অনল প্রভার ফিনিক্স পাখি

২০১৫ সালে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন তখন পুরো ক্রিকেট দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল এই আগুন পাখিকে। ঠিক হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়ের চূড়া থেকে মেঘ দেখতে দেখেতে যেই বিস্ময়ে চোখ ডুবে যায় ততটা বিস্ময় নিয়েই তাঁর আগমন।

বিশাল আকাশ আর সমুদ্রের মিলবন্ধন দেখতে চাওয়ার যে আকুতি সেই আকুতি নিয়েই তাঁকে পড়তে চাইতো গোটা দুনিয়া। মাঝে দাবানলের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছিল তাঁর ঘর। তবে মুস্তাফিজুর রহমান জানেন তিনি আগুন পাখি, তিনি ছাই থেকে জন্ম নেয়া ফিনিক্স পাখি।

ভারতের বিপক্ষে নিজের অভিষেক সিরিজে কী করেছিলেন সেটা এক ইতিহাস। সেই সংখ্যাগুলো দেশ-বিদেশের পত্রিকার পাতায় কিংবা সেই আলোচনা ক্রিকেট দুনিয়া আওড়ানো হয়েছে বহুবার। নেটে হঠাত একদিন কাটার মারার চেষ্টা করতে গিয়ে তাঁর বোলিংয়ে বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন মুস্তাফিজ। বিপ্লব এসেছিল তাঁর জীবনে, বিপ্লব এসেছিলে বাংলাদেশের পেস আক্রমণেও।

একজন পেসার একইরকম বোলিং অ্যাকশনে কাটার, স্লোয়ার, ইয়োর্কার সব করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য যম হয়ে উঠলেন। লেগ স্ট্যাম্পে পিচ করা বলও ঘুরে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছে। ব্যাটসম্যান যেনো বুঝতেই পারছেন না ঠিক কী হচ্ছে।

যেন ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার গতিতে বল করা এক অফ স্পিনার। তাঁর কাটারের জাদুতে আমরা এতই বুদ যে ইয়োর্কারের কথাটা বলতে ভুলে যাই। তাঁর ইয়োর্কারের কোন বর্ণনা আমি দিতে চাই না। আমার চোখে শুধু ভেসে আসে ফিজে ইয়োর্কার সামলাতে গিয়ে ব্যাটসম্যানরা নিজের ভারসাম্য রাখতে পারছেন না, বাইশ গজেই লুটিয়ে পড়ছেন।

এই কাটার আর ইয়োর্কারের সমন্বয়ে ডেথ ওভারের এক দুর্বিষহ নাম হয়ে উঠেন মুস্তাফিজুর রহমান। আইপিএলের মত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও ডেথ ওভারে মুস্তাফিজের বল দেখে খেলছেন ব্যাটসম্যানরা। যেনো টিকে থাকতে পারাটাই এখানে একমাত্র লক্ষ্য। তবে আগুনের সেই দিন ফুরিয়ে এসেছিল। কাটার মারতে পেসারের কাঁধে ভীষণ চাপ পড়ে। সেই চাপ থেকেই কাধের ইনজুরিটা যেনো সব পুড়ে ছারখার করে দিল।

এরপর ইনজুরি কাটিয়ে খেলেছেন মুস্তাফিজ। বিশ্বের নামী দামী সব লিগেও তাঁর ডাক আসা বন্ধ হয়নি। তবে আগের সেই মুস্তাফিজ হারিয়ে গেলেন। ওই সময়টাতে তিনি উইকেট পেয়েছেন নিশ্চই। তবে ব্যাটসম্যানের চোখে সেই বিস্ময়, আকুতি আর দেখা যায়নি। মুস্তাফিজ যেনো আর দশটা সাধারণ বাঁহাতি পেসার।

প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় তাঁর কাটারের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছিল। একই অ্যাকশনে সবগুলো বল করলেও কিছু পার্থক্য তো ছিলই। হয়তো বলটা ধরায় কিংবা আঙুলের পজিশন কিংবা রিলিজ পয়েন্টের উচ্চতায়। প্রযুক্তি এই দুনিয়া প্রমাণ করলো ঈশ্বর তাঁকে সবটা ঢেলে দিয়েছেন নিশ্চই তবে তিনিও একজন মানুষ। ফলে ফিরে আসার লড়াইটা তাঁকে করতেই হতো।

মুস্তাফিজ লড়াইটা করলেন। চারিদিকে যখন রব উঠেছে তিনি আর আগের ফিজ নেই। তিনি হয়তো আর কখনো নিজের চেনা রূপে ফিরতে পারবেন না এমন আলোচনাও হচ্ছিল। সেই সময় মুস্তাফিজ বোধহয় তাঁর পোড়া ছাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলেন। উইকেট পাওয়ার পর যেই লাজুক হাসিটা তিনি হাসেন।

মুস্তাফিজের সেই লড়াইয়ে আশীর্বাদ হয়ে এলে ওটিস গিবসন। বাংলাদেশের এই বোলিং কোচ জানতেন তাঁর হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র মুস্তাফিজই। ফলে তাঁকে হারিয়ে যেতে দেয়া বাংলাদেশের ক্রিকেট এফোর্ট করতে পারেনা। তিনি মুস্তাফিজকে নিয়ে ফিরে আসার পথ খুঁজতে শুরু করলেন। আসলে সমাধানটা আগে থেকেই ছিল। শুধু আরেকবার নতুন করে নিজেকে বলা যে আই অ্যাম দ্য বেস্ট।

এবার মুস্তাফিজের স্লোয়ারে বিপ্লব দেখা গেল। স্লোয়ারটা তিনি আগেও করতেন তবে এবছর আইপিএলে সেটাকেও বিস্ময়ে পরিণত করলেন। আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল তিনি আবার জ্বলে উঠছেন। তবে সেই আভাষের চূড়ান্ত রূপ, সেই অগ্নিমূর্তি দেখা গেল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। সেই আগুনে মিরপুরে ছারখার হলো মাইটি অস্ট্রেলিয়া। ঠিক যতটা উত্তাপ তিনি ছড়িয়েছিলেন ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে। এবার তাঁর অস্ত্র স্লোয়ার।

আমরা বলি মুস্তাফিজ হারিয়ে গেছেন। আমরা বলি ফিরতে হলে তাঁকে নতুন কিছু নিয়ে আসতে হবে। আসলে এই কথা গুলো ভুল। তাঁর মধ্যে সবকিছুই আছে। কাটার, স্লোয়ার, ইয়োর্কার, ইনস্যুইং আরো যা যা চাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য। তাঁর নতুন কোন অস্ত্রের আর দরকার নেই। এরপর থেকে যতবার বলবেন মুস্তা হারিয়ে গেছেন, সাথে এটাও জানবেন ওই ছাই আবার জ্বলবে, বিপ্লব আবার আসবে, কেন না তিনিই আগুন পাখি।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link