তিনিও ছিলেন বাংলাদেশের একজন।
সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালদের মত তিনিও হতে পারতেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের তারকা। কিন্তু এক ইনজুরিতে হারিয়েই গিয়েছিলেন ক্রিকেট থেকে। দূর থেকে দেখতেন বন্ধুদের সাফল্য।
সেই হারিয়ে যাওয়া তারকা আবার ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশের নয়, রোনালদোর দেশ পর্তুগালের হয়ে ক্রিকেট মাতাচ্ছেন এখন সাকিবদের সেই বন্ধু। হ্যাঁ, তিনি সিরাজুল্লাহ খাদেম নিপু।
বাংলাদেশ যুব দলের সাবেক এই তারকা এখন পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন। দলটির হয়ে সম্প্রতি চারটি আর্ন্তজাতিক টি-টোয়েন্টিও খেলেছেন তিনি। সর্বশেষ দু ম্যাচে তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন। এই চার ম্যাচে তিনি শিকার করেছেন ৯ উইকেট।
হোক ফুটবলীয় দেশের হয়ে; তারপরও নিপু ফিরে এসেছেন তো বটেই।
নিপু ছিলেন তরুণ প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার; যার সম্ভাবনা ছিল দেশের ক্রিকেটপাগল ভক্তদের জন্য অনেক আনন্দময় মূহর্ত উপহার দেয়ার। কিন্তু তার সব সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছিল দু:খজনক, বিপজ্জনক এবং ক্যারিয়ার শেষ করে দেয়া এক ইনজুরিতে।
২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছিলেন নিপু। বাংলাদেশের দলের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, তারকা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এবং খ্যাতিমান ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালদের সাথে ছিলেন তিনিও। সতীর্থদের ক্যারিয়ার যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, নিপু তখন অসহায়ভাবে ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন; টেনে বেড়াচ্ছিলেন ২০০৯ সালের বাম চোখের ইনজুরি।
নিপু ছিলেন বাঁহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং কার্যকর মিডিয়াম পেস বোলার। তখন ধারনা করা হচ্ছিল বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার হতে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক সব দলেই খেলেছেন। অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে যেমন না দেশ সফর করেছেন, তেমনই ডারউইন লিগে খেলতে গিয়ে আসল নজর কেড়েছিলেন।
নিপুর পারফরম্যান্সগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্বরণীয় হয়ে আছে অস্ট্রেলিয়ান প্রদেশভিত্তিক প্রতিযোগিতা ডারউইন প্রিমিয়ার লিগের ডারউইন ক্রিকেট ক্লাব বনাম পালমেরস্টোন ক্রিকেট ক্লাবের মধ্যকার ম্যাচে। ব্যাট হাতে ৮৮ রানের পাশাপাশি বল হাতে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন নিপু। সতীর্থরা এখনো তার এরকম অর্জনগুলো নিয়ে আগ্রহের সাথে আলোচনা করেন।
সিনিয়র ক্রিকেটার, কোচ এবং সমসাময়িক খেলোয়াড়; যারা একসময় তাঁকে ভবিষ্যতে জাতীয় দল দেখতে চেয়েছিলেন, একসময় তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, আজ তারাই আক্ষেপ করেন খেলা থেকে তার অনাকাঙ্খিত বিদায়ে।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলেছিলেন, ‘সে একজন ভাল অলরাউন্ডার ছিল, যার সহজাত ক্ষমতা ছিল ছিল ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার। এটা ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা যে সে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নামবে এবং দ্রুত কিছু রান করে ম্যাচের দৃশ্যপট বদলে দিবে কিংবা একটি উইকেটে নিয়ে বড় পার্টনারশিপ ভেঙে দিবে।’
মাসুদ আরও বলছিলেন, ‘অনেক আগে থেকেই ক্রিকেট অঙ্গনে সে ছিল সম্ভাবনাময় মুখ। ঠিক সাকিব, তামিম, মুশফিকদের মতো। সেও তাদের মত জাতীয় দল খেলবে এটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল।’
তখনকার বাংলাদেশ হাই পারফর্মেন্স স্কোয়াড-এর কোচ শন উইলিয়ামস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, নিপুই হবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের পরবর্তী তারকা অলরাউন্ডার। উইলিয়ামসই ২০০৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পরপরই এই তরুণ তুর্কিকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছিলেন ডারউইন ক্লাবে খেলার জন্য।
সিরাজুল্লাহ ডারউইন প্রিমিয়ার লিগে খেলার সময়ই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নজর কেড়েছিলেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটেও দারুন শুরু করেছিলেন এই বাহাতি। সিরাজুল্লাহর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় ২০০৫ সালে, সিলেট বিভাগের হয়ে। কিছু সময়ের জন্য তিনি দলের জন্য অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন এবং পরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য ক্লাবের হয়েও খেলেছিলেন প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে।
হবিগঞ্জের এই কিশোর বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সে কঠোর পরিশ্রম করে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন। বিকেএসপিতে তাঁর দক্ষতা নির্বাচকদের নজর কেড়েছিল এবং নিপু তারপর থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭, ১৯, ২৩ দলে, এমনকি বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও।
জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা যখন মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার, ঠিক তখনই সে নিজ শহর হবিগঞ্জে অনুশীলনরত অবস্থায় তার বাম চোখে ইনজুরির শিকার হন নিপু।
‘সেটা ছিল ২০০৯ সাল যখন আমি হবিগঞ্জে অনুশীলন করছিলাম নিজেকে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের জন্য প্রস্তুত করতে। যখন আমি নেটে ব্যাট করছিলাম তখন একটি বল এসে আমার চোখে লাগলো এবং আমাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হয়েছিল’, কান্নাজড়িত কন্ঠে এক সাক্ষাৎকারে বলেন তিনি।
আঘাতের ফলে তার চোখের রক্তপিণ্ডে চাপ তৈরি হয়েছিলো। ডাক্তার তাকে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেন এবং কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে বলেছিলেন যে অবস্থার কোন উন্নতি হয় কিনা। আর কোন উন্নতি হয়নি।
‘আমার চোখের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি সবরকম চেষ্টাই করেছিলাম। আমি আবারো মাঠে ফিরতে চেয়েছিলাম কিন্তু তখন আমার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। আমি পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাইনি, যা আমার চোখের অবস্থা আরো খারাপ করছিল’, বলেছিলেন সিরাজুল্লাহ।
তখন ২৫ বছর বয়সী যুবক, যিনি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি, বিসিবির কাছ থেকে তার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন কিন্তু তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, ‘আমি বোর্ডের কিছু সদস্যের সাথে সেসময় যোগাযোগ করেছিলাম আমার চিকিৎসার ব্যাপারে কিন্তু কেউ আমার কথাই শুনেননি।’
জাতীয় দলের বর্তমান সাফল্য এবং তার পুরোনো সতীর্থদের আলোময় জীবন দু:খ বয়ে আনে একজনের জন্য, যার এসবের অংশ হতে পারার সুযোগ নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
‘আমি বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে ২০০১ সালের ভারত সফরে খেলেছিলাম এবং যাদের সঙ্গে খেলেছিলাম তাদের অধিকাংশই এখন জাতীয় দলে খেলছে।’, বলেন সিরাজুল্লাহ।
নিপু কিছুদিন আগেই বলছিলেন, তিনি দেশের বাইরে চলে যাবেন। সেই চেষ্টাতেই পর্তুগালে স্থায়ী হয়েছেন তিনি। আর সেখানেই আবার ক্রিকেটে খুজে পেয়েছেন নিজেকে। যেভাবেই হোক, আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে ফিরে এসেছেন। যেভাবেই হোক স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর।