সানা ও বাংলাদেশের অলিম্পিক-স্বপ্ন

১৯৮৪ সাল থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহন করে আসছে বাংলাদেশ। যার বেশিরভগাই অংশগ্রহনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। অলিম্পিক গেমসে খেলার পর একজন ক্রীড়াবিদ বলতে পারেন, আমি আমার ক্যারিয়ারে একবার হলেও অলিম্পিকে খেলেছি। যার মধ্যে আবার আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) কৃপায় ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ নামক এক অনুমতিপত্রের কল্যাণেই বেশিবার যাতায়াত ঘটেছে।

তবে ২০১৬ সাল থেকে চেহারা পাল্টে যেতে থাকে। প্রথমবার অচলায়তন ভেঙ্গে গলফার সিদ্দিকুর রহমান বেরিয়ে আসেন ওয়াইল্ড কার্ড থেকে। কোটা প্লেসের মাধ্যমে সরাসরি অলিম্পিক গেমসে খেলার কীর্তি গড়েন। পাঁচ বছর পর সেই অর্জনের নিজেকে সামিল করেছেন রোমান সানা। ২০১৯ সালের বিশ্ব আর্চারী চ্যাম্পিয়নশিপে সেমিফাইনালে ওঠে ব্রোঞ্চ জিতে সরাসরি টোকিওতে যাবার টিকিট পান।

সেই রোমানকে ঘিরেই এবার প্রত্যাশার বেলুনটা ফুলে ফেপে ওঠেছে। ২৩ জুলাই আসরের প্রথমদিনই মাঠে নামবেন আর্চারী ডিসিপ্লিনে। বাকিদের মধ্যে আর্চারী থেকে দিয়া সিদ্দিকী, শুটিংয়ে আবদুল্লাহ হেল বাকি, সাতারে জুনাইনা আহমেদ, আরিফুল ইসলাম এবং অ্যাথলেটিক্সে জহির রায়হান লাল সবুজ পতাকার প্রতিনিধিত্ব করবেন। যার মধ্যে রোমানকে নিয়েই যত আগ্রহ।

আসরের উদ্বোধনী দিনেই নিশানাভেদে নামবেন রোমান। টোকিওর ইউমেনাস হিমাপার্ক আর্চারী মাঠে রোমানের সঙ্গে নামবেন দিয়া সিদ্দিকীও। রিকার্ভ পুরুষ ও রিকার্ভ নারী ব্যক্তিগত ইভেন্টে খেলার পর রোমান ও দিয়া জুটি রিকার্ভ মিক্সড দলগত ইভেন্টে অংশ নেবেন। রোমান ছেলেদের ব্যক্তিগত ইভেন্টে র‌্যাংকিং রাউন্ডে অংশ নেবেন। ৬৪ জনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন তিনি।

একই দিনে রিকার্ভ নারী একক ইভেন্টেও খেলতে নামবেন দিয়া সিদ্দিকী। উ™ে^াধনী অনুষ্ঠানের মার্চপাস্টে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা বহন করবেন সাঁতারু আরিফুল ইসলাম। যেখানে রোমান সানা ছিলেন পছন্দের শীর্ষে। কিন্তু খেলা থাকায় তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আবদুল্লাহ  হেল বাকি ২৫ জুলাই মেন’স ১০ মিটার এয়ার রাইফেল প্রতিযোগিতায় নামবেন। এরপর পর্যায়ক্রমে সাতার ও অ্যাথলেটিক্স থেকে প্রতিযোগীরা পুল ও ট্র্যাকে নামবেন।

  • সেরাটা দেখানোর অপেক্ষায় রোমান-দিয়া

মে ও জুন মাসে আর্চারীতে দুটি বিশ্বকাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। দুটিতেই রোনাম সানা ও দিয়া সিদ্দিকী অংশ নেয়। অলিম্পিকের প্রস্তুতিটা সুইজারল্যান্ড ও ফ্যান্সে করে নিয়েছেন তারা। আর লুজানে প্রথমবার রিকার্ভ মিক্সড ইভেন্টের ফাইনালে ওঠে ইতিহাস গড়েন এই দুজন। যদিও স্বর্ন জেতা হয়নি, রৌপ্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। মূলত বিশ্বকাপে সেরাদের সেরারা খেলে থাকেন। সে হিসেবে যে কেউ যে কোন দিন যে কোন কিছু করে ফেলতে পারেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া সাফল্যের কারণে রোমানের উপর বেশি ভরসা করতে হচ্ছে।

জনবহুল দেশ হিসেবে অলিম্পিকে এখনো পদকের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। এবার সেই গ্যারো কাটানোর লক্ষই বাংলাদেশের। আসরের উদ্বোধনী দিন ইয়োমেনোশিয়া পার্কের আর্চারী মাঠে লড়াইয়ে নামবেন রোমান। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতে প্রত্যাশা বাড়িয়েছেন। বিশ্বকাপে দিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে দেশের ইতিহাসে সেরার পারফরম্যান্স দেখান খুলনার ছেলে রোমান। ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবার টোকিওর অলিম্পিকের মঞ্চে আরও একবার রোমানের সেরা পারফরম্যান্স দেখার অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ।

এককের পাশাপাশি রিকার্ভ মিক্সড ইভেন্টও বাংলাদেশের প্রত্যাশা থাকবে। সেখানে রোমান-দিয়া দুজন মিলেই লাল সবুজ পতাকার মান রাখার লড়াইয়ে নামবেন। রোমানের কাছে টোকিওতে নিজের সেরাটা মেেল ধরার, ’অলিম্পিকে প্রথমবার সুযোগ পেয়েছি। দেশের জন্য কিছু করতে পারলেই ভাল লাগবে, আমার লক্ষ্যও সেরকমই’। অন্যদিকে হঠাৎ করে সুযোগ পাওয়া দিয়া প্রত্যাশা নিজের অন্তভুক্তিকে প্রমাণ করা। নিজের সেরাটা মেলে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা জানান দুজনেই।

  • ফাইনালে খেলতে চান বাকি

দেশসেরা শুটার হিসেবে সব সময়ই প্রত্যাশার কেন্দ্রে থাকেন আবদুল্লাহ হেল বাকি। টোকিওর অলিম্পিক গেমসে এবারো শুটিংয়ে তাকে নিয়েই যত প্রত্যাশা। তবে টোকিও আসার আগে জার্মানীতে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভিসা জটিলতায় আর যাওয়া হয়নি। সেখানে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তবে হতাশ না হয়ে দেশে প্রস্তুতি নিয়ে জাপান এসেছেন। নব্বইয়েল দশকে শুটিংই ছিল বাংলাদেশের সবেধন নীলমনির নাম। কমনওয়েলথ গেমস থেকে শুরু করে একাধাকি আসরে স্বর্ন জয়েল রেকর্ড রয়েছে খেলাটির।

সর্বশেষ ২০০২ সালের কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ন জিতেছিলেন আসিফ হোসেন খান। তার আগে আতিকুর রহমান, আবদুস সাত্তার নিনিরা সাফল্যের সোনারোদে দেশকে ভাসিয়েছেন। যদিও বর্তমানে আর সেই অবস্থা নেই। বাকি টানা দ্বিতীয়বারের মতো অলিম্পিকে খেলতে গেছেন। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে দেশের হয়ে খেলেছিলেন। কোচ গোলাম শফিউদ্দিন খান শিপলু এবার কোচ হিসেবে কোচ হিসেবে গেছেন বাকির সঙ্গে। স্কোরিংয়ে কিছুটা উন্নতি এবার বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে তাকে নিয়ে।

টোকিও অলিমিস্পিক নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে বাকি বলেন, ‘অলিম্পিকে যাবার আগে অনুশীলনে প্রতিদিনই আমার স্কোর বেড়েছে। এই যেমন অলিম্পিকে যাবার আগের সপ্তাহে শুরুটা হয়েছিল ৬২৪ স্কোর দিয়ে। এরপর সেটি ৬২৮ হয়ে সবশেষে এসে ৬৩১ পর্যন্ত গিয়ে দাড়িয়েছে। সে কারণেই আত্ববিশ্বাসটা বাড়ছে। ভাল কিছু করতে হলে দেশবাসির দোয়া চাই।’

  • সরাসরি অলিম্পিকের স্বপ্ন জুনাইনার, পতাকা নিয়ে রোমাঞ্চিত আরিফুল

২০১৬ সালে বাংলাদেশী বংশোদ্বুত সাইক সিজার রহমান জিমন্যাস্টিকসে অলিম্পিক খেলেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাশার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি এই প্রবাসী অ্যাথলেট। এখন আর তার নামটিও ভুলে গেছেন দেশের ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা। এবার প্রবাসী হিসেবে টোকিও গেছেন জুনাইনা আহমেদ। ভবিষ্যত লক্ষ্য হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার লক্ষ্য স্থির করেছেন লন্ডন প্রবাসী এই সাতারু।

সাঁতার থেকে অংশ নেওয়া আরিফুল ইসলামের হাতে মার্চ পাষ্টে এবার জাতীয় পতাকা থাকবে। নিজেকে পুলে নামার জন্য প্রস্তুত করলেও পতাকা হাতে থাকায় রোমাঞ্চিত হয়েছেন তিনি। ২০২৪ প্যারিষ অলিম্পিকে আর ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে খেলতে চান না জুনাইনা। কোটা প্লেস নিয়ে সরাসরি খেলতে চান। টোকিওর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেও তার মূল স্বপ্নটা প্যারিস নিয়ে। যদি সরাসরি সুযোগ না পান তাহলে না খেলার সিদ্বান্তও নাকি নিয়ে রেখেছেন! জাপানে নিজের পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে জুনাইনা বলেন, ‘বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে খেলতে পারায় আমি আনন্দিত বোধ করছি। নিজের মান রাখার মতো কিছু করার লক্ষ্য রয়েছে। তবে আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্যারিসে সরাসরি খেলা। আগামী তিন বছর তাই আমার জন্য বেশ কঠিন সময়। এই সময়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই আমি।’

২৫ জুলাই টোকিওর বিমানে চড়ার পর ৩০ জুলাই হবে জুনাইনার ইভেন্ট ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলের বাছাইপর্ব।

সাতারে আরেক প্রতিযোগী আরিফুল ইসলাম। ২০১৮ সাল থেকে অলিম্পিকে বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে অবস্থান করছেন। মাঝে জাতীয় ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দেশে এসে থাকেন। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে পারেননি তিনি।

অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশের পতাকা বহনের আগে দারুণ রোমাঞ্চিত আরিফুল বলেন, ‘এ যেন দারুণ একটা সুযোগ হয়ে এসেছে আমার জন্য। পতাকা বহনের এই অনুভূতি বলার মতো নয়! দেশের পতাকা সব সময় আবেগের একটা জায়গা হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। রাজনীতির মঞ্চে কী সেটা খেলার মাঠে, দেশের পতাকা হাতে নেওয়ার পর অন্যরকম একটা অনুভূতি তৈরি হয়’।

৩০ জুলাই থেকে আরিফুলের ইভেন্ট ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতার। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলেই কেবল মিলবে মূলপর্বে খেলার ছাড়পত্র। বাছাইপর্ব উৎরাতে পারাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশের কাছে।

  • বাংলাদেশ অলিম্পিকের ‘রেড জোনে’

দুই আর্চার রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকীর সাথে শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি সবার আগে অলিম্পিকের জন্য টোকিও গেছেন। সাথে রয়েছেন কোচ আর কর্মকর্তারা। অলিম্পিকের রেড জোনে থাকতে হবে বাংলাদেশকে। কোভিড ‘রেড জোনে’ থাকায় অলিম্পিক ভিলেজে তিন দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপালের মতো উপমহাদেশ থেকে যাওয়া অ্যাথলেটদের।

বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) সদস্য এবং অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলের টিম লিডার মোল্লা বদরুল সাইফ এমনটাই জানিয়েছেন। উপমহাদেশের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান করোনা পরিস্থিরি কারণেই রেড জোনে থাকতে হচ্ছে। অলিম্পিকে যাওয়ার আগে করোনার টিকা গ্রহনের পরও রেড জোনে থাকায় উপমহাদেশের অ্যাথলেটদের ওপর বাড়তি নজর থাকবে আয়োজকদের। তিন দিনের কোয়ারেন্টিনের পাশাপাশি প্রতিদিনই করোনা পরীক্ষা করা হবে খেলোয়াড়দের। যা বাংলাদেশের জন্য আলাদা একটা বিড়ম্বনাই বটে।

  • সেরাটা দিতে প্রস্তুত জহির রায়হান

অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে অলিম্পিক খেলার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে জহির রায়হানের। নিজে দেশের দ্রুততম মানব না হওয়ার পর তাকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন। তাঁঁদের বাছাই সঠিক, এমনটি প্রমাণ করতে আলাদা একটা হিটেরও ব্যবস্থা করা হয়। কারণ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁকে মনোনয়নের বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকায় খেলতে পারেননি বাংলাদেশ গেমসে।

যে কারণে তার সর্বশেষ আসরে অংশ নেওয়াটা  ছিল শুন্যের কোঠায়। অলিম্পিকে যাবার আগে তাই নিজে নিজে প্রস্তুতি গ্রহন করেছেন। সে কারণেই নিজের প্রস্তুতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন ২০০ ও ৪০০ মিটারের এই প্রতিযোগী। মূলত ৪০০ মিটারে খেলবেন জহির। পাঁচ বছর ধরে ৪০০ মিটারে বিশ্ব রেকর্ডটা নিজের দখলে রেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকান ভায়ডে ফন নিয়েকার্ক।

২০১৬ রিও অলিম্পিকে প্রোটিয়া এই দৌড়বিদের ৪৩.০৩ সেকেন্ডে গড়া রেকর্ড থেকে বাংলাদেশের জাতীয় রেকর্ডের ব্যবধান ৩.৮৩ সেকেন্ডের। ২০১৯ জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৪৬.৮৬ সেকেন্ডে এই রেকর্ড গড়েছিলেন জহির রায়হান। সাদা চোখে ব্যবধানটা কয়েক সেকেন্ডের মনে হলেও এটা দিয়েই তৈরি হচ্ছে একটার পর এক রেকর্ড।

  • অলিম্পিকগামী বাংলাদেশের ৬ অ্যাথলেট

আর্চারি: রোমান সানা, দিয়া সিদ্দিকী।

সাতার: আরিফুল ইসলাম, জুনাইনা আহমেদ।

শুটিং: আবদুল্লাহ হেল বাকি।

অ্যাথলেটিক্স: জহির রায়হান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link