টেস্ট ক্রিকেটে তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি স্পিনার। এটি তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় উপাধি হতে পারতো। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তাঁর গুগলির ফাঁদে পড়েছিল বিশ্বের নামী-দামী ব্যাটসম্যানরা। তবে একটা স্পট ফিক্সিং তাঁকে ছিটকে দিয়েছিল ক্যারিয়ারের মধ্যগগণ থেকে। দানিশ কানেরিয়া নামটা এখন যতটা বেশি গৌরবের তারচেয়ে অনেক বেশি আক্ষেপের।
১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের করাচি শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন দানিশ কানেরিয়া। অনিল দালপাতের পর দ্বিতীয় হিন্দু ক্রিকেটার হিসেবে পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেন। টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের স্পিন বোলিং আক্রমণের মূল ভরসাও হয়ে উঠেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন গ্রেট লেগ স্পিনার হবেন পাকিস্তানের দানিশ কানেরিয়া।
২০০০ সালে ফয়সালবাদে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার এক টেস্ট ম্যাচে ফিরে যাই। পাকিস্তানের হয়ে সেই ম্যাচে অভিষিক্ত হন ১৯ বছর বয়সী এক লেগ স্পিনার। আগে ব্যাট করতে নেমে স্পিনিং পিচে ৩১৬ রানের সম্মানজনক স্কোর বোর্ডে জমা করে পাকিস্তান। তবে জবাবে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনারও দারুণ শুরু করেন। স্পিনিং পিচেও মাইকেল অ্যাথারটন ও মার্কাস ট্রেসকোথিকের ব্যাট থেকে যেন স্ট্রোকের ফুলঝুড়ি ফুটছিল।
তবে মঈন খান ১৯ বছরের সেই লেগ স্পিনারের হাতে বলটা তুলে দিলেই বিপত্তিটা ঘটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্বিতীয় বলেই নিজের গুগলির ফাঁদে ফেলেন ট্রেসকোথিককে। এই ওপেনারকে ফিরানোর পরেও নাসির হুসাইনদের পুরো ব্যাটিং লাইন আপকেই সেদিন ভুগিয়েছিলেন নিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নামা দানিশ কানেরিয়া। সেই ম্যাচটা ড্র হলেও, ক্রিকেট বোদ্ধারা একমত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের এই ছেলেই হতে যাচ্ছে নেক্সট গ্রেট লেগ স্পিনার।
দানিশ কানেরিয়া আব্দুল কাদির কিংবা মুশতাক আহমেদদের ঘাটতি পূরণ করে দিবেন এমন কথাবার্তাও হচ্ছিল। এমনকি রিচি বেনোও বলেছিলেন যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কানেরিয়ার চেয়ে ভালো গুগলি দিতে কাউকে দেখেননি। দানিশ কানেরিয়া এত বড় বড় অ্যাখ্যার মর্যাদাও দিতে শুরু করেছিলেন।
বিশেষ করে ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ তাঁর ক্যারিয়ারের বাক ঘুড়িয়ে দেয়। ভালো মানের ব্যাটিং লাইন আপের বিরুদ্ধেও যে তিনি কতটা কার্যকরি হতে পারেন সেটাই প্রমাণ করেছিলেন ওই ম্যাচে। করাচিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচে তিনি একাই নেন দশ উইকেট। বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৯ রান দিয়ে নেন ৭ উইকেট। তাঁর এই বোলিং এই ছয় উইকেটের সহজ জয় পেয়েছিল পাকিস্তান।
এরপর থেকেই পাকিস্তানের বোলিং এর মূল ভরসা হয়ে উঠেন দানিশ কানেরিয়া। যদিও সেই সময় অপর প্রান্ত থেকে ভালো বোলিং পার্টনার পাননি। অনেকের মতে দানিশে একজন ভালো বোলিং পার্টনার থাকলে আরো বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারতেন এই লেগি। এমনকি তাঁর স্পিন বুঝে কাজ করার মত উইকেটরক্ষক পাকিস্তানের ছিল না বলেও মনে করা হয়।
এতকিছুর পরেও নিজের কাজটা করে যাচ্ছিলেন। এখনো টেস্টে পাকিস্তানের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। তাঁর উপরে শুধু আছেন তিন পেসার ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস ও ইমরান খান। তবে স্পিনার হিসেবে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির নাম দানিশ কানেরিয়াই। পাকিস্তানের হয়ে খেলা ৬১ টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে ২৬১ উইকেট।
টেস্টে ১৫ বার পাঁচ উইকেট ও ২ বার দশ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে এই বোলারের। ইনিংসে তাঁর সেরা পারফর্মেন্স ৭৭ রান দিয়ে ৭ উইকেট ও ম্যাচে ৯৪ রান দিয়ে ১২ উইকেট। এই দুটিই এসেছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। এছাড়া ৪ বার ইনিংসে ৭ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে দানিশ কানেরিয়ার। এছাড়া ১৮ ওয়ানডে ম্যাচেও নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট। পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০০০ উইকেটের মালিকও তিনি।
২০০৪ সাল থেকে ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল এসেক্সের হয়ে খেলাও শুরু করেন। তবে কানেরিয়ার ক্যারিয়ারে কালো মেঘ আসে ২০১০ সালে। সেটা অবশ্য তাঁর মাঠের পারফর্মেন্সের জন্য নয়। ২০১০ সালে তাঁর বিরুদ্ধে এসেক্সের হয়ে ম্যাচ ফিক্সিং এর অভিযোগ আনে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড। শাস্তি হিসেবে তাঁকে আজীবন নিষেধাজ্ঞা দেয় ইসিবি।
সেই সময় এর বিরুদ্ধে আপিল করলেও ২০১৩ সালে তা বাতিল হয়ে যায়। ওদিকে পাকিস্তানও তাঁকে জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা না করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই থেমে যায় দানিশ কানেরিয়ার গ্রেট হওয়ার যাত্রা। পরে অবশ্য ২০১৮ সালে ফিক্সিং এর সাথে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছিলেন এই লেগি। ফলে পাকিস্তান, হয়তো ক্রিকেট দুনিয়ায় তাঁদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনারকে হারায়।
এটাও ঠিক যে – পাকিস্তান ক্রিকেটে তিনি ছিলেন ‘আউটসাইডার’। নিজের সতীর্থরাই কখনো তাঁকে আপন করে নেননি – এমন অভিযোগ তিনি নিজেই বহুবার বহু জায়গায় করেছেন। তাই, অনেক অর্জন থাকার পরও পাকিস্তান ক্রিকেট থেকে তিনি তেমন একটা স্বীকৃতি পাননি। এরপর ফিক্সিংয়ে ডুবে তিনি নিজে আত্মসম্মানটাও হারিয়েছেন।