যাপেল, শ্রীনিবাসন, মায়াপ্পন, ভে সরকার, যে কারণে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ওয়ান্ডার্সে টস জয়ের পর ফিল্ডিং নেওয়ার ভুলই হয়ে গেল তার একমাত্র অপরাধ।
অবসর ঘোষণার পর বলেছিলেন, ‘আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাব।’ কী ভয়ংকর সত্য! একজন ক্রিকেটার সারা জীবন শান্তিতে ক্রিকেটটাই খেলতে পারেননি। কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলীর গল্প এখানেই শেষ হয়? কখনোই নয়। যে মানুষ বারবার পতন থেকে উঠে এসে ব্যাট তুলে দাঁড়িয়েছে, তাকে সময়ও ভাঙতে পারেনি।
তিনি ফিরেছেন নানা রূপে, লর্ডসের সেঞ্চুরিতে, ব্যালকনির উন্মত্ত জার্সি উড়ানে কিংবা বোর্ডের মসনদে বসা সভাপতির রূপে। শান্তির ঘুম তাঁর জীবনে আদৌ আসেনি। সম্রাট শান্তিতে ঘুমাতে চাইলে রাজ্য চলবে কি করে। আর যে সম্রাটের ঘাড়ের রগ বাঁকা, তাঁর ঘুম আসা কি এত সহজ!










