করাচির উত্তাপে ফুলের সৌরভ

ভারতের ক্রিকেটে সৌরভ গাঙ্গুলি চরিত্রটাই যেন এক রোমাঞ্চ। সৌরভ হয়তো ভারতের হয়ে বড় কোন শিরোপা জেতেননি। তবুও ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়কের তর্কে তাঁর নামটাই বারবার আসে। কেননা সৌরভ ভারতের ক্রিকেটকে সাহস করতে শিখিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে শিখিয়েছিলেন। ইটের জবাবটা তাঁর পাটকেল দিয়েই দেয়া চাই। সৌরভ তাঁর এই অসুখটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গোটা ভারত দলেই।

আপনাদেরকে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের এক মঞ্চে নিয়ে যাই। ঠিক এখনকার ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের মত না। সেই সময়ের কথা বলছি যখন এই দুই দল মাঠে নামলে দুটি দেশ থমকে যেত। রাস্তা রাস্তায় মিছিল হতো। বাইশ গজের লড়াইয়ের উত্তাপ ক্রিকেট মাঠের বাইরেরও সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়তো।

দুই দলের ক্রিকেটার থেকে ভক্তদের চোখেও যেন আগ্নেয়গরি। যেন কার্গিল সীমান্তের সৈন্যদল ব্যাট বল হাতে একে অপরের মুখোমুখি হয়েছে। ঠিক যেমনটা দেখা যেত নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে। সেই বিখ্যাত, ঐতিহাসিক ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ।

১৯৯৭ সালে তেমনই এক দ্বৈরথের স্বাক্ষী হয়েছিল গোটা ক্রিকেটবিশ্ব। শচীন টেন্ডুলকারের নেতৃত্বে পাকিস্তানে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে গিয়েছে ভারত দল। সাঈদ আনোয়ারের পাকিস্তানের বিপক্ষে শচীন-সৌরভদের লড়াইটা যে আগের যেকোনো উত্তাপকে ছাড়িয়ে যাবে তা অনুমেয়ই ছিল। প্রথম ওয়ানডেতেই লড়াইটা টের পাওয়া গেলে মাঠে। দুই দলের লড়াইয়ে সেদিন শেষ পর্যন্ত জয় তুলে নিয়েছিল পাকিস্তানই।

তবে উত্তাপের পারদ যে কতদূর গড়াতে পারে তা টের পাওয়া গেল দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। প্রথম ওয়ানডে হেরে সৌরভরা নিশ্চই মুখিয়ে ছিল এর জবাব দিতে। ওদিকে ভারত পাকিস্তান ম্যাচে দর্শকদের মারামারি, ইট ছুঁড়াও তখন নতুন কোন ঘটনা না। সেদিনও ভারতের ক্রিকেটারদের লক্ষ্য করে মাঠে ইট ছুঁড়ে মারছিল করাচির সমর্থকেরা। এক পর্যায়ে ব্যাপারটা এতটাই ভয়ানক হয় যে শচীনের মত ক্রিকেটারও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত ম্যাচ রেফারিরা সিদ্ধান্ত নেয় খেলা বন্ধ রাখার। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আবার যখন খেলা শুরু হয় তখন ম্যাচ গড়ায় ৪৭ ওভারে। ওদিকে আগে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তানকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিলেন শহীদ আফ্রিদি। খেলেন ৫৬ বলে ৭২ রানের ঝড়ো ইনিংস। এছাড়া ইনজামাম উল হকের ৭৪ রানে ভর করে ৪৭ ওভারে ২৬৫ রানের দারুণ সংগ্রহ দাঁড় করায় পাকিস্তান।

এমনিতেই প্রথম ম্যাচ হেরে চাপে ছিল ভারত। তারপর করাচির দর্শকদের সামনে ২৬৬ রানের টার্গেট যেন পাহাড়সম। তবুও শচীন-সৌরভ ব্যাট হাতে লড়াইটা শুরু করলেন। তবে ভারত যে ওই চাপের মধ্যেও ম্যাচ জিততে পারে সেই সাহসটা আবারো এনে দিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলিই। শচীন ২১ রান করে ফিরে গেলেও পাকিস্তানের বোলারদের ওপর আক্রমণ করতে থাকেন সৌরভ।

ওয়াকার ইউনুস, সাকলাইন মুশতাকদের বল খেলছিলেন কোন ভয় ছাড়াই। সৌরভের সেই সাহসিকতার প্রভাব পড়লো বিনোদ কাম্বলির ব্যাটেও। সৌরভের সাথেও তিনি খেলেন ৫৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। আগেই বলেছিলেম সৌরভ ইটের জবাব সবসময় পাটকেল দিয়ে দিতেই পছন্দ করেন। পাকিস্তানি সমর্থকদের আক্রমণের জবাব দিয়েছেন প্রতিটা শটে।

তাঁর ব্যাট যেন সেদিন নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৯৬ বলে ৮৯ রান করে যখন আউট হন তখন ভারতের জয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছেন। তারপর শেষ দিকে রবিন সিং এর ৩১ রানের ইনিংসে ৩ বল হাতে রেখেই জয় পেয়েছিল ভারত। ভারত-পাকিস্তানের দ্বৈরথকে সেদিন অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন সৌরভ। সেই সময় ঠিক এমনটাই হতো, বাইশ গজের লড়াইটাকে পাড়ার দোকান, রাজপথ থেকে সীমান্ত অবধি পৌছে দিতেন দুই দলের ক্রিকেটাররা।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link