রেকর্ড-রাঙা হাসারাঙ্গা

১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতে সবাইকে চমকে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তবে তাদের বিশ্বকাপ জেতা যে অঘটন ছিল না, সেটার প্রমাণ তারা দিয়েছে পরের দুই দশক ধারাবাহিক ভালো খেলে। মারভান আতাপাত্তু, অরবিন্দ ডি সিলভাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, তিলকরত্নে দিলশান, মুত্তিয়া মুরালিধরনরা।

২০০৭ এবং ২০১১ সালে টানা দুই বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে তারা। মুরালিধরণ, হেরাথ, অজন্তা মেন্ডিসদের মতো স্পিনাররা খেলেছেন শ্রীলঙ্কার হয়ে। কিন্তু তাদের বিদায়ের পর ভালো মানের স্পিনার সংকটে পড়ে লঙ্কানরা। মাঠের পারফরম্যান্সেও প্রভাব পড়ে তাদের, হতশ্রী পারফরম্যান্স করে তারা বিদায় নেয় বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকেই।

কিন্তু, সম্প্রতি আশার আলো দেখতে পেয়েছে এক লেগ স্পিনারের মাঝে। যারা স্পিন ঘূর্ণিতে বিভ্রান্ত হয়ে সাজঘরে ফিরছেন ব্যাটসম্যান, লঙ্কানরাও ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে জয়ের স্বাদ। এই লেগস্পিনারটি হলেন পিন্নাদুয়াগে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা ডি সিলভা যাকে বিশ্ব চেনে ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা নামেই।

১৯৯৬ সালে গলে জন্মগ্রহণ করেন হাসারাঙ্গা। শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত স্কুল ক্রিকেটের মাধ্যমে উত্থান এই লংকানের। ত্রা বড় চতুরঙ্গ ডি সিলভাও ক্রিকেট খেলতেন, প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাতীয় দলেও। কিন্তু ক্যারিয়ারটা লম্বা হয়নি, সাত ওডিয়াই এবং তিন টি টোয়েন্টিতেই থেমে গেছে তাঁর যাত্রা।

বড় ভাইয়ের ক্যারিয়ার দেখে তাই আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন হাসারাঙ্গা। রিচমন্ড কলেজের হয়ে আলো ছড়ানোর সুবাদে ২০১৬ অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপগামী শ্রীলঙ্কা দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। যদিও এর চেয়েও কম বয়সেই তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায়। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই ঘরোয়া একদিনের টুর্নামেন্টে সুযোগ পান কলম্বোর হয়ে।

পরের বছরেই অভিষেক হয়ে যায় ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও। এমনকি জাতীয় দলে খেলার আগেই তিনি সুযোগ পেয়ে যান ফ্যাঞ্চাইজি টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) সিলেট সিক্সার্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।

রঙ্না হেরাথের বিদায়ের পর শ্রীলংকার স্পিন ডিপার্টমেন্টে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পাথিরানা, ভ্যান্ডারসে, সান্দাকান, আমিলা আপুন্সোরা ভালো করতে না পারলে দলে জায়গা পান হাসারাঙ্গা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই গড়েন ইতিহাস, সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করেন।

এছাড়াও একদিনের ক্রিকেটে তিনিই একমাত্র হ্যাটট্রিককারী লেগ স্পিনার। ২০১৮ মৌসুমে তিনি শ্রীলঙ্কার সেরা উদীয়মান তারকা নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি টোয়েন্টি অভিষেক হয় হাসারাঙ্গার। সে বছরেরই শেষে পাকিস্থান সফরে যায় শ্রীলঙ্কা। তিন ম্যাচ টি টোয়েন্টি সিরিজে আট উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা নির্বাচিত হন হাসারাঙ্গা এবং ইতিহাসে প্রথমবারের পাকিস্থানকে হোয়াইটওয়াশ করে লঙ্কানরা।

বলের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও সমান কার্যকরী হাসারাঙ্গা। দলের বিপদে লোয়ার অর্ডারে নেমে ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে তার বিকল্প নেই শ্রীলঙ্কাতে। এ বছরেরই শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাত উইকেট হারিয়ে লংকানরা যখন ধুঁকছে, তখন আসেন বান্দারাকে নিয়ে ১২৩ রানের জুটি গড়ে দলের বিপদ সামাল দেন তিনি। এখনো পর্যন্ত ২৬ টি একদিনের ক্রিকেটে ১৫ উইকেট নেবার পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছেন তিনটি অর্ধশতক।

এছাড়া ২২ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর সংগ্রহ ৩৩ উইকেট। বোলিং করেছেন ২০ ইনিংসে। অভিষেকের পর থেকে তাঁর থেকে বেশি উইকেট পেয়েছেন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার তাবরাইজ শামসি। তাবরাইজের উইকেট ৩৫ টি। তবে বোলিং ২৫ টি ইনিংসে। মানে, উইকেট নেওয়ার হারে হাসারাঙ্গাই এগিয়ে আছেন।

তবে হাসারাঙ্গার সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপ দেখা যায় বোধহয় সদ্য অনুষ্ঠিত ভারতের বিপক্ষে সিরিজে। তিন ম্যাচের তিন টোয়েন্টি সিরিজে তার গুগলি-ফ্লাইট-টপ স্পিনের জবাব ছিল না ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কাছে। সিরিজের শেষ ম্যাচে মাত্র নয় রান দিয়ে শিকার করেন চার উইকেট।

তাঁর অনবদ্য পারফরমেন্সের সুবাদে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় লঙ্কানরা এবং তিনি নিজে নির্বাচিত হন সিরিজ সেরা। এছাড়া ধারাবাহিক ভালো খেলার সুবাদে উঠে আসেন আইসিসি টি টোয়েন্টি বোলার র‍্যাংকিংয়ের দ্বিতীয় স্থানে। শ্রীলঙ্কার হারিয়ে যাওয়া সোনালি সময় ফিরিয়ে আনতে হাসারাঙ্গার নিয়মিত এমন পারফর্ম করে যাবার বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link