এক অ-জার্মান ফুটবলভক্তের মন খারাপিয়া

এখন মুলারকে দেখে মনে হয়, জলসাঘরের সেই জমিদারবাবু যিনি জীবনের সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর।’ ঐ কালো শার্ট পরা খেলোয়াড়টি সেদিন মুলার ছিল না হয়তো, অন্য কেউ ছিল।

ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের হাজার হাজার ইংরেজদের উল্লাসের ভিড়ে যে কালো শার্ট পরিহিত খেলোয়াড়টি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল, আমি তাকে চিনি না। তাকে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম, ঠিক চিনতে পারিনি। পরে ভাল করে টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওওও! ওর নাম তো টমাস মুলার। জার্মান দলের এনগ্যাঞ্চ ছিল।

মানে, দুটো পজিটিভ স্ট্রাইকারের একটু পেছন থেকে খানিকটা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের পজিশনেই খেলা খেলোয়াড়। বল বাড়িয়ে গোলের সুযোগ তৈরি এবং প্রয়োজন মতো গোল করা-টরা যার কাজ। সে রকমই একটা ছেলেকে প্রথম খেলতে দেখেছিলাম ২০১০ বিশ্বকাপে। তখন উন্মাদনার যুগ।

আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ তখন খুঁজে বেড়াতো মাইকেল বালাক বলে একটা ১৩ নম্বর জার্সিকে। ১৩ নম্বর জার্সি যদিও শেষমেষ খুঁজে পেয়েছিলাম, কিন্তু বালাককে পাইনি। বদলে এই ছেলেটি কেপটাউনের মাঠে নেমেছিল, বেশ মনে আছে।

মুলার ফুটবল খেলত। বেশ ভালই খেলত। কলকাতা শহরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার একচ্ছত্র রাজ্যপাটে ও ভাগ বসাতে পেরেছিল। স্ট্রিটলাইটের আলোয় বসে অনেকেই বাংলা মদ খেতে খেতে মুলারকে খেলতে দেখত। প্রথমদিকে বেশ কনফিউশনে ভুগতাম, এ শালা গার্ড মুলারের নাতি-টাতি নয় তো? পরে অচিরেই ভুল ভেঙেছিল।

তবে এ মুলারও কম যায় না! মারাদোনার আর্জেন্টিনাকে ৪-০ তে পর্যুদস্ত করার পেছনে এ ছোকরার পা’টা ভালই কাজ করেছিল। ঘানার বিরুদ্ধেও ঐ ডান পায়ে সেকেণ্ড পোস্টে একটা শট মেরেছিল। এসবই আর্কাইভ। পুরোনো দিনের স্মৃতি। মুলার নাকি এখন জার্সির নম্বর পাল্টেছে।

অনেকেই বলাবলি করে, মুলার আর সেই মুলার নেই। প্রশ্ন জাগে, কোন মুলার? যে বায়ার্নের হয়ে বছর বছর সমানে পারফর্ম করে গিয়েছে? যে দেশের জার্সিতে বরাবর ডানদিকে ভরসা জুগিয়েছে? নাকি সে, যে গতদিনে সহজতম সুযোগ মিস করেছে? কোনটা মুলারের পরিচয়, ঠিক ঠাওর হচ্ছে না। ক্যারিয়ারের ‘সেরা’ মিস, নাকি অগুন্তি ম্যাচে জার্মান অ্যাটাকিং থার্ডকে ভরসা জোগানো এক লড়াকু যোদ্ধা।

অনেকেই চলে গিয়েছে ময়দান ছেড়ে। সময় তো চিরকাল একই খাতে বয় না। বাস্তিয়ান, ওজিল, খেদিরা, ক্যাপ্টেন লাম, অ্যাটাকিং ডুয়ো ক্লোজে-পোডলস্কি – সবাই ১২০ গজের বাইরে। পড়ে আছে শুধু একা কুম্ভ। সহযোদ্ধা ক্রুজও অবসরের অভিমুখে।

এখন মুলারকে দেখে মনে হয়, জলসাঘরের সেই জমিদারবাবু যিনি জীবনের সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর।’ ঐ কালো শার্ট পরা খেলোয়াড়টি সেদিন মুলার ছিল না হয়তো, অন্য কেউ ছিল।

আমরা, ফুটবল ভক্তরা, ফুটবলপ্রেমীরা হয়তো অন্য কিছু দেখেছি। অন্য কাউকে দেখেছি, চোখে কিছু পড়েছিল হয়তো। কারণ, পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে দেখা ফুটবল খেলাটায় মুলারের চেয়ে বড় প্রফেশনাল ফুটবলার তো আর চোখে পড়েনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link