জ্যাডন সাঞ্চো: ইউনাইটেডের নতুন আশা

জ্যাডন সাঞ্চো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের কাছে এই নামটা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের কাছে শিরোপার মতনই প্রতীক্ষিত ছিল। ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনা শিরোপার দেখা পেয়েছে, ইউনাইটেডও দেড় বছর ঘাটাঘাটি করবার পর পেয়েছে সাঞ্চোর দেখা। এই মৌসুমের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় হিসেবে জ্যাডন সাঞ্চোকে দলে ভিড়িয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

গত তিন ট্রান্সফার উইন্ডো ধরে জ্যাডন সাঞ্চো নামটা জড়িয়ে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকদের সাথে। এতদিন ধরে নামটা ছিল হতাশার, নিজেদের ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতার প্রতীক। রাতারাতি তা হয়ে উঠেছে ইউনাইটেড ম্যানেজমেন্টের সফলতার প্রতীক। কিন্তু এই সাঞ্চোর সাথে ম্যানচেস্টারের সম্পর্ক অনেক আগে থেকে।

কাগজে-কলমে সাঞ্চোর বয়সটা মাত্র ২১, কিন্তু এরই মধ্যে ক্যারিয়ারের অনেক ধাপ পার করা শেষ তার। তার গড়ে উঠা ওয়াটফোর্ডের ইয়ুথ একাডেমিতে। সেখান থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে এসেছিলেন ম্যানচেস্টারের ক্লাবে। না ইউনাইটেড নয়, বরং রাইভাল ম্যানচেস্টার সিটিতে।

সিটি যুব দলের অন্যতম ভয়ঙ্কর উইঙ্গার ছিলেন সাঞ্চো। লক্ষ্য ছিল ফ্রুত নিজেকে মূল দলে দেখা। কিন্তু গার্দিওলা তখন ব্যস্ত সিটিকে স্টার দিয়ে ভরপুর করতে, সে দলে নিজের জায়গা নিয়ে সন্দিহান ছিল সাঞ্চো নিজেই। যে কারণে সিটি থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করলেন তখনই। মনমতো অফারও এলো। ১৭ বছর বয়সেই ইংল্যান্ড ছেড়ে জার্মান দল বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে যোগ দিলেন তিনি।

একজন তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য বুরুশিয়া কেমন দল তা নিশ্চয় আর ভেঙ্গে বলতে হবে না। বুরুশিয়া হচ্ছে তরুণ খেলোয়াড়দের তৈরি করার জন্য ইউরোপের সবচেয়ে সেরা দল। কোনো তরুণ খেলোয়াড়ের বুরুশিয়াতে পা রাখা মানেই তার স্টার হয়ে বেরিয়ে আসা প্রায় নিশ্চিত। সেই দল সাঞ্চোর মতন তারকাকে নিয়ে কী আর হেলা-ফেলা করবে?

তবু একটা ভয় ছিলই। ইংলিশ তারকারা খুব একটা দেশের বাইরে খেলরতে যান না। কারণটা স্পষ্ট, নিজেদের দেশেই তারা বেশি সফল। সেই সাথে বাইরে খেলতে গিয়েও খুব যে একটা ভালো করতে পারেন, তাও ঠিক না। সেটা নিয়ে ভয় অমূলক ছিল না।

কিন্তু সাঞ্চো কোনো কিছুরই ধার ধারেননি। বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মূল তারকা হয়ে উঠেছিলেন দলে প্রবেশ করার দুই মাসের মাথাতেই। গোল-এসিস্ট দুইদিকেই নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছিলেন তিনি। তার মাথায় শুধু ছিল ম্যানচেস্টার সিটিকে দেখিয়ে দেওয়া, কোন তারকা হাতছাড়া করেছে তারা। আর তার খেলায় মুগ্ধ ইউনাইটেড চেয়েছে সেই কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু বেশিই খারাপ। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো চলে যাওয়ার পর থেকে কোয়ালিটিফুল উইঙ্গারের অভাব প্রচন্ড। কম খেলোয়াড় কেনার চেষ্টা করেনি তারা, প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণ করা অ্যালেক্সিস সানচেজ এসে বেতনের বোঝা বাড়িয়েছেনই শুধু।

খেলোয়াড় কিনেছেন, যুব দল থেকে তুলে এনেছেন, কেউই রোনালদোর ধারেকাছে দূরে থাক, অর্ধেকও পারফরম্যান্স দিতে পারেননি। উইঙ্গ নির্ভর খেলা তো বাতিলই হয়ে গিয়েছিল একসময়। কিন্তু জ্যাডন সাঞ্চোকে দেখেই যেন মনে আশা জেগেছিল রেড ডেভিলদের। যেমন গতি, তেমনই খেলা। পরবর্তী রোনালদো আশা করে অনেকবার ঠকেছে তারা, এবারও মন না চাইতেও আশায় বুক বেঁধেছিল তারা। কিন্তু বাধ সেধে বসলো বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড!

বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড পরিচিত সেলিং ক্লাব হিসেবেই। খেলোয়াড় কিনে তাদের উচ্চমূল্যে বিক্রি করাটাই তাদের কাজ। সেদিক দিয়ে সাঞ্চোকে রেখে দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের কোনোকালেই ছিল না।

সে কারণে যখন দুই বছর আগে ইউনাইটেড প্রথমবারের মতন সাঞ্চোর জন্য বিড করলো, বিশাল এক অঙ্ক ধরিয়ে দিলো তারা ইউনাইটেডের সামনে। সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। মিয়া-বিবি রাজি, কিন্তু কাজী রাজি নন। সাঞ্চো আর ইউনাইটেড যতবারই এগিয়েছেন, ততবারই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডর্টমুন্ড।

দুই বছর পার হয়ে গিয়েছে, প্যান্ডেমিকের কারণে সকলের খরচেই টান পরেছে, ইউনাইটেড সেই সুযোগটাই ব্যবহার করেছে। ইউরো চলাকালীন সাঞ্চো ছিলেন ইংল্যান্ডেই। এই সুযোগের মতন বড় সুযোগ আর হয় না। বুরুশিয়া এবার আর বাধ সাধতে পারেনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইউরোর মধ্যেই কিনে নিয়েছে তাদের বহুল প্রতীক্ষিত জ্যাডন সাঞ্চোকে। মোট খরচ পরেছে ৭৩ মিলিয়ন পাউন্ড।

ইউরোটা খুব একটা ভালো যায়নি সাঞ্চোর। শুরুটা ভালোই হয়েছিল, ভেবেছিলেন শিরোপা ঘরে নিয়েই ফিরবেন তিনি। কিন্তু কথায় আছে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। শেষটাই ভালো হয়নি তার। ফাইনালে পেনাল্টি মিস করে দলকে বিপদে ফেলেছেন, আর সেটাই হয়েছে কাল।

শেষ মিনিটে তার উপর রাখা কোচের ভরসা পরিপূর্ণ করতে পারেননি। ইউনাইটেডে যোগ দেওয়ার আগেই তাই একদল ইংলিশ সমর্থকদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে দুয়ো, সেই সাথে শুনতে হয়েছে বর্ণবৈষম্যমূলক কথাবার্তাও।

গত দুই বছর ধরে ইউনাইটেডের স্বপ্নের তারকার আগমণ স্বপ্নের মতন হয়নি বটে, কিন্তু ওলে গুনার শ্যুলশারের হাত ধরে সেটা সম্ভব হতে পারে দ্রুতই। ওলে গুনার হত কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে দলটাকে সাজিয়েছেন, দলকে গড়ে তুলেছেন পুরাতন ইউনাইটেডের মতন করে।

প্রতিটি জায়গায় ভালো খেলোয়াড় এনেছেন, দলে যথেষ্ট ব্যাকআপও তৈরি করেছেন। যুবদল-তারকা মিলিয়ে অসাধারণ এক দল। সেই দলে সাঞ্চো হতে চলেছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারকা।

দুই পায়ে সমান দক্ষতা সাঞ্চোর। মূলত রাইট উইং পজিশনে খেললেও চাইলেই তাকে ‘নাম্বার ১০’ রোলে খেলাতে পারেন কোচ। বুরুশিয়ার হয়ে মাত্র ১৩৭ ম্যাচেই ছুঁয়েছেন ৫০ গোল আর ৫৭ গোলের রেকর্ড। অর্থাৎ গোল বানাতে ও করতে, দুই ক্ষেত্রেই এগিয়ে তিনি।

গত মৌসুমের মাঝপথে পগবা চলে যাওয়ার পর গোল তৈরিতে যে সমস্যা শুরু হয়েছিল, তা থাকছে না সাঞ্চো আসাতে। এমনকি এখন চাইলেও সামনে তিনজন অ্যাটাকারের উপর পুরো আক্রমণের দায়িত্ব দিয়ে মাঝমাঠ সামলাতে পারবেন শ্যুলশার। এছাড়াও ইউনাইটেড দলের অনেক তারকাই ছিলেন ইংল্যান্ড দলে, মানিয়ে নিতেও সমস্যা হবে না।

সাঞ্চো ডিলে খালি চোখে লাভবান হয়েছে সবচেয়ে বেশি ইউনাইটেডই। প্রতিদ্বন্দ্বী সিটির কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে যেমন দেওয়া হলো তেমনই দলবদলের মৌসুম শুরুর আগে যেসকল পজিশন নিয়ে চিন্তা ছিল সেটাও দূর হয়ে গেল।

এখন অপেক্ষা সাঞ্চোর মাঠে নামার। ইউনাইটেড সমর্থকদের আশার পারদ আরো উঁচুতে উঠাতে পারেন, নাকি উড়ানোর আগেও চুপসে যাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link