চার ছবির চরিত্র একজনই – ২২ গজে মাইকেল ভনের বিপক্ষে যিনি আবেদন করছেন, তিনিই আবার রাগবি বল হাতে। স্ত্রীকে নিয়ে পোজ দিচ্ছেন চিতার সঙ্গে, শিশুদের মাঝে হাস্যোজ্বল তিনি সফল ডাক্তারের ভূমিকায়। আমাদের চেনা জগতেও তিনি অন্যরকম একজন, যাকে কোনো সীমানায় আটকে রাখা যায় না, কোনো গণ্ডিতে বাঁধা যায় না, সুনির্দিষ্ট পরিচয়ে ধারণ করা যায় না! তিনি রুডি ফন ভুরেন।
১৯৯৯ রাগবি বিশ্বকাপে নামিবিয়ার হয়ে খেলেছেন। খেলেছেন ২০০৩ রাগবি বিশ্বকাপেও। খুব ভালো রাগবি প্লেয়ার নিশ্চয়ই!
মজার ব্যাপার হলো, ২০০৩ সালে রাগবি বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগে খেলেছেন ক্রিকেট বিশ্বকাপে! দ্বিতীয় ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিডিয়াম পেসে নিয়েছিলেন ৪৩ রানে ৫ উইকেট, এখনও যা নামিবিয়ার সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। পরের ম্যাচে ৫০ ওভারে ভারতের কেবল দুটি উইকেটই নিতে পেরেছিল নামিবিয়া। দুটিই নিয়েছিলেন এই তিনি, বীরেন্দ্র শেবাগ ও শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট। পরে অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে অবশ্য ১০ ওভারে হজম করেছিলেন ৯২ রান। ড্যারেন লেম্যান এক ওভারেই নিয়েছিলেন ২৮ রান, সেই সময়ের বিশ্বকাপ রেকর্ড। রেকর্ড তো!
একই বছর ক্রিকেট ও রাগবি বিশ্বকাপ খেলা ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি রুডি ফন ভুরেন। অথচ কোনোটিই তার পেশা নয়! তিনি মূলত একজন ডাক্তার। ডাক্তারিতেও তিনি আর দশজনের চেয়ে আলাদা। তার বিচরণ নানা শাখা-প্রশাখায়। এমনিতে জেনারেল প্র্যাকটিশনার। আবার দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন এইডস রোগীদের নিয়ে। এক পর্যায়ে ভাবলেন, এইডস জর্জরিত নামিবিয়ায় শুধু আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করলেই চলবে না। ব্যস, শুরু করলেন এইডস বিরোধী আন্দোলন, সচেতনতা বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপ।
তাঁর দেশে সন্তান জন্মের সময় মাতৃ মৃত্যুর হার অনেক বেশি। ভদ্রলোক শুরু করলেন অবসটেট্রিশিয়ানের কাজ। ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্তান প্রসবে সহায়তা করেন। মাসে গড়ে ১২টি শিশু নিরাপদে পৃথিবীর আলোয় আসে তার হাত ধরে!
মানুষের জন্য এত মায়া, অন্যান্য প্রাণীরা মায়ার ছোঁয়া থেকে বাদ যাবে কেন! স্ত্রী মার্লিসের সঙ্গে মিলে ২৫ হাজার একর জায়গা নিয়ে চালু করেছেন একটি বণ্যপ্রাণী আশ্রয়স্থল। নাম ‘নানকুসে’ ( অর্থ: ইশ্বর আমাদের রক্ষা করবেন) ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি। পুরো আফ্রিকায় বিখ্যাত এটি। অসহায়, অনাথ পশুদের আশ্রয় মেলে, অসুস্থ-চোটাক্রান্ত পশুদের চিকিৎসা করা হয়, হয় প্রজনন।
এই ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী আবার পরিবেশবিদও। নানকুসেতে পরিবশে গবেষণাগার আছে। আদিবাসীদের জন্য স্কুল, ক্লিনিক গড়া হয়েছে। আদিবাসীদের উন্নয়নে অনেক কাজ করেন তিনি।
যথন খেলতেন, তার দম ফেলার অবকাশ ছিল না। ভোর ৫টায় উঠে ট্রেনিং। ক্রিকেটের মৌসুমে ক্রিকেট, রাগবি মৌসুমে রাগবি। এরপর হাসপাতাল, সার্জারি, অন্যান্য কাজ। যদি কোনো ইমার্জেন্সি না থাকে তাহলে বিকেলে আবার ট্রেনিং ও জিম। সন্ধ্যা থেকে অন্য সবকিছু।
খেলা ছাড়ার পর আরও ব্যস্ত হয়েছেন তার ডাক্তারি ও ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি নিয়ে। নানকুসের আকার বেড়েছে, কাজের পরিধি বেড়েছে। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও ব্র্যাড পিট তাদের ফাউন্ডেশনের পার্টনার করে নিয়েছেন নানকুসেকে। সারা বিশ্ব থেকেই ফান্ড আসে।
স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মানবসেবা, প্রাণীসেবার তুমুল ব্যস্ততায় অদ্ভূত আনন্দময় তার জগত। ব্যস্ততার ফাঁকেই মাঝেমধ্যে যখন মনে হয়, একদিন বল করেছেন গিলক্রিস্ট-টেন্ডুলকারদের, রাগবি বল হাতে ছুটেছেন জর্জ গ্রেগান ও স্টিভ লার্কহ্যামদের বিপক্ষে, তার নিজেরই কেমন বিশ্বাস হতে চায় না! আসলেই, ফ্যাক্টস আর স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশনস।
হয়ত রাগবি বা ক্রিকেটের কুলীন জগতের কেউ নন বলে প্রচারের আলো তাকে স্পর্শ করে না ততটা। এই উপমহাদেশের কেউ বা ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার হলে এতদিনে মহামানব আখ্যা পেয়ে যেতেন! এসবে নিশ্চয়ই তার যায়-আসেও না। আলোতে আসা নয়, তাঁর ব্রত আলো ছড়িয়ে যাওয়া!
– ফেসবুক থেকে