রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি ফুটবলের বিলুপ্তপ্রায় এক ঘরানার ফুটবলার।
আমি এটা লিখতে ঘৃণা বোধ করছি; এমনকি এটা চিন্তা করতেও। ক্রীড়াক্ষেত্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বর্তমান ফুটবলে চিরায়ত সেন্টার ফরোয়ার্ডের জায়গাটা ক্রমশই কমে আসছে। খেলোয়াড়েরা এখন জিমন্যাস্টে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কেবলমাত্র সেন্টার ফরোয়ার্ড বা টার্গেটম্যান হিসেবে খেলার সুযোগ কমে যাচ্ছে। ফরোয়ার্ডরা এখন অনেক বেশি পায়ের কারুকার্য দেখায় এবং আক্রমণভাগের যেকোনো পজিশনে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কোচেরা এখন সেই ধ্যানধারণা থেকে সরে এসেছে যেখানে একজন শারীরিকভাবে শক্তিশালী সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলানো হতো; এককথায় ক্ল্যাসিকাল নাম্বার নাইন যাকে বলে।
রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি ক্ল্যাসিকাল নাম্বার নাইনের সর্বশেষ শিল্পী। লেওয়ান্ডস্কি হেড করতে পটু, দুপায়ে সমান দক্ষ, দারুণ গতিশীল, আক্রমণভাগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করেন, ফ্রি কিক থেকে গোল করেন, পেনাল্টিতেও সমান দক্ষতা এবং সর্বোপরি দেশ এবং ক্লাবের হয়ে ঈর্ষণীয় গোল রেকর্ড। সবমিলিয়ে একজন পারফেক্ট সেন্টার ফরোয়ার্ডের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছেন লেওয়ান্ডস্কি। এই ধাঁচের ফুটবলাররা যদি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে থাকেন, তবে লেভা হচ্ছেন টাইনোসেরাস রেক্স। আমি তাকে মাঠে দেখতে দারুণ পছন্দ করি। আমি সম্ভবত তার খেলার ধরণটাও বুঝতে পারি।
সর্বশেষ দশকের সেরা দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো; তর্কযোগ্যভাবে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার। তারা দুজনেই সব ধরনের টুর্নামেন্টে প্রচুর গোল করলেও কেউই কিন্তু পারফেক্ট সেন্টার ফরোয়ার্ড নন।
একই কথা খাটে লিভারপুলের দুই আফ্রিকান তারকা মোহাম্মদ সালাহ এবং সাদিও মানের ক্ষেত্রেও, তারা দুজনেই প্রথাগত উইং ধরে আক্রমণ করেন এবং সুযোগ পেলেই বক্সে ঢুকে শট নেন। অন্যদিকে হ্যারি কেন, রোমেলু লুকাকু, এডিনসন কাভানি কিংবা হালের আর্লিং হ্যালান্ডরা এখনো নিজেদের পরবর্তী পর্যায়ে নিতে পারেননি।
সবসময়ের মতোই খেলার ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে, কোচদের নিত্যনতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটছে মাঠে। আজকের তরুণ হয়তো একসময় বলবে, আহা! আমাদের সময় কত দারুণ ফুটবলই না হতো। এটা আমাদের সকলের সাথেই ঘটে। ফুটবল আগের চেয়ে কম শারীরিক এবং ফাউলের কড়াকড়ি থাকা, প্রেসিং ফুটবলের প্রতি কোচদের অতি আগ্রহ; এসব ব্যাপারগুলোই তথাকথিত সেন্টার ফরোয়ার্ডদের ‘আউট অফ ফ্যাশন’ করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক ফুটবলেরও বিশাল ভূমিকা আছে এতে। আগের আসরের জয়ী দলগুলোর ট্যাকটিক্স পরবর্তি আসরে অনুকরণ করার একটা প্রবণতা দেখা যায় দলগুলোর মাঝে। ২০১২ ইউরোর ফাইনালে স্পেন খেলেছিলো কোনো ফরোয়ার্ড ছাড়াই, সবার সামনে ছিলেন ‘ফলস নাইন’ পজিশনে খেলা সেস্ক ফ্যাব্রেগাস যিনি কিনা আদতে একজন মিডফিল্ডার।
সম্প্রতি ‘অল ইংল্যান্ড’ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল ম্যানচেস্টার সিটি এবং চেলসি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো দুটো দলই কোনো সেন্টার ফরোয়ার্ড ছাড়াই খেলতে নামে, গত কয়েক দশক আগেও যেটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার।
কাই হ্যাভার্টজ যিনি কিনা ফলস নাইন কিংবা ফ্রি রোলে খেলতে পছন্দ করেন তাকে কেন্দ্র করে আক্রমণ সাজায় টুখেলের চেলসি। অন্যদিকে দলে সার্জিও আগুয়েরো এবং গ্যাব্রিয়েল জেসুসের মতো সেন্টার ফরোয়ার্ডকে বেঞ্চে বসিয়ে গার্দিওলা শুরু করেন ফিল ফোডেনকে সামনে রেখে। এবং এখন বর্তমানে বেশিরভাগ দলই এভাবে খেলছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মৌসুম শেষ হবার সাথে সাথেই দুই দলই পারফেক্ট সেন্টার ফরোয়ার্ডের খোঁজে নেমেছে। গুঞ্জন আছে হ্যারি কেইন এবং আর্লিং হ্যালান্ডকে দলে ভেড়াতে দুই দলই দলবদলের নতুন রেকর্ড গড়তেও রাজি। গোল করা ফুটবলের সবচেয়ে কঠিন কাজ, আর এজন্যই এই গোলমেশিনদের দল ভেড়াতে অর্থের কার্পণ্য করছে না কোনো দল।
পাশাপাশি এটাও বোঝা যায় দুই দলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সেন্টার ফরোয়ার্ডেই। মৌসুম শেষ হবার পরপরই বোঝা যাচ্ছে গার্দিওলা আর আগুয়েরোর উপর ভরসা রাখছেন না। এই আর্জেন্টাইন বুড়িয়ে যাচ্ছেন এবং পুরো মৌসুম জুড়েই ইনজুরির সাথে লড়াই করে গেছেন।
আগুয়েরোর রিপ্লেসমেন্ট পেতে তাই মরিয়া সিটিজেনরা। অন্যদিকে টুখেলের হাতে অবশ্য অলিভিয়ের জিরুড এবং ট্যামি আব্রাহামের মতোন স্ট্রাইকার আছেন। কিন্তু টুখেল তাদের নিয়মিত খেলানোর ভরসা পাচ্ছেন না; যে আস্থা তিনি রাখতে পারবেন আর্লিং হ্যালান্ডের উপর। অন্যদিকে সিটি সম্ভবত হ্যারি কেইনকে দলে ভেড়াবে।
যদিও এটি কোনো ‘টেকটোনিক শিফটের’ মতো ব্যাপার নয়। আর এই দলবদলের ফলেও বিশ্ব আগের সেই নাম্বার নাইনের ফুটবলে ফিরে যাবে না। এর মাঝেও আমি আশা করবো হ্যারি কেইন গত বিশ্বকাপের মতোই এবারের ইউরোতে সর্বোচ্চ গোলদাতা হবেন এবং পাশাপাশি আমি লেওয়ান্ডস্কির দিকেও নজর রাখবো যে কিনা সদ্যই মেসি এবং রোনালদোকে পেছনে ফেলে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু জিতেছে।
রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি বুন্দেসলিগায় দারুণ এক মৌসুম কাটিয়ে এবারের ইউরোতে খেলতে এসেছেন, এই মৌসুমে ভেঙেছেন জার্ড মুলারের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। জার্ড মুলার, ‘ডার বম্বার’ যার এক মৌসুমে ৪০ গোলের রেকর্ড টিকে ছিল প্রায় ৫০ বছর। ৪১ গোল করে সেই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন লেভা, হাঁটুর ইনজুরিতে প্রায় এক মাস মাঠের বাইরে থাকা সত্ত্বেও। সামনের আগস্টে ৩৩ এ পা দেওয়া লেভা এখনো থেমে যাবার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছেন নাহ।
এটা সত্য, তিনি ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় খেলেছেন দুধর্ষ বায়ার্নের হয়ে যারা কিনা টানা এক দশক যাবত টানা শিরোপা জিতেছে। কিন্তু ফর গডস সেক, তার পরিসংখ্যান অনবদ্য, ৬৯৬ ম্যাচে ৪৮৪ গোল দুর্দান্ত এক টার্গেটম্যানের পরিচয় দেয়। কেবল বায়ার্নের হয়েই নয়, জাতীয় দল পোল্যান্ডের জার্সিতে ১১৯ ম্যাচে ৬৬ গোল প্রমাণ করে তিনি কতটা বিধ্বংসী।
লেওয়ান্ডস্কি একটা যন্ত্রের মতো, যে কিনা আউটপুট হিসেবে কেবল গোল করে যায়, ভরসা এবং ধারাবাহিকতার এক বিমূর্ত প্রতীক। গত ১১ মৌসুম ধরে তিনি কেবল এক মৌসুম বাদে প্রতি মৌসুমে ত্রিশের অধিক গোল করেছেন। যে মৌসুমের ত্রিশে পৌঁছুতে পারেননি, সে মৌসুমেও তার গোল ছিল ২৯টি! তিনি বড় ধরনের কোনো ইনজুরিতেও পড়েননি। আমি এখনো তার ফিটনেস লেভেল দেখে ঈর্ষান্বিত হই।
‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’-আমি এই ব্যাপারটি তীব্রভাবে বিশ্বাস করি এবং নিজের মাঝে লালন করি। শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছানো এক জিনিস আর সেখানে বছরের পর বছর নিজেকে টিকিয়ে রাখা আরেক জিনিস।
এপ্রিল মাসে ছোট ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থাকা তার এবং পোল্যান্ড দুজনের জন্যই খুব উপকারী হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। ১৯৯৬ ইউরো শুরুর পাঁচ কিংবা ছয় সপ্তাহ আগে আমাকে হার্নিয়ার অপারেশনের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়।
অপারেশনের পর আমি ফিটনেস ফিরে পাবার জন্য আলাদাভাবে অনুশীলন করি। টানা খেলার মাঝে ক্লান্তিকর একটা মৌসুম কাটানোর পর ইউরো শুরুর আগে অপারেশনের দরুণ এরকম একটা বিশ্রাম আমার জন্য প্রয়োজন ছিল। যার ফলশ্রুতিতে দারুণ একটা ইউরো কাটে আমার, সেবারের ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা হই আমি।
মাঝারি মানের দল হিসেবে পোল্যান্ডকে নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করা কঠিন। তিন বছর আগের বিশ্বকাপে তারা জঘন্য ফুটবল খেলেছে, নিজেদের গ্রুপে সবার তলানিতে থেকে শেষ করে। লেওয়ান্ডস্কি নিজেও ছিলেন ছায়া হয়ে, কোন গোল করতে পারেননি বিশ্বকাপে।
এবারের ইউরোর বাছাইপর্বে অবশ্য দারুণ খেলেছে পোলিশরা, নিজেদের গ্রুপে শীর্ষে থেকেই ইউরোতে খেলতে এসেছে। ব্রিজচেকের স্থলে পাওলো সৌউসা কোচ হয়ে আসার পর তাদের খেলায় উন্নতি দেখা গেছে। যদিও ইউরোতে তাদের গ্রুপে স্পেন রয়েছে যারা কিনা পুরো টুর্নামেন্টেরই অন্যতম ফেবারিট দল, তবে বাকি তিনটি দলই সমশক্তির হওয়ায় তাদের যে কেউই নকআউটে কোয়ালিফাই করতে পারে।
আপনি এটা ভেবে নিতেই পারেন পোল্যান্ডের ভাগ্য পুরোটা নির্ভর করছে লেওয়ান্দস্কির উপর, তাদের অধিনায়ক এবং ইতিহাসের অন্যতম সেরা লেভা জ্বলে উঠলেই কেবল জিতবে পোল্যান্ড। পোল্যান্ড বায়ার্নের মতো শক্তিশালী কোনো দল নয় বরং তাদের তুলনা হতে পারে গ্যারেথ বেলের ওয়েলশের সাথে। লেওয়ান্ডস্কি তার দেশের একমাত্র আশা, পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই এই আশার চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।
কয়েকদিন আগে সার্জিও আগুয়েরোকে নিয়ে লেখার সময় আমি বলেছিলাম একজন পারফেক্ট স্ট্রাইকার জানেন তিনকাঠির ঠিক কোথায় বলটা রাখতে হবে এবং লেওয়ান্ডস্কি এ ব্যাপারে রীতিমতো একজন শিল্পী। বক্সের ভেতরে তার নড়াচড়া অনবদ্য। প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের কড়া মার্কিংয়ের মাঝেও শেয়ালের মতো ধূর্ত হয়ে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে নিতে তিনি সিদ্ধহস্ত।
এটা ভাগ্যের কোনো ব্যাপার নয় কিংবা কাকতালীয় কোনো ঘটনা নাহ; এটা হচ্ছে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকার এক দারুণ কৌশল। তার গোলগুলো খেয়াল করলে আপনি এটা বুঝতে পারবেন, ডিবক্সে প্রচুর ডিফেন্ডার অথচ গোল করার সময় লেভার আশেপাশে কেউ নেই, আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ফাঁকা জায়গা বের করে ফেলেছেন।
কিছুটা হয়তো তার সহজাত প্রতিভা, কিন্তু বক্সের মাঝে তিনি পাকা গোলশিকারীও বটে। ২০ গজের মধ্যে থেকে বল জালে জড়াতে তার জুড়ি মেলা ভার। আপনি কোনোভাবেই তাকে বক্সে ফাঁকা জায়গা দিতে পারেন নাহ। যদি দেন, তাহলে আপনি ওখানেই খতম! ম্যাচ বের করে নিয়ে যাবেন লেওয়ান্ডস্কি।
গোলার মতো শট নিতে পারা তার আরেকটি বিশেষ দক্ষতা। তার শটে যে গতি থাকে সেটা বুঝবার সাধ্য কারো নেই। গোলকিপার বা ডিফেন্ডাররা যতক্ষণে প্রতিক্রিয়া দেখান ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বল জালে জড়িয়ে গেছে!
যখন আপনি বক্সের মাঝে ফাঁকায় যাবার দক্ষতা এবং গতির সাথে শারীরিক সক্ষমতা আর জোরালো শটের ব্যাপারটা একত্রিত করবেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারের কাছে তখন ডিবক্স নরক হয়ে উঠবে। লেওয়ান্ডস্কি এই কাজে বিশ্বের অন্যতম সেরা।
আমি আশা করি কেইন এবং লুকাকু অনেক গোল করবে এবং খেলার এই দিকটি সবাইকে মনে করিয়ে দেবে। নাম্বার নাইন এখন মৃতপ্রায় এক শিল্প। অনেকদিন বেঁচে থাকুক নাম্বার নাইনের এই শিল্প।
_______________
সাবেক ইংলিশ গ্রেট অ্যালান শিয়েরার কলামটি লিখেছেন ‘দ্য অ্যাথলেটিক’-এ।