হঠাৎ একদিন কোচ বললেন তুমি বাঁ-হাতে বল করো। রীতিমত আকাশ থেকে টপকে পড়ার মত প্রস্তাব। আসলে প্রস্তাবও নয়, এটা আদেশ।
আরে, এ আবার হয় নাকি! শৈশব থেকে একজন ডান-হাতি বোলারকে ধুম করে বললেই সে বাঁ-হাতি হয়ে যাবে? যতই তাঁর বয়স মাত্র আট বছর হোক। তবে বাধ্য ছাত্রের মত তিনি সত্যিই বাঁ-হাতে বল করেছেন। এক সময় এই বাঁ-হাতটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দিয়েছিল। ভারতও ভেবেছিল এই সাগি লক্ষ্মী ভেঙ্কটপতি রাজুই বুঝি তাঁদের নতুন মানিন্দার সিং।
ভেঙ্কটাপথী রাজুর বেড়ে ওঠা হায়দ্রাবাদ শহরে। রাতের হায়দ্রাবাদ শহরের ইরানী চা কিংবা বাড়ি ফেরা পথে বিখ্যাত সেই হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির স্বাদেই চলছিল তাঁর ক্রিকেট যাত্রা। হায়দ্রাবাদ শহরের প্রতি তাঁর প্রেমের কথা পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন বারংবার। এছাড়া রাজুর পড়াশোনা করতেন হায়দ্রাবাদ অল সেইন্টস স্কুলে। এই স্কুল থেকেই বেড়িয়েছিলেন রাজুর প্রথম টেস্ট অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন।
বড় ভাই আজহারউদ্দীনের মত দুরন্ত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন রাজুও। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রঞ্জি ট্রফিতে অভিষিক্ত হন এই বাঁ-হাতি স্পিনার। অনুর্ধব-১৯ ক্রিকেটেও দারুণ পারফর্ম করতে থাকেন তিনি। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ১৯ বছর বয়সী এই স্পিনার তুলে নিয়েছিলেন ৩২ টি উইকেট। এতেই ১৯৯০ সালের নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য ভেঙ্কটপতি রাজুর ডাক আসে ভারতীয় দলে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেই দেখলেন জন রাইটের ১৮৫ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। তবে নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে ব্যাট করতে নেমে রাজুও প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৩১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসেও তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ২১ রান। অভিষেক ম্যাচের সেই ৩১ রানই ছিল তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস।
সে বছরই ভারত দল ইংল্যান্ড গিয়েছিল টেস্ট খেলতে। সেখানে এক প্রস্তুতি ম্যাচে ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশের বল খেলতে গিয়ে হাতের আঙুলের গিট ভেঙে গিয়েছিল রাজুর। ক্যারিয়ারের একেবারে শুরুতে এমন একটা ইনজুরি থেকে ফিরে আসা একেবারের সহজ ছিল না এই স্পিনারের জন্য। ওদিকে তাঁর এই ইনজুরিতে ভারত দলে ডাক পান পরবর্তীকালে দেশটির কিংবদন্তি স্পিনার হয়ে ওঠা অনিল কুম্বলে।
তবে ভেঙ্কটপতি রাজু ফিরেছিলেন আরো ভয়ংকর হয়ে। আরো সাহসী হয়ে। ঘরে মাঠে শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানদের একের পর এক ফ্লাইট দিয়ে বোকা বানাচ্ছেন। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে খেলতে নেমে রাজু যেন সেদিন তাঁর সেরাটাই দেখালেন।
প্রথম ইনিংসে ১৭.৫ ওভার বোলিং করে মাত্র ১২ রান দিয়ে তুলে নিলেন ৬ উইকেট। তাঁর বোলিং তোপে মাত্র ৮৪ রানেই অল আউট হয়ে যায় লংকানরা। ওই ম্যাচে ৩৭ রান দিয়ে রাজু নিয়েছিলেন মোট ৮ উইকেট। সেই ম্যাচে ম্যাচ সেরাও হয়েছিলেন হায়দ্রাবাদের এই ক্রিকেটার।
তবে তাঁর সাহসী ফ্লাইট ডেলিভারিতে অনেক সময়ই রান খরচ হয়ে যেত বেশি । ফলে কখনোই জাতীয় দলে পাকা জায়গা করে নিতে পারেননি এই বোলার। যদিও অনিল কুম্বলে, রাজু ও রাজেশ চোহানকে ভারতের নতুন স্পিন ত্রয়ী ভাবা হচ্ছিল। তবে সেই আশা পূরণ করতে পারেননি এই স্পিনার।
তবে ঘরের মাঠে যথেষ্ট কার্যকর ছিলেন এই স্পিনার। ভারতে ১৫ টি টেস্ট খেলে তাঁর ঝুলিতে ছিল ৭০ উইকেট। সব মিলিয়ে ভারতের হয়ে খেলা ২৮ টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে ৯৩ উইকেট। এছাড়া ৫৩ ওয়ানডে ম্যাচে নিয়েছেন ৬৩ টি উইকেট। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইডেন গার্ডেন্সে খেলেন তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ।
অবশ্য ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন এই ক্রিকেটার। ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর কিছুদিন ধারাভাষ্য দেওয়ার কাজও করেছেন। ২০০৭ সালে ভারতের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তাঁর সময়েই ধোনির নেতৃত্বে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় করে আসে ভারত।
পেন্সিলের মত লিকলিকে এক শরীর। অথচ, সেই রাজুরই ডাক নাম ‘মাসেলস’। নামটা দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার ব্রায়ান ম্যাকমিলানের দেওয়া। তবে, ভুল না কথাটা। অসম্ভব সিংহ হৃদয়ের একজন ক্রিকেটার ছিলেন ভেঙ্কটপতি রাজু। ক্যারিয়ারে জুড়ে জাতীয় দলের সময়টা যাওয়া আসার মধ্যে থাকলেও রণাঙ্গণের জন্য সদা প্রস্তুত প্রস্তুত থাকা এক চরিত্র রাজু।