সাফল্যেই আসুক ধাঁধার সমাধান
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে খেলা ৭১-এর বিশেষ আয়োজন বিশ্বসংসারে বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপে পুরো বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন ১৫ জনের একটি দল। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নেতৃত্বে এই দলের সাথে গেছেন একজন বিকল্প ক্রিকেটারও। সবমিলিয়ে ১৬ জনের এক খণ্ড বাংলাদেশ, যারা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন বিশ্ব সংসারে। তাঁদের নিয়েই ধারাবাহিক বিশ্লেষণের এবারের পর্বে থাকছেন সাকিব আল হাসান।
সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কে? – এই প্রশ্নের জবাবে ছোট্ট পাঁচ-সাত জনের তালিকা আসবে – তাতে থাকবেন তিনি।
টি-টোয়েন্টি জমানার সেরা অলরাউন্ডার কে? – পরিসংখ্যান বলে এখানেও সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও দিব্যি রেখে দেওয়া যায় তাঁকে।
আর যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কিংবা ক্রিকেটার কে? – সম্ভবত খুব বিতর্ক ছাড়াও এই প্রশ্নের জবাবে একমাত্র তাঁর নামই আসবে।
নামটা হল সাকিব আল হাসান। তবে, এত কিছুর পরও সাকিবকে সেরার কাতারে তুলতে একটা যদি কিন্তু থাকে। কারণ, সাকিবের নামের পাশে এখনও বড় কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি নেই। বাংলাদেশের হয়ে একাধিকবার তিনি এশিয়া কাপের শিরোপা জয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন, কাজে লাগাতে পারেননি।
ওয়ানডে বিশ্বকাপে এখন অবধি বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা পারফরমার তিনি। ২০১৯ বিশ্বকাপে তিনি ৬০৬ রান করেন, উইকেট পান ১১ টি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক আসরে এমন অতিমানবীয় অলরাউন্ডারের দেখা আগে কখনোই পাওয়া যায়নি। দিব্যি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও হতে পারতেন, কিন্তু দলই যেখানে সেমিফাইনালে যায়নি সেখানে সাকিবকে বিবেচনায় আনা হয়নি।
সাকিবের বড় সমস্যা এটাই। সাকিব যতই মহীরূহ হন না কেন – সাকিবের সাথে তাল মিলিয়ে পারফরম করতে পারে না বাংলাদেশ। তাঁরই সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৯ বিশ্বকাপে। যোগ্য কয়েকজন সঙ্গী পেলে নি:সন্দেহে বিশ্বকাপটা আরো স্মরণীয় হয়ে থাকতো বাংলাদেশের।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সাকিব সেরাদের একজন। ২০০৭ থেকে শুরু করে এখন অবধি সবগুলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই দলের অন্যতম ভরসা ছিলেন তিনি। ২৫ টি ম্যাচ খেলে এখানে তিনি পেয়েছেন ৩০ টি উইকেট। রান করেছেন ৫৬৭। স্ট্রাইক রেট ১৩০-এর কাছাকাছি। করেছেন তিনটি হাফ সেঞ্চুরি। তিনি বড় আসরের বড় ক্রিকেটার।
খালি চোখে, তিনি সাদামাটা একজন ক্রিকেটারই। সাকিবের ব্যাটিং টেকনিকের অনেক দুর্নাম আছে। বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে বোলিংয়ে তাঁর অস্ত্রভাণ্ডারে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। এরপরও সাকিব নিয়মিত যেকোনো ফরম্যাটের অলরাউন্ডারদের তালিকায় ওপরের দিকে থাকেন। নিয়মিত রান করেন, উইকেট পান।
কারণ কি?
কারণ সাকিব এই সময়ের অন্যতম চৌকস খেলোয়াড়। ব্যাটিং-বোলিং কিংবা ফিল্ডিং মিলিয়ে তিনি পারফেক্ট একটা প্যাকেজ, প্রচণ্ড কার্য্যকর। সাকিবের ম্যাচ রিড করতে পারার ক্ষমতা অসামান্য। সাকিব জানেন কিভাবে নিজের সীমাবদ্ধটাকেই নিজের শক্তিতে পরিণত করা যায়। বিশ্বের যেকোনো দল সাকিবের মত একজনকেই খোঁজে।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর সাকিবের ক্রিকেটীয় জীবনেও বড় একটা পালাবদল। বাজিকরের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব আইসিসিকে না জানিয়ে এক বছর থাকেন মাঠের বাইরে। এরপর আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন, পারফরমও করেছেন। কিন্তু, বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি।
শুধু এটা নয়, এর আগে পরে কখনো গ্যালারিতে দর্শক পিটিয়ে, কখনো ক্যামেরায় অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি করে, কিংবা ঘরোয়া লিগের মাঠে আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদে স্ট্যাম্প ভেঙে সাকিব আরেকটা তকমাও পেয়েছেন। তিনি একালের ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’। তিনি সেই ব্যাড বয় যিনি পারফরম্যান্স নিয়ে সব কিছু জয় করতে জানেন। এবার শুধু বড় একটা ট্রফি জিতলেই সাকিব আল হাসানের নাম বিশ্ব ক্রিকেটের পাতায় সোনার অক্ষরে লিখে রাখা যাবে।
আমরা অবশ্য তাঁকে ঠিক ‘ব্যাড বয়’ বলতে চাই না। তিনি হলেন একটা ধাঁধা। সেই ধাঁধায় আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক – সবই থাকে। সবচেয়ে বেশি থাকে হল পারফরম্যান্স। আর এই পারফরম্যান্সই শক্তি হয়ে উঠুক সাকিবের, বাংলাদেশের। একটা ট্রফি আসুক, যে করেই হোক। স্বপ্ন না, এটা লক্ষ্য হোক। ধাঁধার সমাধানে আসুক একটা বিশ্বকাপের সোনালি ছোঁয়া।
সাকিবও সেটা জানেন, মানেনও। সেই অনুযায়ী কাজও করেন। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে সর্বশেষ যে কয়টা ম্যাচে খেলেছেন, তাতেই নিজের ক্ষুধাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই সাকিবের ক্ষুধাটা আরো বড়। সাকিব বারবারই বলেন, দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে চান তিনি। এবারও নিশ্চয়ই স্বপ্ন সেটাই, লক্ষ্যও সেটাই। স্বপ্ন আমরাও দেখতে চাই। কিন্তু, ভয় লাগে, স্বপ্ন ভঙ্গের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকা যে আর বেশি কেউ নেই।
তবে, সত্যিকার অর্থে সাকিবের হাতে অন্তত একটা বিশ্ব শিরোপা ওঠা দরকার। সময়ও খুব বেশিদিন বাকি নেই। সাকিবের বয়স প্রায় ৩৫ ছুঁইছুই। আর কয়েকটা মাত্রই আসর তিনি পাবেন এই সুযোগ। সাকিব কি পারবেন, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে?
ক’দিন আগে উইজডেন ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদন দাবি করেছিল, ১৪ নভেম্বর মানে বিশ্বকাপের ফাইনালের রাত হতে পারে বাংলাদেশের। আমরা ততটা আশাবাদী না হই, তবে এটা ঠিক যে শতভাগ দিয়ে খেলতে পারলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হতে পারেন সাকিব। আর নিশ্চয়ই সেটা করতে পারলে তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সের ওপরও। তবে, শুধু প্রভাব পড়াটাই যে যথেষ্ট নয় – সেটা তো আগেই বললাম। সাকিবের যোগ্য সঙ্গও দরকার।