তামিম-সোহানে হোয়াইটওয়াশ জিম্বাবুয়ে

সিরিজের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে ২৯৯ রানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। জিম্বাবুয়ের মাটিতে এর বেশি রান তাড়া করে একবারই জিতেছিল বাংলাদেশ। সেটাও এক যুগ আগে তামিম ইকবালের ওয়ানডেতে সেই সময়ের দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসে ভর করে। আজও তাই জয়ের জন্য কারো ব্যাট থেকে এমন একটি ইনিংসের বড্ড প্রয়োজন ছিল।

আজও দলের প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে যান সেই  তামিমই। দেশ সেরা অভিজ্ঞ এই ওপেনার একাই ফিরিয়ে আনেন এক যুগ আগের সেই স্মৃতি। তামিমের ১১২ রানের দারুণ ইনিংসে ভর করেই সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়েকে ৫ উইকেটে হারিয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ।

তামিমের কাছে এই সেঞ্চুরিটি অনেক কারণেই বিশেষ কিছু হয়ে থাকবে। অধিনায়ক হিসাবে এটিই তামিমের প্রথম সেঞ্চুরি। এই সেঞ্চুরি দিয়েই দীর্ঘ দিনের সেঞ্চুরি খরা কাটিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। চোট নিয়ে খেলে দুই ম্যাচ ব্যর্থ হওয়াতে যে সমালোচোনা হচ্ছিল সেটির কিছুটা জবাবও হয়তো এটি। যেন বুঝিয়ে দিলেন তাঁর প্রয়োজনীয়তা।

জিম্বাবুয়েকে হোয়াটওয়াশ করা ছাড়াও কম প্রাপ্তি নেই এই সিরিজে। এই সিরিজের তিন ম্যাচ থেকে পূর্ণ ৩০ পয়েন্ট নিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপের সুপার লিগের পয়েন্ট টেবিলেও নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে বাংলাদেশ। অফ ফর্ম থেকে ফিরে এই সিরিজে ব্যাটে বলে দারুণ খেলেছেন সাকিব আল হাসান। লিটন দাসও রানে ফিরেছেন এই সিরিজ দিয়েই।

তবে প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি পেলেও পরের দুই ম্যাচে ভালো শুরু পেয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি লিটন। ব্যাট হাতে বড় ইনিংস খেলতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। সিরিজ জুড়ে ব্যর্থ ছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও। শেষ ম্যাচে চার বছর পর ওয়ানডে খেলতে নেমে নিজকে প্রমাণ করেছেন নুরুল হাসান সোহান। দলের জয় নিশ্চিত করে ৪৫ রানে অপরাজিত ছিলেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নামে শুরু থেকেই ইতিবাচক ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ। দলকে উড়ন্ত শুরু এনে দেন দুই ওপেনার লিটন দাস ও তামিম ইকবাল। তবে শুরুতে মন্থর ব্যাটিং করেছেন তামিম। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথেই বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলেছেন এই ওপেনার। লিটনও শুরু থেকেই ছিলেন বেশ সাবলীল। পাওয়ার প্লেতে দলকে ৫৭ রান এনে দেন দুই ওপেনার।

পাওয়ার প্লের পরেও দারুণ খেলছিলেন দুজন। কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দ পতন ঘটে লিটনের। ওয়েসলি মাধাভারের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের সাধারণ এক বল সুইপ করতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান এই ওপেনার। ৩৭ বলে ৩২ রান করে লিটন ফিরে গেলে ভাঙে ৮৮ রানের উদ্বোধনী জুটি। এই জুটি ভাঙ্গার পরেও রানের গতি থামেনি বাংলাদেশের।

দ্বিতীয় উইকেটেও বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে থাকেন তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। এই দুজনের জুটিতে জয়ের পথ সুগম করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু উইকেটে থিতু হয়েও হঠাৎ করেই মনোযোগ হারান আগের ম্যাচের নায়ক সাকিব। লুক জঙ্গের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের স্লোয়ার বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে উইকেটের পিছনে ক্যাচ দেন তিনি।

৪২ বলে ৩০ রান করে এই অলরাউন্ডার ফিরে গেলে ভাঙে ৫৯ রানের জুটি। এরপর মোহাম্মদ মিথুনকে নিয়ে ১৪৭ রানে ২ উইকেট হারানো বাংলাদেশের হাল ধরেন তামিম। একটু পরেই ৮৭ বলে সাতটি চার ও তিনটি ছয়ের সাহায্যে তুলে নেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১৪তম এবং অধিনায়ক হিসাবে প্রথম সেঞ্চুরি। তবে সেঞ্চুরি করার পর আর বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি এই ওপেনার।

ডোনাল্ড টিরিপানোর অফ স্ট্যাম্পের বাইরের নিরীহ এক ডেলিভারিতে কাট করতে গিয়ে উইকেটের পিছনে ধরা পড়েন তামিম। ৯৭ বলে আটটি চার ও তিনটি ছয়ের সাহায্যে ১১২ রান করে তামিম ফিরে যাওয়ার পরের বলে একই ভাবে নিজের উইকেট বিলিয়ে দেন ২০০তম ওয়ানডে খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শূন্য রানে রিয়াদ ফিরে গেলে ২০৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে একটু চাপে পড়ে বাংলাদেশ।

তবে সেই চাপ বুঝতেই দেননি চার বছর পর ওয়ানডে খেলতে নামা নুরুল হাসান সোহান ও আগের দুই ম্যাচ ব্যর্থ হওয়া মোহাম্মদ মিথুন। পঞ্চম উইকেটে ৬৪ রান যোগ করেন দুজন। ৫৭ বলে ৩০ রান করে মিথুন ফিরে গেলে ভাঙে এই জুটি। মিথুন যখন ফিরে যান তখন জয়ের জন্য ৪০ বলে ৩১ রান প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। আফিফ হোসেনকে নিয়ে বাকি কাজ শেষ করেন সোহান।

৩৯ বলে ৪৫ রান করে অপরাজিত থাকেন সোহান আর আফিফ অপরাজিত থাকেন ১৭ বলে ২৬ রান করে। জিম্বাবুয়ের বোলারদের ভিতর সবচেয়ে সফল ছিলেন ওয়েসলি মাধাভারে। ১০ ওভারে ৪৫ রান দিয়ে দুই উইকেট শিকার করেন এই স্পিনার। এছাড়া দুটি উইকেট পেয়েছেন ডোনাল্ড টিরিপানো ও বাকি একটি উইকেট পেয়েছেন লুক জঙ্গে।

এর আগে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে সাবধানী শুরু করেন জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনার রেগিস চাকাভা ও তাদিওয়ানাশে মারুমানি। উদ্বোধনী জুটি ভাঙতে মাত্র নয় ওভারেই পাঁচ বোলার ব্যবহার করে বাংলাদেশ। নবম ওভারে সাকিব আল হাসানকে আক্রমণে এনে প্রথম সাফল্য পায় সফরকারীরা। সাকিবের মিডল স্টাম্প বরাবর লেংথ বল সুইপ কর গিয়ে  এলবিডাব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন মারুমানি।

দলীয় ৩৬ রানে ১৯ বলে ৮ রান করে মারুমানি ফিরে যাওয়ার পর ব্রেন্ডন টেইলরের সাথে জুটি  গড়ার চেষ্টা করেন চাকাভা। তবে এই জুটিকেও বেশি দূর যেতে দেননি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই স্পিনারের অফ স্টাম্পের সাধারণ এক বল উড়িয়ে মারতে গিয়ে তামিমের হাত ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান টেইলর। ২৮ রান করে জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ফিরে গেলে ভাঙে ৪২ রানের জুটি।

৭৮ রানে দুই উইকেট হারানোর পর দলের হাল ধরেণ চাকাভা ও ডিয়ন মেয়ার্স। তৃতীয় উইকেট জুটিতে দুজন যোগ করেন ৭১ রান। এই জুটি ভাঙতে মারিয়া তামিম আবার আক্রমণে নিয়ে আসেন মাহমুদউল্লাহকে। অধিনায়ককে হতাশ করেননি তিনি। ক্রমেই বিপদজনক হয়ে ওঠা জুটি অভিজ্ঞ এই বোলার। তারঁ একটু জোরের উপর করা বলে লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে যান মেয়ার্স।

৩৮ বলে ৩৪ রান করে মেয়ার্স ফিরে যাওয়ার পর উইকেটে এসে সুবিধা করতে পারেননি ওয়েসলি মাধেভারা। সিরিজে প্রথম বারের মত খেলতে নামা মুস্তাফিজুর রহমানের প্রথম শিকার হয়ে ফিরে যান তিনি। এই পেসারের স্লোয়ার ডেলিভারিতে বিভ্রান্ত হয়ে শর্ট মিড উইকেটে সাকিবের কাছে ক্যাচ দিয়ে ৪ বলে ৩ রান করে ফিরে যান এই ব্যাটসম্যান।

এক প্রান্তে উইকেটে থিতু হয়ে সবাই আউট হলেও অপর প্রান্ত থেকে দলকে একাই বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন চাকাভা। নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দিকেও এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ওয়ানডেতে আগের ক্যারিয়ার সেরা ৭৮ রান অতিক্রম করার পরেই মনোযোগ হারান এই ওপেনার। তাসকিন আহমেদের লাইনে থাকা ফুল লেংথের বল ক্রস ব্যাটে খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান তিনি।

৯১ বলে ক্যারিয়ার সেরা ৮৪ রান করে চাকাভা ফিরে যাওয়ার পরেও রানের গতি থেমে থাকেনি জিম্বাবুয়ের। ষষ্ট উইকেট জুটিতে ১১২ রান সংগ্রহ করে জিম্বাবুয়েকে বড় সংগ্রহ এনে দেন রাজা ও বার্ল। তবে দলীয় ২৮৪ রানে ৫৭ রান করে রাজা ফিরে যাওয়ার পরই দ্রুত বাকি উইকেট গুলো হারিয়ে তিন বল বাকি থাকতেই ২৯৮ রানে অলআউট হয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। ৪৩ বলে ৫৯ রান করেন বার্ল।

বাংলাদেশের বোলারদের ভিতর তিনটি করে  উইকেট শিকার করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। এছাড়া দুটি উইকেট পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও একটি করে উইকেট পেয়েছরন সাকিব আল হাসান ও তাসকিন আহমেদ।

  • সংক্ষিপ্ত স্কোর

জিম্বাবুয়ে: ২৯৮/১০ (ওভার: ৪৯.৩; চাকাভা- ৮৪, মারুমানি- ৮, টেইলর- ২৮, মেয়ার্স- ৩৪, রাজা-৫৭, বার্ল- ৫৯) (মাহমুদউল্লাহ- ১০-০-৪৫-২, সাকিব- ১০-০-৪৬-২, সাইফউদ্দিন- ৮-০-৩৭-৩, মুস্তাফিজুর- ৯.৩-০-৫৭-৩)

জিম্বাবুয়ে: ৩০২/৫ (ওভার: ৪৮; তামিম- ১১২, লিটন- ৩২, সাকিব- ৩০, মাহমুদউল্লাহ- ০, মিথুন- ৩০, সোহান- ৪৫*, আফিফ- ২৬*) (মাধাভেরে- ১০-০-৪৫-২, টিরিপানো- ৭-০-৬১-২)

ফলাফল: বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী।

সিরিজ: বাংলাদেশ ৩-০ তে জয়ী।

ম্যাচ সেরা: তামিম ইকবাল।

সিরিজ সেরা: সাকিব আল হাসান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link