লক্ষ্মণ হয়ে দংশে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে

ভারতের ক্রিকেট তখন আবার নতুন করে একটা পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সেই পথের অগ্রণী সৈনিক মহেন্দ্র সিং ধোনি। দেশটাকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানোর পর ওয়ানডে ও টেস্ট দলটাও সাজিয়েছিলেন মনের মত করে। সেখানে অভিজ্ঞ রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকারদের সাথে ছিল সুরেশ রায়নাদের মত তারুণ্যের মিশেল। টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিততে শিখানো অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ধোনি।

২০১০ সালের বিখ্যাত সেই মোহালি টেস্টের কথা বলছিলাম। টেস্ট সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া সেবার ভারতে এসেছে। রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কদের সেই রোমাঞ্চকর টেস্ট দল। ভারত দলেও তখন আছেন শচীন, রাহুল দ্রাবিড়, বীরেন্দ্র শেবাগরা। এছাড়া নতুন দিনের মশাল হিসেবে আছেন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। তবুও ভারতের চায়ের দোকান গুলোতে সকাল থেকে কানাঘুষা চলে। ধোনিরা পারবে তো? তাঁদের জিততে সেখানো সেই অধিনায়ক যে নেই, সৌরভ যে নেই, দাদা যে নেই।

অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং ব্যাটিং নিয়ে এক মুহূর্তও ভাবেননি। অধিনায়কের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ওপেনার শেন ওয়াটসন। টেস্টের প্রথম দিন সকালের ধাক্কাটা সামলে দিয়েছিলেন তিনি। বাইশ গজে ছিলেন ঠিক ৪৬১ মিনিট। জহির খান আলোটা কেড়ে নেয়ার আগে শেন ওয়াটসনের ব্যাট থেকে আসে ৩৩৮ বলে ১২৬ রানের ইনিংস। এরপর সেই রান উৎসবে যোগ দেন অধিনায়ক পন্টিংও।

রিকি পিন্টিং এর ৭১ রানের ইনিংসে ভর করে বড় সংগ্রহের দিকেই এগোতে থাকে অস্ট্রেলিয়া। তবে আঘাতটা হানেন জহির খান। অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডার একাই ধ্বসিয়ে দেন এই পেসার। ইনিংস শেষে ৯৪ রান দিয়ে নেন ৫ উইকেট। তবুও বিপদ যা হবার হয়ে গিয়েছিল ভারতের জন্য। ওয়াটসন, পন্টিংরা স্কোরবোর্ডে জমা করলেন মোট ৪২৮ রান।

বড় রানের জবাবে ব্যাট করতে নামা ভারতও শুরু করেছিল দেখেশুনেই। গৌতম গম্ভীর, শেবাগের ৮১ রানের জুটি ভারতকে সাহস দেয় লড়াই করবার। এরপর রাহুল দ্রাবিড়ের ৭৭, শচীনের ৯৮ ও রায়না ৮৬ রানের ইনিংস গুলো জানান দেয় ভারত লড়াই করাটা ভোলেনি। সৌরভের দেখানো পথটাই ভারত এখনো হাটছে। কলকাতার পথঘাটে প্রশান্তি নামে, ভারতের রাস্তায় মোহালি টেস্ট উত্তাপ ছড়ায়।

দ্বিতীয় ইনিংসে আবার জহির খান আলোটা নিজের দিকে নিয়ে নিলেন। এবার আর অজিদের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেননি। জহির ও ইশান্তের সামনে মুখ থুবরে পড়ে অজিদের ব্যাটিং লাইন আপ। চতুর্থ ইনিংসে ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন তখন মাত্র ২১৬ রান। ভারতের সামনে তখন পুরো একদিন, চতুর্থ দিনের শেষ ১৭ ওভার ও জয়ের গন্ধ।

কাজটা বেশ সহজই মনে হচ্ছিল তখন। ভারতের সামনে আছে অঢেল সময় ও হাতে দশটি উইকেট। জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র ২১৬ রান। তবে দুপুর গড়িয়ে বিকাল না হতেই ভারতের আকাশে কালো মেঘ আসে। জয়ের গন্ধের পিছনে যেতে যেতে কখন যেন পথটাই হারিয়ে ফেলে ধোনিরা। চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখটা অপলক দৃষ্টিতে টিভি পর্দায় আঁটকে যায়, দূরের কোন গ্রামে খেলা দেখতে যাওয়া যুবকের দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা একের পর এক উইকেট দিয়ে আসতে থাকেন। গম্ভীর, শেবাগ, দ্রাবিড়, তারপর রায়নাও। মাত্র ৪৮ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। চতুর্থ দিনের খেলা শেষে ভারতের স্কোরবোর্ডে লিখা ৫৫ রানের ৪ উইকেট। ভারতের সামনে পঞ্চমদিনের টিকে থাকার লড়াই। এবার বুঝি দূর থেকে আসা নি:শ্বাসের শব্দ গুলো শুনতে পারছিলেন লক্ষনরাও।

পরের দিনও উইকেট দিয়ে আসার ধারা অব্যহত থাকে। একটা ১২৪ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলা ভারত বোধহয় জয়ের আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তবে বাইশ গজে দাঁড়িয়ে কোন এক অপলক দৃষ্টি কিংবা কোন এক দীর্ঘশ্বাসের ঋন মেটাতে চেয়েছিলেন লক্ষ্মণ ও ইশান্ত। ইশান্তের ৩১ ও লক্ষ্মণ ৭৩ রানে দুইশোর কোটা পার করে ভারত। তবে ২০৫ রানে ইশান্ত ফিরে গেলে আবার বিপাকে পড়ে ভারত।

তবে বাইশ গজে তখনো লক্ষণ ছিলেন। নিজের শেষ সঙ্গী প্রজ্ঞান ওঝাকে নিয়েই বাকি পথটা পাড়ি দিলেন তিনি। এক উইকেটের এক অবিস্মরণীয় জয় পেল ভারত। সেদিন জিতেছিল লক্ষণ, জহির খানরা। সেদিন জিতেছিল ভারতের প্রতিটি চায়ের কাপ, টিভি পর্দা কিংবা দূর গ্রামে খেলা দেখতে যাওয়া সেই যুবকও।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link