গ্রেস-পরবর্তী যুগের সেরা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যার ব্যাটিং গড় ছিল ৩৫। তবে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল তিনি ‘ইনফর্ম’ সিডনি বার্নসের বিপক্ষে রান করেছেন। বার্নস যে সিরিজে ৪৯ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন, ওই একই সিরিজে পাঁচ শতাধিক রান করে ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন হার্বি টেলর৷ অনেকের মতে, হার্বি টেলরই নাকি সর্বপ্রথম ব্যাটসম্যান যিনি ‘বার্নস রহস্য’ ভেদ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মাঝে সবচেয়ে দুর্বল ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা৷ আর তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার নাম ছিল ব্যাটিং। ১৮৮৯ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানদের গড় এভারেজ ছিল মাত্র ১৯! সবচেয়ে ভালো এভারেজ ছিল অব্রে ফকনারের ৪১.৭৭, যার মূল পরিচয় ছিল অলরাউন্ডার।

বলা যায় এই পঁচিশ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কোন আন্তর্জাতিক মানের ‘স্পেশালিস্ট’ ব্যাটসম্যান বের হয় নি, শুধুমাত্র একজন বাদে! কে সেই একজন? তিনি হলেন হার্বি টেলর৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যার ব্যাটিং গড় ছিল ৩৫। তবে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল তিনি ‘ইনফর্ম’ সিডনি বার্নসের বিপক্ষে রান করেছেন। বার্নস যে সিরিজে ৪৯ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন, ওই একই সিরিজে পাঁচ শতাধিক রান করে ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন হার্বি টেলর৷ অনেকের মতে, হার্বি টেলরই নাকি সর্বপ্রথম ব্যাটসম্যান যিনি ‘বার্নস রহস্য’ ভেদ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

পুরো নাম হার্বার্ট উইলফ্রেড টেলর। জন্ম ১৮৮৯ সালের ৫ মে, ডারবানে। মৃত্যু ১৯৭৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, কেপটাউনে। হার্বি টেলরকে মনে করা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে ‘প্রথম ওয়ার্ল্ড ক্লাস ব্যাটসম্যান’। দেশটির হয়ে টেস্টে ২৫০০ রানের মাইলফলক অতিক্রমকারী সর্বপ্রথম ব্যাটসম্যানও তিনি। ১৯২৫ সালে উইজডেন বর্ষসেরার পুরস্কারও জিতেছেন একবার৷

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ হ্যারি অ্যালথামের মতে, ‘H. W. Taylor as a batsman was in a class by himself.’

দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে হার্বার্টের অভিষেক ১৯১২ সালে, ২৩ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। শেষ ম্যাচ খেলেন ১৯৩২ সালে, ৪৩ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।

প্রায় ২০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে (১ম বিশ্বযুদ্ধের কারণে টানা ৮ বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারেন নি) তিনি টেস্ট খেলেছেন ৪২টা। ৭ সেঞ্চুরি আর ১৭ ফিফটিতে সংগ্রহ করেছেন ২৯৩৬ রান। ব্যাটিং গড় ৪০.৭৭। ক্যারিয়ার সেরা ১৭৬ রান, জোহানেসবার্গে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।

ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ার অবশ্য আরও লম্বা। ১৯০৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ঘরোয়া লীগের দল ট্রান্সভাল, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স ও নাটালের হয়ে। ৩০ সেঞ্চুরিতে ৪১.৮৭ গড়ে করেছেন ১৩ হাজারেরও বেশি রান।

তবে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন নাটালের হয়ে কারি কাপে৷ নাটালকে একবারও শিরোপা জেতাতে না পারলেও ৫৮.৬৫ গড়ে ১২টা সেঞ্চুরিসহ করেছেন ৩২২৬ রান। ক্যারিয়ার সেরা ২৫০, ট্রান্সভালের বিপক্ষে, ১৯১২-১৩ মৌসুমে৷

হার্বার্ট টেলর খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নিয়েছেন মোট ১০টি সিরিজে যার মধ্যে ৪টিতে ছিলেন অধিনায়ক; অবশ্য হেরেছেন সবকটিতেই। অধিনায়কের ভূমিকায় ১৮ ম্যাচে জয় পেয়েছেন মাত্র ১টিতে।

খেলোয়াড়ি জীবনে টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছেন মাত্র ৪ বার। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে দুটি উল্লেখযোগ্য ‘ম্যাচ উইনিং নক’ হচ্ছে ১৯২২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৭৬ এবং ১৯২৮ সালে একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ১০১; দুটোই জোহানেসবার্গে।

১৯২২ সালের সিরিজটিতে হার্বির ব্যাট থেকে এসেছিল ৩টি সেঞ্চুরিসহ ৬৪.৬৬ গড়ে ৫৮২ রান। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ হারলেও সিরিজের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ছিলেন হার্বি টেলর৷ উল্লেখ্য, যেকোন টেস্ট সিরিজে পরাজিত দলের ব্যাটসম্যানের তিন সেঞ্চুরি হাঁকানোর ঘটনা এটাই প্রথম।

বিশিষ্ট ক্রীড়ালেখক আর্নেস্ট সোয়ানটনের মতে, “In terms of length and distinction of performance, it could be said that no-one ever served South Africa better than Herbie Taylor”.

সে যুগে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলা হত কৃত্রিম ম্যাটিং উইকেটে। এ ধরনের উইকেটের বৈশিষ্ট্য ছিল, আনপ্রেডিক্টেবল বাউন্স আর অস্বাভাবিক মুভমেন্ট। নেভিল কার্ডাসের ভাষায়, “on matting made a cricket ball spit fire, gyrate and describe angles unknown to geometry.”

ফলে ম্যাটিং উইকেটে ফাস্ট বোলার তো বটেই, স্পিনারদের বলেও ব্যাট করা কঠিন ছিল। অথচ এই ম্যাটিং উইকেটে রীতিমতো ‘এক্সপার্ট’ বনে গিয়েছিলেন হার্বার্ট টেলর! তাঁর ৭টা টেস্ট সেঞ্চুরির ৬টাই ম্যাটিং উইকেটে!

টেকনিক্যালি সাউন্ড সাবেক এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ডিফেন্স ছিল জমাট ও দুর্ভেদ্য। পছন্দ করতেন সোজা ব্যাটে খেলতে। সাবলীল ছিলেন স্কয়ার অফ দ্য উইকেটেও। বিশেষ করে ব্যাকফুটে ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের স্বচ্ছন্দ। উইকেটের দুপাশেই চমৎকার ড্রাইভ খেলতে পারতেন। ফুটওয়ার্ক এবং বলের লেন্থ পড়ে ফেলবার ক্ষমতা ছিল প্রায় নিখুঁতের কাছাকাছি।

হার্বার্ট টেলরের ব্যাটিং টেকনিক সম্পর্কে ‘The Cricketer’ ম্যাগাজিন লিখেছে, “The basis of his play was the straightest of straight bats, nimble footwork, and an almost unfailing judgment of length. His technique was so sound that he remained a beautiful player when nearer fifty than forty.”

টার্নিং উইকেটে মুরালিধরনের বিপক্ষে ‘ক্রিকেটের বরপুত্র’ ব্রায়ান লারার ব্যাটিং মাস্টারক্লাসের কথা তো অনেক শুনেছেন। কিন্তু প্রথম দর্শনেই ইতিহাসের সবচাইতে স্কিলফুল, ‘মিস্ট্রি’ বোলার সিডনি বার্নসের যাবতীয় রহস্যের সমাধান করেছিলেন যিনি, সেই হার্বি টেলরের কীর্তির কথা শুনেছেন কখনও? ও হ্যাঁ, একটু আগেই তো শুনলেন। আচ্ছা এবার তাহলে পুরো গল্পটা শুনুন।

সিডনি বার্নস তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজটি খেলেছেন ১৯১৩-১৪ সালে, তুলনামূলক ‘দুর্বল’ প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। প্রোটিয়া দলটির নেতৃত্বে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র এক সিরিজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ২৪ বছরের তরুণ হার্বি টেলর।

দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাটিং উইকেটে সিডনি বার্নস ছিলেন কার্যত ‘আনপ্লেয়েবল’। নেভিল কার্ডাসের ভাষায়, “on matting, Barnes was undoubtedly the most difficult bowler ever evolved by cricket”.

বার্নসের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে তাই অসহায় আত্মসমর্পণ না করে উপায় ছিল না প্রোটিয়াদের। ৪ টেস্টে মাত্র ১০.৯৩ গড়ে ৪৯ উইকেট পেয়েছিলেন বার্নস। সিরিজের সবগুলো ম্যাচ লজ্জাজনকভাবে হেরে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

কিন্তু দলীয় ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন হার্বি টেলর। ১ সেঞ্চুরি আর ৪ ফিফটিতে ৫০.৮ গড়ে ৫০৮ রান করে হয়েছিলেন সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

বিশেষ করে সেরা ফর্মের বার্নসের সাথে তাঁর লড়াইটা ছিল মনে রাখার মত। টেলর বনাম বার্নসের দ্বৈরথ’কে তো রীতিমতো ক্লাসিকের মর্যাদা দিয়ে থাকেন ইতিহাসবিদেরা! পুরো সিরিজে সর্বমোট ৫ বার বার্নসের বলে আউট হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যতক্ষণ খেলেছেন, দাপটের সাথে খেলেছেন, আত্মবিশ্বাসের সাথে উৎরেছেন ‘বার্নস পরীক্ষায়’।

ওই সিরিজের আগে বার্নসকে কখনও খেলেন নি টেলর। অথচ সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই হাঁকিয়ে বসেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। প্রোটিয়ারা ইনিংস ব্যবধানে হারলেও ১০৯ রানের ‘মাস্টারক্লাস’ ইনিংসটির প্রশংসায় বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে নি কেউ।

উইজডেন এক রিপোর্টে লিখেছিল, ‘Superb display of batting. Excellent in style and powerful in driving. He played [Sydney] Barnes with perfect control and confidence.’

তবে ওই সফরে বার্নসের বিপক্ষে টেলরের সেরা পারফরম্যান্সটি এসেছিল নাটালের হয়ে একটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচে। ওই একটা মাত্র ম্যাচেই বার্নসের ইংল্যান্ডকে হারাতে পেরেছিলেন টেলর। লো-স্কোরিং ম্যাচে নাটাল জিতেছিল ৪ উইকেটে।

ম্যাচের দুই ইনিংসে নাটাল করেছিল যথাক্রমে ১৫৩ ও ২১৬ রান। টেলরের ব্যাট থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৯১ ও ১০০ রান। টেলরের অসাধারণ ইনিংস দুটোতে লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল, তিনি বার্নসের বলে যতটা সম্ভব স্ট্রাইক ধরে রেখে আধিপত্য বিস্তার করে খেলার চেষ্টা করেছেন।

প্রখ্যাত ক্রিকেট সাহিত্যিক নেভিল কার্ডাস হার্বি টেলরের অসাধারণ ব্যাটিং স্কিলে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, ১৯৫৫ সালে উইজডেনের বার্ষিক সংখ্যায় প্রকাশিত ‘গ্রেস-পরবর্তী’ যুগের সেরা ছয় ব্যাটসম্যানের তালিকায় টেলরকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

নেভিল কার্ডাসের ভাষায়, ‘Yet at his deadliest Barnes met a worthy opponent in H. W. Taylor, who played with ease and assurance in each Test match…how possibly could any mortal batsman be subjected to a severer ordeal—Barnes on matting, with wickets falling at the other end all the time? H. W. Taylor must be counted one of the six greatest batsmen of the post-Grace period.’

হার্বি টেলর যে সময়ে খেলতেন, সেসময় ক্রিকেট দুনিয়ার ‘অবিসংবাদিত সেরা’ ব্যাটিং তারকা ছিলেন ইংলিশ কিংবদন্তি স্যার জ্যাক হবস। উল্লেখ্য, তিনিও ম্যাটিং উইকেটে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান ছিলেন। উইজডেনের চোখে, “Hobbs was an absolute master on matting wickets.” আসলে সব ধরনের উইকেটেই হবসের টেকনিক্যাল সুপ্রিমেসির কারণে তাঁকে ডাকা হত ‘দ্য মাস্টার’।

সে যুগে র‍্যাংকিং পদ্ধতি চালু ছিল না, তবে পরিসংখ্যানবিদগণ হিসাব করে বের করেছেন যে, ১৯১২ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত ব্যাটসম্যানদের ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিংয়ে এককভাবে শীর্ষে অবস্থান করছিলেন স্যার জ্যাক হবস। ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবারের জন্য হলেও যিনি হবসকে শীর্ষস্থান থেকে সরাতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন হার্বার্ট উইলফ্রেড টেলর।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...