লর্ডসের সাথে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সম্পর্ক অম্লমধুর। ২০১০ সালে লর্ডস টেস্টেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ে টালমাটাল হয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেট। মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ এবং অধিনায়ক সালমান বাটের ফিক্সিংয়ে এক যুগ না হলেও কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেট।
পাশাপাশি ক্রিকেট বিশ্বেও ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেটের মর্যাদা। ছয় বছর পর সেই লর্ডসেই ঘুরে দাঁড়ানোর এক গল্প লিখেছিল মিসবাহ উল হকের নব-জাগ্রত পাকিস্তান। ইয়াসির শাহ নামক এক জাদুকরের হাত ধরে যেন পুর্নজাগরণ ঘটেছিল সবুজ জার্সি ধারীদের। নতুন করে উত্থানের জানান দিয়েছিলেন একদা লর্ডসেই পাকিস্তানকে ডুবানো তিন ফিক্সারের একজন মোহাম্মদ আমির।
সেবারের ইংল্যান্ড সফরের আগে কঠোর প্রস্তুতি নিয়েছিল পাকিস্তান দল। ফিটনেসে উন্নতির জন্য লাহোরে সেনাবাহিনীর সাথে ক্যাম্প করেছিল তিন সপ্তাহের জন্য। কন্ডিশনের সাথে মানিয়ে নিতে ইংল্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছিল প্রায় এক মাস আগে। সমারসেট এবং সাসেক্সের বিপক্ষেও করেছিল দারুণ। কিন্তু লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা আর প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো করার মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা – অভিজ্ঞ ইউনুস খান, মিসবাহ, হাফিজ, আসাদ শফিকের সাথে তরুণ শান মাসুদ, আজহার আলী, সরফরাজ আহমেদ। অন্যদিকে, ইংল্যান্ড দলে জেমস অ্যান্ডারসনের ইনজুরির সুবাদে অভিষেক হয় বাংলাদেশ সফরে একদিনের ক্রিকেটে দারুণ বল করা জেক বলের।
ডব্লিউ জি গ্রেস একবার বলেছিলেন, ‘টসে জিতলে ব্যাট করো আগে। সন্দেহ থাকলে চিন্তা করো এবং ব্যাটিং নাও। আরো সন্দেহ থাকলে আরো চিন্তা করো এবং ব্যাটিং করো। আরো বেশি সন্দেহ থাকলে দলের সবার সাথে আলোচনা করো এবং ব্যাটিং নাও! মিসবাহ উল হকও বিনাবাক্যে মেনে চললেন ইংলিশ ক্রিকেটের এই পুরোধা পুরুষের কথা। রোদেলা সকালে টস জিতে নির্দ্বিধায় বেছে নিলেন ব্যাটিং।’
ব্যাটিং শুরু করতে নামলেন শান মাসুদ আর মোহাম্মদ হাফিজ। শুরুর দশ ওভার ক্রিস ওকস এবং স্টুয়ার্ট ব্রডের সুইং সামলালেন সাবলীলভাবেই। কিন্তু ১৩ তম ওভারেই ঘটলো ধৈর্যচ্যুতি, ওকসের গুড লেংথে লাফিয়ে ওঠা বলে ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে বেয়ারেস্টোর হাতে। বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকতে পারেননি হাফিজও, ওকসেরই শর্ট বলে ফ্লিক করতে গিয়ে স্কয়ার লেগে ক্যাচ তুলে দিলেন। অভিষিক্ত জেক বলও নিজের প্রথম উইকেটের দেখা পেতে বেশি সময় নিলেন না, দারুণ এক ইয়র্কারে এলবিডব্লিউয়ের শিকার হন আজহার আলী।
৭৭ রানে তিন উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান যখন শংকায় তখন জুটি বাঁধলেন দুই অভিজ্ঞ ইউনিস খান এবং কাপ্তান মিসবাহ। দুজনের ৭৭ রানের পার্টনারশিপে পাকিস্তান যখন বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছে তখনই আঘাত হানলেন ব্রড। স্কয়ার লেগে মঈন আলীর নিখুঁত এক ক্যাচে সাজ ঘরে ফেরেন এই অভিজ্ঞ। এরপর আসাদ শফিকের সাথে জুটি বাঁধেন মিসবাহ। দারুণ ব্যাটিং করে মিসবাহ তুলে নেন ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি।
সেঞ্চুরি করার পর দারুণ এক উদযাপন করেন তিনি, মাঠেই দেন পুশআপ। অবশেষে ওকসই ভাঙেন এই জুটি, ৭৩ রানে আউট করেন শফিককে। এরপর আর বড় কোনো জুটি হয়নি। দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই অলআউট হয় পাকিস্তান, ছোট ছোট জুটিতে প্রথম ইনিংসে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩৩৯ রান। মিসবাহ করেন ১১৩ রান, অন্যদিকে ওকসের শিকার ছিল ছয় উইকেট।
ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই হেলসের উইকেট হারায় ইংলিশরা। রাহাত আলীর দারুণ এক ইনসুইংয়ে ক্যাচ দেন দ্বিতীয় স্লিপে থাকা আজহার আলীর হাতে। এরপর জো রুটের সাথে ১১০ রানের জুটি গড়েন অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক। ফিফটি থেকে কেবল দুই রান কম থাকা অবস্থায় ইয়াসির শাহর বলে আউট হয়ে যান রুট। এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি গ্যারি ব্যালান্স কিংবা জেমস ভিন্সরা।
তাঁদের বিদায়ে পাকিস্তান স্বপ্ন দেখছিল বড় লিড নেবার। কিন্তু একপ্রান্তে অবিচল ছিলেন অধিনায়ক কুক, তার ৮১ রানের পাশাপাশি বেয়ারেস্টো, ওকস, মঈন আলীর ছোট ছোট ইনিংসে ২৭২ রানে অলআউট হয় ইংলিশরা। ইয়াসির শাহ নেন ছয় উইকেট। পাকিস্তান পায় ৬৭ রানের লিড স্বস্তির এক লিড।
দ্বিতীয় ইনিংসে পুনরায় ক্রিস ওকস এবং স্টুয়ার্ট ব্রডের বোলিং তোপে পড়ে পাকিস্তান। আগের ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান মিসবাহর পাশাপাশি হাফিজ এবং ওয়াহাব রিয়াজ ফেরেন রানের খাতা খোলার আগেই। তবে বাকি ব্যাটসম্যানদের ছোট ছোট ইনিংসে ২১৫ রানের সম্মানজনক রানে পৌঁছায় পাকিস্তান। ক্রিস ওকস নেন পাঁচ উইকেট এবং ব্রডের শিকার তিন উইকেট। ইংল্যান্ডের সামনে ২৮৩ রানের লড়াকু এক টার্গেট ছুঁড়ে দেয় পাকিস্তান।
কিন্তু, দ্বিতীয় ইনিংসে ইয়াসির শাহ এবং রাহাত আলীর সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ইংলিশ ব্যাটিং। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে তাদের ইনিংস থেমে যায় ২০৭ রানেই। ইয়াসির শাহর চার উইকেটের পাশাপাশি রাহাত আলী এবং আমির নেন যথাক্রমে ৩ উইকেট এবং ২ উইকেট। ম্যাচসেরা হন ইয়াসির শাহ।
ম্যাচের শেষে ঘটে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। পুরো দলকে একসাথে নিয়ে মাঠের মাঝে পুশআপ দেন মিসবাহ উল হক। পুরো বিশ্বের মাঝে আলোড়ন ছড়ায় ব্যতিক্রমী এই ঘটনা। অন্যদিকে, পাকিস্তানে তখন চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, সবাই ভেবেছিল সেদিকেই ইঙ্গিত করে মিসবাহর এই উদ্যোগ।
কিন্তু, ম্যাচশেষে ব্যাপারটা খোলাসা করেন তিনি, জানান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই তাদের এই প্রচেষ্টা। যে লর্ডসে কলুষিত হয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেট, সেই ক্রিকেটের মক্কাতে ম্যাচ জিতে নতুন এক শুরুর সূচনাই যেন হয়েছিল সেদিন মিসবাহ-ইয়াসিরদের হাতে।