তাঁকে নিয়েও হয়তো আনন্দ উল্লাস হতে পারত। নামের আগে কিংবদন্তি শব্দটা জুড়ে দেয়া যেত। অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সেরাদের তালিকায় তাঁর নামটা উচ্চারিত হতে পারত বারবার। মাত্র টেস্ট ক্যারিয়ারের সংখ্যাটা বদলে নামের পাশে থাকতে পারত কয়েকশো উইকেট। তবে এসবই শুধুমাত্র হতে পারত। বাস্তবতার মহাযুদ্ধে এই এক পা দূরত্বও মুরালি কার্তিকের জন্য হয়ে উঠেছিল এক মহাসমুদ্র।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিশ্ব ক্রিকেটে আসা বিশ্বের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি স্পিনারদের একজন ছিলেন মুরালি কার্তিক। ছিলেন লুপ ও কন্ট্রোলের মাস্টার। এছাড়া তাঁর বিখ্যাত আর্ম বল তো ছিলই। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট এমনকি কাউন্টি ক্রিকেটেও ব্যাটসম্যানদের আতঙ্কের নাম ছিলেন তিনি।
তবুও তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার থেমে গিয়েছে মাত্র আট ম্যাচেই। কেননা জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার জন্য তাঁকে লড়তে হয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দুই স্পিনার অনিল কুম্বলে ও হরভজন সিংয়ের সাথে।
১৯৭৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদ্রাজ শহরে। দিল্লী জুনিয়র ক্রিকেটের মাধ্যমে তাঁর যাত্রাটা শুরু হয়। সেই সময় ব্যাট-বল দুটোই করতেন সমান তালে। মজার বিষয় হচ্ছে ১৫ বছর বয়সী মুরালি কার্তিক হতে চাইতেন স্যার গ্যারি সোবার্সের মত।
ফলে, কার্তিকও করতেন মিডিয়াম পেস। তবে ৫ ফুট ২ ইঞ্চির কার্তিককে তাঁর কোচ পরামর্শ দিয়েছিলেন স্পিন বোলিং করতে। এরপর আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাননি তিনি। তালিম নিয়েছেন ভারতের দুই কিংবদন্তি বিষান সিং বেদী ও মহিন্দর সিং এর থেকে।
দিল্লী অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে খেললেও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে পারেননি। যদিও পরে দিল্লীর মূল দলের হয়ে খেলেছিলেন রঞ্জি ট্রফি। দিল্লী অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা না পেয়ে চলে গিয়েছিলেন রেলওয়ের হয়ে খেলতে। পরে ক্যারিয়ারের পুরো সময়ই রেলওয়ের হয়ে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন এই স্পিনার।
১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে রেলওয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছিলেন ৫ টি ম্যাচ। সেখানে ১৪.৫৮ গড়ে নিয়েছিলেন ২৪ উইকেট। পরের বছর নিয়েছিলেন আরো ৩৮ উইকেট। ফলে সেই সময় ডাক আসে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে। যুব দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টের প্রথম ইনিংসেই নিয়েছিলেন চার উইকেট। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে নেন আরো ৩ উইকেট। পরের দুইটি ওয়ানডে ম্যাচেও ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে নেন তিনটি করে উইকেট।
ফলে ১৯৯৬-১৭ মৌসুমে রেলওয়ে মূল দলে জায়গা করে নেন এই স্পিনার। সেই মৌসুমে ১৯.৩৭ গড়ে নিয়েছিলেন ১৬ উইকেট। এছাড়া ব্যাট হাতেও করেছিলেন ১৮৫ রান। এর মধ্যে বাংলার বিপক্ষে ৭৪ রানের একটি ইনিংসও ছিল। এর পরের মৌসুম গুলোতেও ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর রাজত্ব চলতে থাকে।
এরপর ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ভারত এ দলের হয়ে দুর্দান্ত কিছু পারফরম্যান্স দেখান এই স্পিনার। শেষে ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট দলে ডাক পান কার্তিক। নিজের অভিষেক ইনিংসে মাত্র ২৮ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ২ উইকেট।
তবে, এরপর ঢাকায় বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে পেয়েছিলেন মাত্র এক উইকেট। এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নেন ২ উইকেট। সেই সময় ভারতের নয়া অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি আর মুরালি কার্তিকের উপর ভরসা রাখতে পারেননি। ফলে দল থেকে বাদ পড়ে যান এই স্পিনার।
ওদিকে ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক হয় আরো দুই বছর পরে। ওয়ানডে ক্রিকেটে বলার মত তেমন কোন পারফর্মেন্স করতে পারেননি। তবে ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে মাত্র ২৭ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। সেই ম্যাচে ব্যাট করতে নেমেও ২১ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে ভারতের হয়ে খেলা ৩৭ ওয়ানডে ম্যাচে তাঁর উইকেট সংখ্যাও ঠিক ৩৭ টি।
ওদিকে ২০০৪ সালে টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে নিয়েছিলেন মোট ৭ উইকেট। মুম্বাইয়ের সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪৪ রান দিয়ে নেন চার উইকেট। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২ রান দিয়ে নেন আরো ৩ উইকেট। সব মিলিয়ে ভারতের হয়ে খেলা ৮ টেস্টে ৩৪.১৬ গড়ে নিয়েছেন ২৪ উইকেট। এছাড়া ভারতের হয়ে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছিলেন এই বাঁ-হাতি স্পিনার।
ভারতের এই বাঁ-হাতি স্পিনার কাউন্টি ক্রিকেটের মোট চারটি দলের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া তিনিই ভারতের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টি দুটোই খেলেছেন। ওদিকে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের এই মাস্টার মোট ২০৩ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলেন। সেখানে ২৬.৭০ গড়ে নিয়েছেন ৬৪৪ উইকেট। এছাড়া ১৯৪ লিস্ট এ ম্যাচেও তাঁর ঝুলিতে আছে ২৪৯ উইকেট।
এত কিছুর পরেও ভারতের জাতীয় দলে কখনো নিয়মিত হতে পারেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সেরাদের সেরা হয়ে ওঠা হয়নি মুরালি কার্তিকের। এই দোষটা যতটা না কার্তিকের তার চেয়ে বেশি সময়ের। কেননা, তাঁর সময়েই ভারতীয় দলে ছিলেন দেশটির ইতিহাসের সেরা দুই স্পিনার। ফলে জাতীয় দলে জায়গা পাওয়াটাই তাঁর জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর গলফ খেলায় মনোযোগ দেন কার্তিক। এখন সময় কাটে ধারাভাষ্য কক্ষে।