হ্যারিকেন হারিস

ব্যাটার নিউজিল্যান্ডের অভিজ্ঞ মার্টিন গাপটিল স্ট্রাইক প্রান্তে অপেক্ষারত। দলের সংগ্রহ ততক্ষণে ৭.২০ রানরেটে পাঁচ ওভার শেষে ৩৬। বড় সংগ্রহের পথে কিউইরা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। দরকার ব্রেকথ্রু। পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম বল রুপে ব্রেকথ্রুয়ের দায়িত্ব তুলে দিলেন হারিস রউফের হাতে। প্রথম বলেই যেন চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো গাপটিলের। হারিস বল ছুড়েছেন ১৪৯ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে। তাঁর উপর পিন পয়েন্ট ইয়োর্কার।

নিজেকে সামলে নিলেন গাপটিল। প্রস্তুত হয়ে নিলেন পরের বলের জন্যে। কিন্তু ছানাবড়া হয়ে যাওয়া চোখে যেন দ্বিতীয় বল দেখলেনই না গাপটিল। একটু রুম বানিয়ে খেলতে গিয়ে ১৪৮ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় আসা বলের গতিতে পরাস্ত হলেন। বিধিবাম! ইনার প্যাডে বল লেগে তা স্ট্যাম্পে লাগলে হারিসের উইকেটে পরিণত হন গাপটিল। পাকিস্তান পেয়ে গেলো কাঙ্খিত ব্রেকথ্রু।

সেই ম্যাচে হারিস শেষের দিকে এসে নিজের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং এ তুলে নেন আরো তিনটি উইকেট। নিউজিল্যান্ডের বড় রানের আশায় প্রথম আঘাত করা হারিস তাঁর সতীর্থদের সহয়তায় নসাৎ করে দেয় কিউইদের সকল প্রত্যাশা। কিন্তু এই যে আশার আলো জাগানো হারিসের উত্থানের পেছনের গল্প যে অনায়সে বনে যেতে পারে একটি সুপারহিট সিনেমার পটভূমি তা ঠিক কতজনের জানা? আসুন তবে সেই পটভূমি থেকে একটু ঢুঁ মেরে আসা যাক।

হারিস রউফ পাকিস্তানের অতি সাধারণ একজন ছেলে। পাড়া-মহল্লায় খেলে বেড়ানো নিতান্ত সাধারণ একজন যুবক। ক্রিকেট থেকে যার মনোযোগ ফুটবলেই বেশি। নিজ কলেজের হয়ে ফুটবলে জিতেছেন ট্রফিও। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক দিক বিবেচনায় কিংবা নিজের হাতখরচের তাড়ণায় একটা পার্টটাইম চাকরিও করতেন হারিস। গেলো ২০১৬ বিশ্বকাপেও যিনি ছিলেন নিতান্তই একজন মহল্লার ছোকড়া, যার ধ্যানজ্ঞানে নেই ক্রিকেট কিংবা নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেটীয় দীক্ষা। পাঁচ বছর বাদে ২০২১ সালে এসে বনে গেছেন পাকিস্তানের অন্যতম বোলিং ভরসার নাম।

তাঁর উত্থানের পেছনের গল্পে বিশাল বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে পাকিস্তানের ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের  দল লাহোর কালান্দার্স। লাহোর কালান্দার্স তাঁদের নিজেদের প্রয়োজনেই আয়োজন করেছিল ট্যালেন্ট হান্টের। সেই ট্যালেন্ট হান্ট থেকেই উঠে আশা হারিস রউফের।

পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির ছেলে রউফ। সেই রাওয়ালপিন্ডি যেখান থেকে উঠে এসেছেন পাকিস্তানের গতিদানব শোয়েব আখতার। তিনি শোয়েব আখতারকে ছাড়িয়ে যাবেন কি না তা পরের হিসাব। আগে তাঁর স্বপ্নযাত্রার পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা সেড়ে নেওয়া যাক।

লাহোর কালান্দার্সের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালা নামক এক শহরের ট্রায়াল থেকে উঠে আসা হারিস রউফের ডাক এসে যায় অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ দল মেলবর্ন স্টার থেকে। তাঁদের দলে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকান পেস সেনসেশন ডেইল স্টেইনের ইনজুরি যেন হারিসের জন্যে ছিল স্বপ্নের যাত্রার উন্মুক্ত দাঁড়। ২০১৮ সালে লাহোর কালান্দার্সের সাথে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করা হারিস ২০১৯ এ নাম লেখান বিগব্যাশের মেলবর্ন স্টারে। সেখানে দুই মৌসুম খেলা রউফ ১৩ ইনিংস খেলে নিয়েছেন ২১ উইকেট।

২০১৮ থেকে লাহোর কালান্দার্সের নিয়মিত মুখ হারিস রউফ এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টির বিভিন্ন লিগ মিলিয়ে উইকেট নিয়েছেন ১২০টি,  ৮৭ ম্যাচে। মাত্র তিন বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে এমন পারফর্মন্স তাঁকে জায়গা করে দিয়েছে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। তবে তাঁর পাকিস্তানের সবুজ পোশাকে অভিষেক হয়েছে ২০২০ সালে তাও বাংলাদেশের বিপক্ষে ঘরের মাঠে। তারপর থেকে খেলা ২৫টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৩৩।

জানুয়ারিতে টি-টোয়েন্টি অভিষেক, আর অক্টোবরে ওয়ানডে। স্বপ্নের যাত্রা বলতে যা বোঝায় তাঁর সম্পুর্ণটাই পার করেছেন ডানহাতি এই মিডিয়াম ফাস্ট বোলার। ওয়ানডের আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ উজ্জ্বল পাকিস্তানের এই নতুন নক্ষত্র আট ম্যাচে উইকেট ১৪টি।

মাত্র তিন বছরে বদলে গেছে রউফের পুরো জীবন। মহল্লার বাকি সব ছোকরাদের মতো খেলতে গেলে মার খাওয়া ছেলেটা এখন জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য। জীবনে কখন কোন দিকে মোড় নেবে তা আগাম বলে দেওয়া বেশ দুষ্কর। তবে প্রত্যেকটা সুযোগ লুফে নেওয়া প্রয়োজন। স্বপ্ন না থাকলেও যে নিয়তির অদ্ভুতুরে লীলা খেলায় জীবন যাত্রাই যে স্বপ্নের মতো হয়ে যেতে পারে তাঁর জলজ্যান্ত উদাহরণ পাকিস্তানের এই ফাস্ট বলার হারিস রউফ।

তাঁর স্বপ্নের ঘোর যে ইতিমধ্যে কেটে গেছে তা নয়। বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টির মহামঞ্চে তিনি মোটে খেলেছেন দুই ম্যাচ। এই দুই ম্যাচেই তুলে নিয়েছেন পাঁচটি উইকেট। ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় নিজের নামটি লিখিয়ে ফেলেছেন হারিস। সুযোগ রয়েছে শীর্ষে উঠে আসার। মূল পর্ব তো কেবল শুরু। হ্যারিকেনের গতির ঝড়ে উড়ে যাবে বাঘা বাঘা ব্যাটারদের উইকেট। প্রত্যাশাটা ঠিক এমনই।

একবার ভাবুনতো সেই ট্যালেন্ট হান্ট না হলে তিনি কোথায় থাকতেন? নিশ্চয়ই পরে রইতেন সেই রাওয়ালপিন্ডির অলিগতিতে। তাঁকে আজও হয়ত শুনতে হতো বকাঝকা খেলার মাঠে দৌড়ে যাবার জন্যে। কিংবা সংসারের হাল ধরতে নেমে পড়তে হতো অন্যকোন জীবিকার সন্ধানে। হ্যারিকেন হারিসের গতি চলমান থাকুক। বিপদ সংকেত বাড়তে থাকুক প্রতিপক্ষের ব্যাটিং অর্ডারে। আর তাঁর কাঁধে ভর করে পাকিস্তান হয়ত পৌঁছে যাবে তাঁদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link