রেফারি যখন প্রতিপক্ষ

বাংলাদেশ-নেপাল ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে দু ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জেতার পরও নেপালিরা আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। প্রথমবার ফাইনালে ওঠার পর কারও চোঁখে কাঁন্না চলে আসে। অনেকটা হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতোই অবস্থা হয়ে যায় হিমালয় কন্যা দেশের ফুটবলার থেকে শুরু করে কোচ আর কর্মকর্তাদের।

উল্টোদিকে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা রাজ্যের হতাশা আর কষ্ট নিয়ে ঘিরে ধরে উজবেকিস্তানের রেফারি আর আখরোলকে ঘিরে ধরেন। যদিও তাকে খুব বেশিকিছু বলার আগেই খেলা শেষে তৈরি থাকা মালদ্বীপ পুলিশ তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দর্শকদের মধ্যেও। তারা রেফারিদের গালাগাল করতে থাকেন বলেও শেনা যায়।

কিন্তু, একজন সেখানে একেবারেই আলাদা হয়ে কাদঁতে কাদঁতে হয়রান হয়ে পড়েন। তিনি মোহাম্মদ মহসিন। জাতীয় দলের এই টিম এটেনডেন্ট গত দুই দশক ধরে দলটির সাথে রয়েছেন। আনন্দের চেয়ে কষ্টই বেশি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু নেপাল ম্যাচের পর যেভাবে চোঁখের পানি পেলেছেন তাতে করে দেশের প্রতি তার ভালবাসা আর মমত্ববোধই প্রকাশ পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মহসিনের ছবিগুলো বেশি করে শেয়ার করেছেন স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। তাইতো বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে অন্যতম সেরা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর সেই বিখ্যাত গান, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি।’ ফুটবলটা এখন কষ্টের আরেক নাম হয়ে আছে।

টানা পাঁচটি সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া বাংলাদেশ তাই এখন খাঁদের কিনারে দাড়িয়ে থাকা একটি দল। ৮৭ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলের লিড ধরে রেখেও জয় নিয়ে ফাইনালে ওঠা হয়নি জামাল ভুইয়ার দলের। হস্তারক সেই একই দল নেপাল। ২০১৮ সালের ঘরের মাঠে এই নেপালের বিপক্ষে যেখানে ড্র করলেই ফাইনাল নিশ্চিত ছিল বাংলাদেশ দলের, সেই ম্যাচটা ২-০ গোলে হেরে গিয়েছিল।

এবার নেপালের যেখানে ড্র প্রয়োজন ছিল সেখানে বাংলাদেশের জয়। বাল গোপাল মহাজন, হরি খড়কা, নরেশ যোশীর উত্তরসূরীরা প্রয়োজনীয় ১ পয়েন্ট নিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার পৌছে গেল ফাইনালে। বাংলাদেশ পারেনি ১৬ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে আবারও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জায়গা করে নিতে। আরেকবার কষ্ট, কাঁন্না আর হতাশা নিয়েই দেশে ফিরে আসতে হবে। অথচ বাংলাদেশের ফাইনালে খেলার মঞ্চটা যেন তৈরিই ছিল। কিন্তু সেখানে ওঠা হয়নি অস্কার ব্রুজোনের শীষ্যদের।

নেপালের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায় উজেবিকস্তানের রেফারী। গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকোর লাল কার্ড থেকে শুরু করে একেবারে শেষ মুহুর্তে পেলান্টি সবই যেন পরিকল্পনা করেই করা হয়েছে। নয়তো এই ম্যাচে বাংলাদেশ দলের না জেতার কোন কারণই নেই। অথচ জয় থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে থেকেও বড় অর্জন সম্ভব হয়নি। যে মুহূর্তে বাংলাদেশ মনে মনে জয়েল ভাবনা ভাবতে থাকে ঠিক সেই মুহূর্তেই বিতর্কিত এক পেনাল্টি উপহার দেওয়া হলো নেপালকে।

তবে এটিকে অনেকেই টুর্নামেন্টের ফাইনালটাই নেপালকে উপহার দিলেন রেফারি, এই বলে মন্তব্য করেছেন। আর তাতেই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদঁনায় আরেকবারের জন্য পুড়তে হলো বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষকে। মাঠে রেফারীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ম্যাচ শেষে গড়িয়েছে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্তও। বাংলাদেশ কোচ অস্কার ব্রুজোন তো অনেকটা সরাসরি জানিয়েই দিলেন, ভারত ম্যাচের পর থেকে বাংলাদেশের বিপক্ষে অদৃশ্য শক্তি কাজ করেছে। বাংলাদেশকে যারা ফাইনালে দেখতে চায়নি তারাই মালদ্বীপের পর নেপাল ম্যাচেও একই কাণ্ড ঘটিয়েছে।

অথচ দক্ষিন এশিয়ার ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা সাফের সভাপতি-সাধারন সম্পাদক দুজনই বাংলাদেশের। সভাপতি আবার বাফুফে সভাপতি কাজি সালাউদ্দিন। আর সাধারন সম্পাদক বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল। সর্বোচ্চ পদে এই দুজন থাকার পর বাংলাদেশকে ন্যায় বিচাঁর পাওয়া নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর কোন বিবৃতিও পাওয়া যায়নি। ব্রুজোনের কথা ধরে এগুলো বলতে হবে, মালদ্বীপ ম্যাচ থেকেই রেফারী বাংলাদেশের বিপক্ষে বাশি বাজিয়েছে।

সেটি অব্যহত ছিল ’সেমিফাইনাল’ ম্যাচ হিসেবে গুরুত্ব পাওয়া নেপালের বিপক্ষে ম্যাচেও। এর আগে ২০০৫ সালে সর্বশেষ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে একমাত্র শিরোপা জয় তারও দুই বছর আগে ২০০৩ সালে। মালদ্বীপের রাজধানী মালের রাশমি ধান্দু স্টেডিয়ামে গোলরক্ষক জিকোর ওই লাল কার্ডটাই ফাইনালের লড়াই থেকে ছিটকে দিয়েছে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি রাকিব হোসেনের অমার্জনীয় ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

ডি বক্সের বাইরে বেরিয়ে এসে ইচ্ছে করে হাতে বল না লাগালেও দেশসেরা এই গোলরক্ষককে লাল কার্ড দেখান রেফারী। একটা বিতর্ক শেষ হওয়ার মিনিট কয়েক পরই আরেকটা চরম বিতর্কের জন্ম দেন রেফারী ও লাইন্সম্যানরা মিলে। ৮৮ মিনিটে ডি বক্সের ভেতরে অঞ্জন বিষ্টাকে হেড নিতে বাধা দিয়েছিলেন সাদ উদ্দিন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অঞ্জনকে নাকি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু রিপ্লেতে পরিস্কারভাবে দেখা মেলে সাদ আসলে তাকে ধাক্কা দেননি।

অনেকটা পেলান্টি আদায় করে নেওয়ার মতো অভিনয় করেই বিষ্টা নেপালকে পাইনালে নিয়ে গেছেন। প্রশ্নবিদ্ধ পেনাল্টিতে গোল করতে এতটুকু ভুল করেননি অঞ্জন। অথচ জেতার সমীকরণ মেলাতে বাকি কয়েক মিনিটে গোল আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। কেবল রেফারির সমালোচনা করতে ছাড়েননি বাংলাদেশ কোচ, সেই সঙ্গে এক হাত নিয়েছেন নেপালের খেলোয়াড়দেরও। তাদেরকে প্রতারক হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন ৪৪ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ। এর আগে গত আগষ্ট মাসে এএফসি ক্লাব কাপে একই পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছিল বসুন্ধরা কিংসকে।

একই ভেন্যুতে কষ্টটা আরো একবারের মতো পেল লাল সবুজ ফুটবলাররা। ভারতীয় ক্লাব মোহনবাগান এফসির বিপক্ষে ম্যাচে এভাবেই এক গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত দশজন নিয়ে ড্র করেছিল বসুন্ধরা কিংস। এই ড্রয়ের ফলে কিংসের বদলে মোহনবাগান টুর্নামেন্টের পরের রাউন্ডে জায়গা করে নেয়। এর ঠিক দুই মাস পর জাতীয় দলেও একই ঘটনার শিকার হন অস্কার ব্রুজোন। এই ম্যাচেও তার দল দশজনে পরিণত হয় এবং টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link